১৯৫২ সালের গোথিক রোমানিয়ার দুর্গম চার্চ থেকে ১৯৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ব্রোকফিল্ড, দ্য কনজুরিং ইউনিভার্সের কল্যাণে পুরোটাই এখন দর্শকের চেনা। কনজুরিং ইউনিভার্স যেন ফিরিয়ে এনেছে ছেলেবেলার বৃষ্টিভেজা নির্জন রাতের ভৌতিক গল্পের বাস্তব অনুভূতি। রোমাঞ্চে পুঞ্জিভূত জাম্প স্কেয়ার এবং পর্দার গা ছমছমে পরিবেশে কাঁথা-কম্বল মুড়িয়েও হাড় হয়ে যায় হিম, পেতে হয় চরম ভয়। শুধু হরর সিনে ইউনিভার্সই নয়, পুরো হলিউডেই কনজুরিংকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের অন্যতম সফল ফ্র্যাঞ্চাইজি বলে বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন লোককথা, বাস্তবতা, ও কল্পনার আশ্রয়ে গড়া দ্য কনজুরিং ইউনিভার্সের জানা-অজানা কিছু বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
ওয়ারেন দম্পতি
কনজুরিং ইউনিভার্সে দেখানো প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর এড ওয়ারেন (১৯২৬-২০০৬) ও লরেইন ওয়ারেন (১৯২৭-২০১৯) কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। তারা খ্যাতনামা আধিভৌতিক কাহিনির তদন্তকারী এবং পিশাচতত্ত্ববিদ হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৫ সালে দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে তাদের কোল আলো করে জুডি ওয়ারেন নামে এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। একসাথে তারা প্রায় ১০ হাজার প্যারানরমাল কেস নিয়ে কাজ করেছেন। কনজুরিং ইউনিভার্সের বেশিরভাগ কাহিনি তাদের বিভিন্ন আলোচিত কেসের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত। সিনেমার পর্দায় তাদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্যাট্রিক উইলসন এবং ভেরা ফারমিগা। ১৯৫২ সালে ‘আমেরিকান সোসাইটি অফ সাইকিক্যাল রিসার্চ’ নামক সংঘে প্যারানরমাল বিষয়ে তাদের অনুসন্ধানের হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন তারা এর সাথেই যুক্ত ছিলেন।
প্রতিশোধপরায়ণ প্রেতাত্মা
আসল পেরন পরিবার ওই ফার্ম হাউজে কাটিয়েছিল প্রায় দশ বছরের মতো। রজার পেরন ও তার স্ত্রী ক্যারোলিন পেরন ১৯৭০ সালের শীতে এই বাড়ি কিনেছিলেন। আয়তনে পুরো বাড়িতে জায়গা ছিল প্রায় ২০০ একরের মতো। এখানে পাঁচ মেয়ে আন্দ্রেয়া, ন্যান্সি, ক্রিস্টিন, সিন্থিয়া, এবং এপ্রিলকে নিয়ে বাস করতেন তারা। কিছুদিন যেতে না যেতেই পরিবারের সদস্যরা পুরো ঘরেই বিশ্রী উৎকট গন্ধের অস্তিত্ব টের পেত। রান্নাঘর তারা যতই পরিষ্কার করুক না কেন, তা কে যেন ময়লা করে যেত। ১৯৮০ সালের জুনে তারা এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
উপদ্রবকারী আত্মাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল ব্যাথশেবা শারমান। ১৮১২ সালে তিনি জন্মেছিলেন এই রোড আইল্যান্ডের ফার্ম হাউজেই। ধারণা করা হয়, জীবদ্দশায় তিনি ডাকিনীবিদ্যা, এবং কালো জাদু চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন মেরী টাউন ইস্টের নিকটাত্মীয়, যাকে ১৬৯২ সালে বিখ্যাত সালেম উইচ ট্রায়ালে ডাইনি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৫১ বছর পর ১৮৬৩ সালে