বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন জোসেফ কে নামে এক ভদ্রলোক। ঘটনার আকস্মিকতায় বেচারা কে সাহেব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। পেশায় ব্যাংকার কে সাহেব সদ্য ত্রিশের কোঠায় পা দিলেন। সারাদিনের অফিস শেষে রাতে শান্তিমতো ঘুমিয়ে সকালে উঠে দেখেন এই অলুক্ষুণে কাণ্ড। তার ঘরে হানা দিয়েছে দুই পুলিশ অফিসার। তাদের দাবি, জোসেফ কে’র বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উপর থেকে।
পুরো ব্যাপারটি হজম করতে তার বেশ খানিকটা সময় লাগলো। তার উপর প্রতিবেশিদের উঁকিঝুঁকি দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার পর উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করলেন, “গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সেটা নাহয় মানলাম। কিন্তু কোন অভিযোগের কারণে আমাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে? কী আমার অপরাধ?” এরপর পুলিশ কর্মকর্তাগণ যে উত্তর দিলেন, সেটা শোনার জন্য শুধু তিনি নন, কেউই প্রস্তুত ছিল না।
তারা জানালেন, জোসেফ কে’র বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ কী, সেটা তারা জানেন না। তিনি এই উত্তরে বিরক্ত হয়ে গেলেন। কী মুশকিল! তিনি স্বাভাবিকভাবে তাদের ঊর্ধ্বতন দারোগা বাবুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। অনেকটা অনিচ্ছার পরেও পুলিশ সে ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর জানা গেল, স্বয়ং দারোগারও জোসেফ কে’র বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পর্কে ধারণা নেই।
এই কথা শুনে কে সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি ভীষণ চটে গেলেন। বললেই হলো, এটা কি মগের মুল্লুক নাকি! তাকে গ্রেপ্তার করা কি এত সোজা? কিন্তু সেদিন জোসেফ কে’র ক্রোধ তাকে একটুও সাহায্য করতে পারেনি। মগের মুল্লুক হোক বা না হোক, গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন তিনি। আর সেই সাথে শুরু হয়ে যায় ফ্রানৎস কাফকার অদ্ভুত উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’-এর যাত্রা।
১৮৮৩ সালে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগের ইহুদি ঘেটোতে জন্ম হয়েছিল কালজয়ী সাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকার। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কাফকা পরিবার সমাজের অভিজাত শ্রেণির সাথে মিশতে পারতেন না। এই ঘটনা ফ্রানৎসের পিতা হারমানকে বেশ ব্যথিত করতো। তাই তিনি অভিজাত পরিবারের কন্যা জুলি লয়িকে বিয়ে করেন।
জুলি এবং হারমানের প্রথম সন্তান ছিলেন কাফকা। তাকে যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সেখানে তিনি প্রতিনিয়ত ভালো ফলাফলের মাধ্যমে নিজের প্রতিভার জানান দিতে থাকেন। তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে পিতা হারমান তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দেন। কিন্তু ফ্রানৎস এরপরই বখে যেতে থাকেন। তার পড়াশোনা এবং স্বাস্থ্য উভয়ের অবনতি ঘটে।
গোল্লায় যেতে থাকা ফ্রানৎসকে রক্ষা করতে এ সময় দৃশ্যপটে হাজির হন ম্যাক্স ব্রড নামক এক লেখক। ১৯০২ সালে ফ্রানৎস এবং ম্যাক্সের পরিচয় হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেন। ম্যাক্সের সান্নিধ্যে ফ্রানৎস লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯০৪ সালে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘ডিসক্রিপশন অব আ স্ট্রাগল’ শিরোনামে।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি পড়াশোনায় মনোযোগ দেন। ১৯০৬ সালে তিনি কার্ল ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর যোগ দেন ইনস্যুরেন্স ব্যবসায়। এর পাশাপাশি তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতেন, আবার তার ছোট ভাইয়ের কারখানার কাগজপত্রেরও তদারকি করতেন। সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে তিনি পুনরায় বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে ফিরে যেতে থাকেন।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও তার লেখার ধার একটুও কমেনি। উল্টো এই সময়ে লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ১৯১৫ সালে থিওডোর ফন্তে পুরস্কারে ভূষিত হন। লেখক হিসেবে ফ্রানৎস কাফকার শ্রেষ্ঠ রচনার তালিকায় থাকবে মেটামরফোসিস, দ্য হাঙ্গার আর্টিস্ট, দ্য ক্যাসল, দ্য ট্রায়াল ইত্যাদি। প্রথম নাম ফ্রানৎস হলেও তিনি কাফকা নামেই পাঠকদের নিকট পরিচিতি লাভ করেন।
