টার্কিশ হরর সিনেমার কথা উঠলেই ‘ডাব্বে’, ‘সিক্কিন’-এর সিরিজের সিনেমাগুলোর নামই এ অঞ্চলে বহুল চর্চিত। মানের দিক থেকে সর্বসাকুল্যে যেগুলো মাঝারি দাগ অব্দি পৌঁছাতে পারে। ধর্মগত নানান বিশ্বাস, অলৌকিকতা আর স্থূল জাম্প স্কেয়ারই সেগুলোর একমাত্র উপজীব্য। ফিল্মমেকিং নিয়ে কোনো নৈপুণ্য প্রদর্শনের ইচ্ছা সেসব সিনেমায় চোখে পড়ে না। ওই জায়গা থেকে এই ‘বাস্কিন’ টার্কিশ হরর জনরায় একটা অ্যানোম্যালিই বটে। এতে রূপক আছে। রূপক নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। সুরিয়াল উপাদান আছে। ফিল্মমেকিং নিয়ে ধারণা আছে। মাঝারি দাগে আটকে যায়নি এ সিনেমা।
সিনেমার টাইটেল দৃশ্যে দেখা যায়, একটা বাচ্চা ছেলের ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ করে। কারণটা টের পাওয়া যায় একটু পরেই। পাশের রুম থেকে ভেসে আসা শীৎকারের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গমে লিপ্ত দুই নর-নারী। সম্ভবত তার বাবা-মা’ই হবে। তাদের চেহারা অবশ্য ক্যামেরায় দেখানো হয় না, শব্দ ছাড়া। বাচ্চা ছেলেটা দরজায় কান রেখে কিছু শোনার চেষ্টা করে। তারপর সেখান থেকে কান সরিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ডাইনিং রুমে।
গোটা দৃশ্যে বিরাজ করে নীল রঙের প্রকটতা। টিভির অহেতুক চালু হওয়া, ঝিরঝির করা; হররের আবহ তৈরির এই গড়পড়তা উপাদানগুলোর স্থায়িত্বকাল ফুরালে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে চোখে পড়ে, ঘরের অন্যপ্রান্ত ছেয়ে গেছে গাঢ় লাল রঙে। একটা বীভৎস হাত, বাচ্চা ছেলের চিৎকার; দুটো বিজোড় শটকে কাট করে রিপিট করা আর আবহসঙ্গীতকে চড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ভয় তৈরির চেষ্টা দিয়েই টাইটেল দৃশ্যটি শেষ হয়। দেখতে গেলে, হরর সিনেমায় এমন দৃশ্য একদমই নতুন নয়। ভয়ের আবহ তৈরির কোনো উপাদানও নতুন নয়। তবে সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট স্কেল অব্দি ব্যবহার করার ফলে দৃশ্যটাকে ছাড় দেওয়া যায়।
টাইটেলের পরের দৃশ্যেই একটা পুলিশ ভ্যান নজরে পড়ে। ভ্যানের ভেতর থেকে দর্শককে একবার ভ্রমণ করিয়ে আনা হয় কিছু ক্লু নজর আন্দাজ করতে, যা পরবর্তী পাজল মেলাতে সাহায্য করবে। সেখান থেকে ক্যামেরা একটা নির্জন রেস্তোরাঁর ভিড়ে। পাঁচজন পুলিশ অলস বসে চটুল কথাবার্তায় মত্ত। এ দৃশ্যে ভয় জাগানিয়া উপাদানগুলো; কাঁচা মাংস, ব্যাঙ- আবার খুব বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। চাপা ভয় আর অদম্য কৌতূহলের আবহটা এই দৃশ্যে দক্ষতার সাথেই তৈরি করেছেন পরিচালক।
তো এই পাঁচ পুলিশ আজকের আলস্যে ভরা রাতটার ইতি টানতে ফিরতি পথ ধরেছিল। কিন্তু কে জানতো, গতিপথ পুরোটাই উল্টে যাবে! ওয়াকিটকি’তে নির্দেশ এল, একটা জায়গায় তাদের জরুরিভাবে পৌঁছাতে হবে। জায়গার নাম শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল পাঁচজনের মাঝে সদ্য যোগদান করা তরুণ পুলিশ। ব্যাকগ্রাউন্ডে ভয় তখন ডালপালা আরো মেলছে। গাড়ি হারাল গতিপথ, পড়ল গিয়ে পানিতে। তবে মারা পড়েনি কেউ। সেটা কি সৌভাগ্যের? পরবর্তী ঘটনা কিন্তু তা বলে না। ওই জংলামতন জায়গাটায় দেখা হলো কিছু অদ্ভুত লোকের সাথে। কণ্ঠে তাদের অশুভ ইঙ্গিত।