ব্যাথশেবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর এক সন্তানের জন্ম দেন। জনশ্রুতি আছে, জন্মের এক সপ্তাহ পরই ওই ছেলেকে শয়তানের নিকট উৎসর্গ করতে গিয়ে স্বামীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরবর্তীতে ছেলের বদলে নিজেকে শয়তানের কাছে সমর্পণ করতে গিয়ে গাছে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকেই না-কি রোড আইল্যান্ডে কোনো নতুন পরিবার এলে তাদেরকে জ্বালিয়ে বেড়ায় ব্যাথশেবার প্রেতাত্মা।
মুভিতে দেখানো হয়েছে, ওয়ারেন দম্পতি পেরন পরিবারের ঘরে ঢুকেই এক্সরসিজম (ভূত তাড়ানোর কার্যকলাপ) শুরু করে। কিন্তু বাস্তবে এক্সরসিজম হলো ক্যাথলিক যাজকদের কাজ। ওয়ারেন ফ্যামিলি তা পারত না। তারা বাড়িতে ঢুকে ‘সানসে’ নামে এক প্রক্রিয়া চালিয়েছিল, যা অন্যান্য আত্মার জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল। এই দেখে রজার পেরন ওয়ারেনদের দ্রুত ঘর থেকে বের করে দেন। কিন্তু সিনেমায় দেখানো হয়েছে ভিন্ন জিনিস।
প্রোডাকশন হাউজের বিড়ম্বনা
কনজুরিং ইউনিভার্সের ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়েছিল দ্য কনজুরিং (২০১৩) মুভির মাধ্যমে। তবে, এই মুভিটি একদিনেই গড়ে ওঠেনি। রূপালি পর্দায় পেরন ফ্যামিলির ছাপচিত্র ফুটিয়ে তুলতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০ বছরেরও বেশি সময়। ক্যারোলিন পেরনের সাথে ওয়ারেন দম্পতির ভিডিও টেপে সাক্ষাৎকার দেখার পরেই প্রযোজক টনি ডেরোজা-গ্রান্ড এই কাহিনিকে পর্দায় তুলে আনবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। এজন্য বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউজের দরজায় কড়া নাড়লেও কেউ তাকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়নি। ২০০৯ সালে ‘Summit Entertainment’ এই মুভি বানানোর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু হঠাৎ তারাও ভোল পাল্টে ফেলে। পরবর্তীতে তিনি ওয়ার্নার ব্রাদার্সে দ্বারস্থ হলেই ব্যাটে-বলে মিলে যায়।
ডিসির মুভিতে অ্যানাবেলের ক্যামিও
ভবিষ্যতে ‘DC Extended Universe (DCEU)’ এবং ‘The Conjuring Universe’ এর মধ্যে ক্রসওভার হওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে। তবে, সেটা কতখানি বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কনজুরিং ইউনিভার্স বিল্ডাপ করেছেন ডিরেক্টর জেমস ওয়ান। তিনি আবার ডিসিইউ-এর ‘Aquaman’ সিনেমার পরিচালক। এছাড়াও, প্রযোজক পিটার সাফরান যিনি ‘Conjuring 1, 2, 3’, ‘Annabelle’, ‘Annabelle: Creation’, ‘The Nun’ এর প্রযোজক ছিলেন, তিনি আবার ডিসির ‘Shazam!’ এবং ‘Aquaman’, এই দুই মুভিরও প্রযোজক। ‘অ্যাকোয়াম্যান’ এবং ‘শ্যাজাম!’ মুভিতে অ্যানাবেল ডলের স্পষ্ট ইস্টার ইগ ছিল। জেমস ওয়ান এবং পিটার সাফরান কেন এই ইস্টার এগ দিয়েছেন, সেটা তারাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
তবে ডিসি কমিকসের সাথে কনজুরিং ইউনিভার্স সরাসরি সংযুক্ত। ২০২১ সালের এপ্রিলে ডিসি হররের অধীন ‘The Conjuring: The Lover’ নামের পাঁচ ইস্যু সম্বলিত এক কমিক মুক্তি পেয়েছে। লিমিটেড এই কমিক সিরিজ কনজুরিংয়ের তৃতীয় কিস্তি ‘The Conjuring: The Devil Made Me To Do It’ এর প্রিক্যুয়েল। অর্থাৎ ডিসি কমিকসের যেকোনো একটা ইউনিভার্স কনজুরিংয়ের সাথে সরাসরি কানেক্টেড।