দ্য ট্রায়াল উপন্যাস রচনার পেছনে কাফকার কর্মজীবনে ঘটে যাওয়া নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি আমলাদের সাথে উঠা-বসা করেছেন। এমনকি নিজেও কয়েক বছর আমলা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মক্ষেত্রে কাজের ভয়ংকর চাপ থেকে নিজেকে খানিকটা অবকাশ দেওয়ার জন্য তিনি কলম হাতে নেন। উপন্যাস রচনা তার জন্য ওষুধের মতো কাজ করতো।
কিন্তু পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গল্প, উপন্যাস লেখার পর সেগুলো সযত্নে বইয়ের তাকে রেখে দিতেন। একবারও সেগুলো প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করেননি। তার অপ্রকাশিত সেই লেখাগুলোর তালিকায় ‘দ্র ট্রায়াল’-এর নামও ছিল।
মাত্র ৪০ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ফ্রানৎসের করুণ মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তিনি তার বন্ধু ম্যাক্সের নিকট তার সকল সাহিত্যকর্ম আমানত রেখে যান। তিনি ম্যাক্সকে তার যাবতীয় সাহিত্যকর্ম আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ভাগ্যিস, ম্যাক্স ব্রড ফ্রানৎসের শেষ অনুরোধ রাখতে পারেননি। তিনি ফ্রানৎস কাফকার নাম সংযুক্ত করে সেসব লেখা ছাপিয়ে বাজারজাত করে দেন। পাঠক সমাজে ছড়িয়ে পড়ে কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়া এক আমলার করুণ কল্পগাথা। দ্য ট্রায়ালের জোসেফ কে সাহেবের বিধ্বস্ত যাত্রায় তারা খুঁজে পান হারিয়ে যাওয়া ফ্রানৎস কাফকাকে।
দ্য ট্রায়ালের মাঝে আমরা এক করুণ সত্যের মুখোমুখি হই যা শুধু জোসেফ কে নন, বরং আদালতপাড়ায় বিচারের মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য সত্য। আইন অনুযায়ী, একজন আসামী যত বড় অপরাধেই অভিযুক্ত হন না কেন, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নির্দোষ। কিন্তু এই কথা শুধু পুঁথিতে সত্য, বাইরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এক রহস্যময় মামলায় ফেঁসে যাওয়ার পর জোসেফ কে’র সাথে সবাই বিরূপ আচরণ শুরু করে। এমনকি তার অফিসের কর্তারা তাকে দোষী হিসেবে ধরে নিয়েছে।
তিনি যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য নয়, সত্য হতে পারে না, পরিস্থিতি ততই তার নাগালের বাইরে চলে যায়। প্রথমে তিনি আদালতে তার মামলার অসারতা নিয়ে কথা বলেন। এরপর তিনি তার চাচাকে এ বিষয়ে অবগত করেন। তিনি তার প্রতিবেশী মিসেস গ্রুবাককে তার দুর্ভাগ্যের কথা জানান। কিন্তু তারা কেউই কে সাহেবকে তেমন গ্রাহ্য করেনি। এমনকি কাহিনী প্রসঙ্গে উঠে আসা বিভিন্ন অপরিচিত চরিত্রের নিকটও তাচ্ছিল্যের শিকার হন তিনি। তারা ধরেই নিয়েছেন, কে সাহেব দোষী। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার বিচারকার্য তখনো শুরুই হয়নি।
উপন্যাসের এই ভয়াবহতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরাজ করেছে। এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি তিক্ত সত্য। একটি মামলা একজন ব্যক্তির জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে, কিন্তু সেই ব্যক্তি ব্যতীত অন্যদের নিকট হয়তো মামলাটি তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি জোসেফ কে যাকে উকিল হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, তিনিও একই দলের মানুষ।