আর-রেটিং
দ্য কনজুরিং মুভিতে কোনো প্রকার খোলামেলা যৌন দৃশ্য, গালিগালাজ, ওভার ভায়োলেন্স না থাকলেও এর হরর এলিমেন্টের জন্য ‘মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশন অভ আমেরিকা’ একে ”R-Rated’ ক্যাটাগরিতে রেখেছিল। এই সংস্থা জানিয়েছে কোনো দৃশ্য কাট-ছাট করেও এটাকে আর-রেটেড থেকে পিজি-১৩ তে নামানো যায় না। এদিকে জেমস ওয়ানও দেখলেন- এসব দৃশ্যে ছুরি-কাঁচি চালালে হরর সিনেমার আসল মজাই মাটি হয়ে যায়। তাই, তিনি সেটাকে আর-রেটেড রাখারই সিদ্ধান্ত নেন।
অশরীরীর কবলে কলাকুশলীরা
এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সিনেমা দেখার পর শুধু যে প্রেতাত্মা-পিশাচের ভয়ংকর প্রতিরূপ দর্শকের চোখের সামনে ঘুরপাক পেয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। অশরীরী কিছুর উপস্থিতি আঁচ করতে পেরেছেন খোদ ইউনিভার্সে সংযুক্ত কলাকুশলীরাও। তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমনটাই দাবি করেছেন। কনজুরিং ইউনিভার্স গড়ার প্রধান কারিগর পরিচালক জেমস ওয়ান যখন কনজুরিং মুভির স্ক্রিপ্ট নিয়ে প্রযোজকের সাথে আলাপ করছিলেন, তখন তার লাইন নাকি বার বার বিচিত্র এক আওয়াজে কেটে যেত। তিনি আরও জানিয়েছেন, কনজুরিং ১ এর স্ক্রিপ্ট লিখার রাতে তার পোষা কুকুর রুমের কোণায় কিছু একটার উপস্থিতি টের পেয়ে হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। এরকম কয়েকদিনই সে অস্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছিল। সারা ঘরে চিরুনি অভিযান চালিয়ে কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাননি ওয়ান।
২০১৩ সালে ভেরা ফারমিগা পিটসবার্গ পোস্ট-গ্যাজেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফিল্মিং শুরু হবার এক রাত আগে তিনি ল্যাপটপ দিয়ে ইউটিউবে লরেইন ওয়ারেনের বিভিন্ন ফুটেজ দেখছিলেন। পরবর্তীতে ল্যাপটপ বন্ধ করে ওয়ানের সাথে ফোনে আলাপ করতে যান। আলাপ সেরে ল্যাপটপ খুলতেই বড় বড় তিনটে আঁচড় দেখতে পান। প্রোডাকশনের কাজ শেষ হবার তিন মাস পর তিনি উরুতে তিনটা আঁচড় দেখতে পেয়েছিলেন, যার সাথে ল্যাপটপের দেখা আঁচড়ের মিল রয়েছে। কোনো পোকামাকড়ের কামড় ভেবে এটাকে আর পাত্তা দেননি তিনি।
কাহিনি এখানেই শেষ নয়। সিনেমার শুটিং সেটে উপস্থিত ছিলেন আসল ক্যারোলিন পেরন। তার ভাষ্যমতে, শুটিংয়ের সময় সেই অশরীরী আত্মার উপস্থিতি টের পাচ্ছিলেন, যেটা তিনি তার ফার্ম হাউজের ঘরে পেতেন। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়। কনজুরিং ১ মুভির পর অনেক কলাকুশলীই বিভিন্ন অস্বাভাবিক সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকেন। অনেকেই দাবি করেছিলেন, সিনেমার পর থেকে তারা অতিপ্রাকৃত কিছুর উপস্থিতি আঁচ করতে শুরু করেন। সেজন্য, কনজুরিং ২ সিনেমার শুটিংয়ের আগে গির্জা থেকে পাদ্রী ডেকে এনে খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতি অনুসারে পুরো জায়গা শুদ্ধ করা হয় অশুভ কিছুর অস্তিত্ব দূর করতে।
পেরন পরিবারের আসল ঘর
দ্য কনজুরিং মুভিতে দেখানো পেরন পরিবারের ঘরের সাথে আসল ঘরের কোনো মিল নেই। সিনেমায় দেখানো পেরনদের ঘরের এক্সটেরিয়র শট নেওয়া হয়েছে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার ব্ল্যাক রিভারের কিনারায় অবস্থিত এক ফার্ম হাউজে। ইন্টেরিয়র শটের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে নর্থ ক্যারোলিনার স্ক্রিন জেমস স্টুডিও। তাদের আসল বাড়িটির অবস্থান ছিল আমেরিকার রোড আইল্যান্ডের হ্যারিসভিলে এলাকায়।
পেরেন পরিবার ওই ঘরে উঠার আগপর্যন্ত আটটি পরিবার ভৌতিক ঘটনার শিকার হয়েছিল ঘরটিতে। তাদের পরিবারের অনেকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে, অনেকে আবার বিনা কারণে আত্মহত্যাও করেছেন। বর্তমানে এক দম্পতি কোনো প্রকার অশরীরীর উপস্থিতি টের পাওয়া ছাড়াই ওই ঘরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। তবে কনজুরিং সিনেমার পর পেরন পরিবারের এই হন্টেড হাউজের কথা নেট দুনিয়ায় চাউর হলে অনেকেই কৌতূহলপরবশ হয়ে এই ঘর দেখতে আসত। অনেকে একে ‘ভূতুড়ে ঘর’ বলেও সম্বোধন করত। এতে বিরক্ত হয়ে ওই দম্পতি ওয়ার্নার ব্রোসের নামে মামলাও করেছিল। সিনেমার স্ক্রিপ্টে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে আন্দ্রেয়া পেরনের লিখা বই ‘হাউজ অভ ডার্কনেস’, যা তিনি সাজিয়েছেন নিজ পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া প্যারানরমাল কাহিনির উপর ভিত্তি করে। এছাড়াও শুটিংয়ে তিনি পরামর্শদাতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
ওয়ারেন কাল্ট মিউজিয়াম
সিনেমার মতোই ওয়ারেন দম্পতি অভিশপ্ত সকল বস্তু দিয়ে আমেরিকার সেন্ট মনরোতে ‘The Warren’s Occult Museum’ নামে এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। মনরো হলো লরেইনের হোমটাউন। জামাতার সাহায্য নিয়ে তিনি এই সংগ্রহশালাটি গড়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত রুমটি এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিনেমায় দেখানো প্রায় সকল জিনিসই ওই সংগ্রহশালায় মজুদ ছিল। এমনকি ওই ভূতুড়ে অ্যানাবেল ডলও।
দ্য ক্রুকড ম্যান
কনজুরিং ২ মুভিতে অন্যান্য অশরীরীর সাথে পাল্লা দিয়ে দ্য ক্রুকড ম্যানও সমান আধিপত্য বজায় রেখেছে। এই ক্রুকড ম্যান আসলে উঠে এসেছে নার্সারির এক ছড়া থেকে। কিন্তু মুভিতে একে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা এখন কোনো বাচ্চার সামনে ছন্দে ছন্দে পড়াও যেন দায়। এই ক্রুকড ম্যান সম্পর্কে একটা স্পিন অফ মুভি আসার কথাও ছিল এই ইউনিভার্সে যেটার প্রযোজক ছিলেন পিটার সাফরন এবং জেমস ওয়ান। হরর ফিল্মের এক সাব-জনরা ‘ডার্ক ফেইরিটেল’ জনরায় নির্মিত হবার কথা মুভিটির। মাইক ভ্যান ওয়েস স্ক্রিপ্টের উপর কাজও শুরু করেছিলেন, এবং সিনেমার সম্ভাব্য মুক্তি ঠিক করে রাখা হয়েছিল কনজুরিং ৩ মুভির পর। কিন্তু করোনা মহামারির পরেই সকল পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে যায়। বর্তমানে এর সম্পর্কে আর কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই।
The Enfield Poltergeist