তার ভাষ্যমতে, এই মামলার একমাত্র পরিণতি কে সাহেবের কারাবরণ হওয়া। তাই তিনি মনে করেন, মামলার বিচারকার্য যত দেরিতে শুরু করা যায়, ততই মঙ্গলজনক। অথচ, এরা সবাই ভুলে গেছে, জোসেফ কে’র বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ কী, সেটাই এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। এরকম এক অসহনীয় পরিবেশে, অসহযোগিতার শিকার জোসেফ কে’র কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাসজুড়ে। এই কাহিনী শুধু কাল্পনিক জোসেফ কে নয়, বরং পাঠকদের জন্যেও সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্নের চেয়ে কম কিছু নয়। লেখকের শক্তিশালী লেখনীর ফলে একসময় পাঠক নিজেকে জোসেফ কে’র অবস্থানে দেখতে পায়, যা রীতিমতো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।
উপন্যাসটির প্রকাশক ম্যাক্স ব্রডের মতে, ‘দ্য ট্রায়াল’ একটি অসমাপ্ত উপন্যাস। যদিও পাঠকগণ মূল উপন্যাসে ‘The End’ শিরোনামে একটি অধ্যায় পাবেন, যেখানে লেখক জোসেফ কে’র অন্তিম পরিণতি তুলে ধরেছেন। কিন্তু ম্যাক্সের মতে, কাফকা শেষ অধ্যায়ের পূর্বে আরো কয়েকটি অধ্যায় লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতা এবং মানসিক অপ্রস্তুতির কারণে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিন্তু এই অসমাপ্ত উপন্যাসই যেন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতারণা সম্পর্কে আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছে।
কাফকার এই উপন্যাসটি মূলত ব্যর্থতার কাহিনী সম্ভার। কে’র নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে, কীভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ ব্যর্থ হয়। কিন্তু তারপরেও সে হাল ছাড়ে না। ক্ষীণ আশা নিয়ে সংগ্রাম করে যায়। এছাড়া এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি ভগ্ন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কঠোর এবং গভীর সমালোচনা করেছেন। এরূপ বিচারব্যবস্থা ন্যায় বিচারের বদলে হয়রানির বার্তাবাহক হয়ে দাঁড়ায়, যার সাক্ষী ফ্রানৎস কাফকা, জোসেফ কে, আমি, আপনি সবাই।
অনেকের মতে, দ্য ট্রায়াল উপন্যাসটি অসমাপ্ত রাখার মাধ্যমে ফ্রানৎস কাফকা যেন কাহিনীর সার্থকতা নিশ্চিত করেছেন। উপন্যাসে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টায় থাকা জোসেফ কে’র বিচার যেমন অবিচার, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মারপ্যাঁচে পড়ে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে, চিরদিন অসমাপ্ত হয়ে থাকবে, তেমনি এই অসমাপ্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে রচিত এই উপন্যাসও চিরদিন অসমাপ্ত হয়ে থাকবে সাহিত্যজগতে।
ফ্রানৎস কাফকার জগতের সাথে পরিচিত আছেন কিন্তু ‘দ্য ট্রায়াল’-এর স্বাদ পাননি, এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত হাতে গোনা যায়। এই উপন্যাস তাকে এনে দিয়েছে জগৎব্যাপী সম্মাননা।
অন্যান্য বিখ্যাত গল্পের ন্যায় কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’-এরও রূপালী পর্দা এবং মঞ্চ রূপান্তর করা হয়েছে। ইতিহাসখ্যাত পরিচালক অরসন ওয়েলেস ১৯৬২ সালে একই নামে উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপান্তর করেন। দ্য ট্রায়াল নির্মাণে তার ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে জানান, “আর যে যাই বলুক, দ্য ট্রায়াল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিনেমা নির্মাণ।” এই সিনেমায় ‘সাইকো’খ্যাত নায়ক অ্যান্থনি পারকিন্স জোসেফ কে চরিত্রে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসিত হন। ১৯৯৩ সালে সিনেমাটি পুনঃনির্মিত হয়।
নব্বই দশকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ‘দ্য ট্রায়াল’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ মঞ্চস্থ করা হয়েছে। এসব কিছু জানান দিচ্ছে, কাফকার মৃত্যুর একশত বছর পরেও ‘দ্য ট্রায়াল’-এর কদর একটুও কমেনি। আবার এর মাধ্যমে এও প্রমাণিত হয়, আমলাতান্ত্রিক জালে আবদ্ধ ঘুণেধরা বিচার ব্যবস্থার দুর্দশাও এখন পর্যন্ত লাঘব পায়নি। তাই প্রতিনিয়ত আদালত প্রাঙ্গনে হয়রানির শিকার হচ্ছে হাজার হাজার জোসেফ কে।