কনজুরিং ২-এর গল্প সাজানো হয়েছে ইংল্যান্ডের হগসন পরিবারের ‘Enfield poltergeist’ কাহিনির উপর ভিত্তি করে। ১৯৭৭ সালের আগস্টে, পেগি হগসন লন্ডনের এনফিল্ডের মেট্রোপলিটন পুলিশকে ফোন করে জানান, তার ঘরের আসবাব পত্র কারও সাহায্য ছাড়াই আপনাআপনি এক জায়গা থেকে অন্যত্র সরে যাচ্ছে। তার বাকি চার সন্তান দেয়ালে বীভৎস আঘাতের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। একজন মহিলা পুলিশ কনস্টেবল সেটার প্রাথমিক তদন্ত করতে আসলে জানান, তিনিও একটি চেয়ারকে বিনা কারণেই নড়তে দেখেছেন।
পরবর্তী আট মাসে ত্রিশেরও অধিক লোক (হগসনের প্রতিবেশী, সাইকিক রিসার্চর, সাংবাদিক) জানিয়েছেন, তারা আসবাবপত্র সরে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন থালা-বাসন ঘরের এদিকে-ওদিকে উড়তে দেখেছেন। রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়া এই ভৌতিক কাহিনি কভার করে দ্য ডেইলি মিরর। বাদ যায়নি বিবিসিও। ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ‘বিবিসি রেডিও ৪’ থেকে ‘The Enfield Poltergeist’ নামে একটি ডকুমেন্টারি সম্প্রচার করা হয়, যার রিপোর্টার ছিলেন রোজ মরিস।
পরিবারের ভাষ্যমতে, হগসনের মেয়ে জেনেটের উপর এই বাড়ির পূর্ব মালিক বিল উইলকিন্সের আত্মা ভর করেছিল, যিনি মারা গিয়েছিলেন ব্রেন হেমোরেজে। মুভিতে দেখানো ভ্যালাকের কাহিনি স্ক্রিপ্ট রাইটার যুক্ত করেছেন কাহিনিতে আরও গভীরতা বাড়ানোর জন্য। এখানে ওয়ারেন দম্পতিরও তেমন বড় কোনো ভূমিকা ছিল না। তারা শুধুমাত্র একদিন থেকেছিলেন ওই বাড়িতে। আত্মা তাড়ানোর জন্য বাকি ঝাড়ফুঁকের কাজটা করেছিলেন গির্জা থেকে আসা পুরোহিত।
অ্যানাবেল ডল
কনজুরিং ইউনিভার্সে অ্যানাবেল ডল বৃহৎ ভূমিকা পালন করে বলেই তাকে নিয়ে আলাদা আলাদা তিনটি সিনেমা এসেছে। এই অ্যানাবেল ডল সত্যিকার অর্থেই বিদ্যমান। ওয়ারেন কাল্ট মিউজিয়ামে এটি এখনো সংরক্ষিত আছে। তবে মুভিতে দেখানো অ্যানাবেল ডলের সাথে বাস্তবে অ্যানাবেলের বিস্তর ফারাক। কথিত আছে, অ্যানাবেল ডল নিয়ে যে ছেলেখেলা করেছে, তার সাথেই ঘটেছে দুর্ঘটনা। তবে এই পুতুল কীভাবে অভিশপ্ত হলো, তা নিয়ে রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। হবি স্টোর থেকে কিনে এনে জন্মদিনের উপহার দেওয়ার কাহিনি সবাই জানে। অ্যানাবেল ক্রিয়েশনে অ্যানাবেল ডলে নরকের শয়তান প্রবেশের কাহিনি স্ক্রিপ্ট রাইটারের নিজের বানানো।
বৈসাদৃশ্য
সিনেমায় কিছু কিছু উপাদান কোর এলিমেন্ট হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে কাহিনির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। যেমন, দ্য নান মুভিতে দেখানো হয়েছে পিশাচরূপী এক সন্ন্যাসিনী ভ্যালাককে, বাস্তবে ওই ঘরানার কোনো অতিপ্রাকৃত কেসের সন্ধান মেলেনি। ১৯৭০ সালে চার্চে এক ভূতাবিষ্ট সন্ন্যাসিনীর কেস অনুসন্ধান করতে গিয়েছিলেন ওয়ারেন দম্পতি। তারা জানিয়েছিলেন, গির্জায় ওই অশুভ আত্মার উপস্থিতিও টের পেয়েছিলেন তারা, কিন্তু এর সাথে ভ্যালাকের কোনো সম্পর্কে নেই।
আর সিনেমায় বিদঘুটে ভঙ্গিমার যে সন্ন্যাসিনীকে পোর্ট্রে করা হয়েছে, পিশাচ ভ্যালাকের সাথে এর আকৃতিগত কোনো সাদৃশ্য নেই বললেই চলে। ভ্যালাকের সন্ধান মেলে ১৭ শতকের তন্ত্রসাধনার বিখ্যাত ‘The Lesser Key of Solomon’ নামক বইতে। বর্ণিত ৭২ জন শয়তানের মধ্যে ভ্যালাক ছিল ৬২ নম্বরে, যাকে নরকের প্রধানমন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেউ গুপ্তধন খুঁজে পেতে চাইলে কালো জাদুর মাধ্যমে তাকে ডেকে আনত। এনফিল্ডের কাহিনিতে ভ্যালাককে দেখানো হয়েছে শুধুমাত্র ওর ব্যাকস্টোরি ডেভেলপ ছিল বলে।
রূপালি পর্দায় লরেইন ওয়ারেন
কনজুরিং সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, ওয়ারেনের দেওয়া প্রেজেন্টেশন শুনছিলেন হল ভর্তি মানুষ। সামনের সারিতেই বসেছিলেন এক বৃদ্ধা, যিনি মূলত আসল লরেইন ওয়ারেন। তবে এটাই প্রথম নয়, এর আগেও ১৯৮২ সালে তিনি ‘Amityville II: The Possession’ এ ডিমনোলজি অ্যাডভাইজর হিসেবে পর্দায় দেখা দিয়েছেন। এছাড়াও ১৯৯১ সালের মুভি ‘Haunted’ এর অন্যতম একজন লেখক ছিলেন তিনি।
সব্যসাচী বিশারা
প্রসঙ্গ যখন হরর ফিল্মের সাউন্ডট্র্যাক কম্পোজিশন, জোসেফ বিশারা তখন এক কাঠি সরেস। বহু হরর মুভিতে তিনি সুরের ঝলকে নিজ প্রতিভার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। কনজুরিং সিনেমায় যে ব্যাথশেবাকে দেখে বহু মানুষের ঘুম হারাম হয়েছে, সেই বাথশেবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোসেফ বিশারা। মজার ব্যাপার হলো, তিনি আবার এই ফিল্মে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও রচনা করেছেন। তবে, কনজুরিং ছাড়াও তিনি জেমস ওয়ানের ইনসিডিয়াস এবং ইনসিডিয়াস ৩ এ লিপস্টিক-মুখো পিশাচের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
হিসাব-নিকাশ
দ্য কনজুরিং ইউনিভার্সে এই পর্যন্ত মুভি এসেছে মোট আটটি। ব্যবসার দিক থেকে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রযোজকদের পকেট ভারী করেছে। ফ্র্যাঞ্চাইজির পেছনে ১৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে আয় হয়েছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে।
- ‘দ্য নান (২০১৮)’ – ব্যয় ২২ মিলিয়ন ডলার, আয় ৩৬৫.৫ মিলিয়ন ডলার।
- ‘দ্য কনজুরিং ২ (২০১৬)’ – ব্যয় ৪০ মিলিয়ন ডলার, আয় ৩২১.৮ মিলিয়ন ডলার।
- ‘দ্য কনজুরিং (২০১৩)’ – ব্যয় ২০ মিলিয়ন ডলার, আয় ৩১৯.৫ মিলিয়ন ডলার।
- ‘অ্যানাবেলে: ক্রিয়েশন (২০১৭)’ – ব্যয় ১৫ মিলিয়ন ডলার, আয় ৩০৬ মিলিয়ন ডলার।
- ‘অ্যানাবেলে (২০১৪)’ – ব্যয় ৬.৫ মিলিয়ন ডলার, আয় ২৫৬.৬ মিলিয়ন ডলার।
- ‘অ্যানাবেলে কামস হোম (২০১৯)’ – ব্যয় ৩০ মিলিয়ন ডলার, আয় ২৩১.৩ মিলিয়ন ডলার।
- ‘দ্য কনজুরিং ৩ (২০২১)’ – ব্যয় ৩৯ মিলিয়ন ডলার, আয় ২০২ মিলিয়ন ডলার।
- ‘দ্য কার্স অভ লা ইয়োরোনা‘ (২০১৯) – ব্যয় ৯ মিলিয়ন ডলার, আয় ১২৩ মিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে দ্য কনজুরিং ইউনিভার্স ছিল সফল এক হরর ফ্র্যাঞ্চাইজি। প্রযোজকেরা তুলনামূলক অল্প পয়সা লগ্নিতেই অধিক লাভ উঠিয়ে আনতে পেরেছেন। যেহেতু ওয়ারেন দম্পতির অভিজ্ঞতার ঝুলিতে প্যারানরমাল কেসের অভাব নেই, তাই সেগুলো থেকে গল্প সেঁচে সিনেমা তৈরিতে এত বেশি বেগ পাবার কথা না। এছাড়াও লোককথা, উপকথা এবং পুরাণে বহু পৈশাচিক চরিত্র বিদ্যমান যাদের ব্যাকস্টোরি ছড়িয়ে আছে জনশ্রুতিতে।