ক্লাইম্যাক্স তো তৈরি হতে হবে। তাই আরো হরর সিনেমায় যেরকমটা দেখে আসা, লোকগুলোর কথায় গা না করে তারা নির্দেশিত স্থানের উদ্দেশে পা বাড়ায়। এবং এ পর্যায় থেকেই সিনেমার গল্প বাস্তবের সাথে সংযুক্ততা ঝেড়ে পুরোদমে পরাবাস্তবে ভর করে। জায়গাটায় গিয়ে তারা আবিষ্কার করে অদ্ভুত আরেক জগত। বেরোবার আগেই পরে যায় গোলকধাঁধায়। তাদের উপস্থিত করা হয় অনেক প্রশ্নের সামনে, যার কোনো উত্তর নেই। অদ্ভুত আকৃতির এক লোক, যাকে সবাই ডাকে দ্য ফাদার, তার নির্দেশে ঘটে চলেছে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো সব ঘটনা। নরকের উপস্থিতি যেন একেবারে সামনে থেকে অনুভূত হচ্ছে।
বাস্কিন তার তিন অঙ্কে তিন জনরার মিশ্রণ ঘটায়। প্রথম অঙ্কে পুরোপুরিই অ্যাটমোস্ফিয়ারিক হরর, দ্বিতীয় অঙ্কে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার আর শেষ অঙ্কে আদ্যোপান্ত মিশে আছে গোর। দেখেই বোঝা যায়, টার্কিশ নতুন পরিচালক কান এভ্রেনল, হার্শেল গর্ডন লুইস ও লুসিও ফুলচি- ‘গডফাদার অভ গোর’ বিশেষণে খ্যাত এই দুই পরিচালক হতে নেওয়া অনুপ্রেরণা ভালোমতোই কাজে লাগিয়েছেন।
এই সিনেমার গঠনরীতিকে ‘স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন’- এমন চটকদার বাক্য দ্বারা ব্যাখ্যা করতে হয়। লাইনটা দেখেই ‘ইনসেপশন’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেটির স্পষ্ট অনুপ্রেরণা একদম শেষ দৃশ্যে চোখে পড়ে। পরাবাস্তবিক হরর থেকে তবে কি কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম জটিল এক ধাঁধায় আটকে গেল? তা যাক। সে দিক দর্শকের স্বার্থেই আরো বিস্তৃত আকারে আলোচনায় আনা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
বাস্কিনে রূপকের ছড়াছড়ি। রূপকগুলো এবং সিনেমার পরাবাস্তবিক জগতটাকে বুঝতে টার্কিশ কুসংস্কার এবং জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানাশোনা রাখা প্রয়োজন। পারস্য ধর্মগুরু জরাথ্রুস্টের নামেই এ ধর্মের নামকরণ। সেই প্রাচীনকাল হতে এখন অব্দি চর্চিত হচ্ছে জরাথ্রুস্টবাদ। স্বর্গ-নরক, ভালো-মন্দ, শেষ বিচার; এ বিষয়গুলো আছে এ ধর্মেও। সিনেমার রূপক বুঝতে তাই এ ধর্ম নিয়ে অত বিস্তৃত জ্ঞান লাগবে না, পৃষ্ঠতলীয় ধারণা আর সচেতন দৃষ্টি থাকলেই সেগুলো বুঝতে পারা যাবে। এ সিনেমাও যে পৃষ্ঠতলেই বিচরণ করেছে।
তাছাড়া তৃতীয় অঙ্কে সিনেমা যখন সেই বিকৃতি ঘটা ফাদার ফিগারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘হেলরেইজার’ সিনেমার স্পষ্ট অনুপ্রেরণা লক্ষণীয় যে চরিত্রে, তখন পুলিশদের একজনের সাথে তার দার্শনিকতায় মোড়া সংলাপগুলোই সিনেমার রূপকের অর্থটাকে অনেকখানি পরিষ্কার করে তোলে। একটা তথ্য এখানে দেওয়া ভালো। তা হলো, এই দ্য ফাদার চরিত্রের অভিনেতার চেহারা আর আকৃতি কোনো কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়ন; বরং এক বিরল অসুখই তাকে এমন করে রেখেছে। তাই তার উপস্থিতি আলাদা একটা ভীতি এমনিতেই তৈরি করে ফেলে সিনেমার পর্দায়।
সংকীর্ণ প্লট, অসম টোন আর মোটাদাগে রূপকের উপর ভর করে চলা বাস্কিনের মূল শক্তির জায়গা এর ভিজ্যুয়াল স্টাইলে। এর ইমেজারিতে। দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নারকীয় বাস্তব জগতটা বাস্তবিক রূপই পেয়েছে অস্বস্তিদায়ক ওই ইমেজারিগুলোর জন্য। ভয়ের সাথে সাথে টেনশনটাও তৈরি করতে পেরেছে সিনেমার ইমেজারি। মাংস, ব্যাঙ, বিকৃত সব শরীরকে ভয়ের উপাদান হিসেবে রেখে ক্লোজআপ শটকে আধিক্য দিয়েই বিদঘুটে অনুভূতিকে একদম গভীর থেকে জাগিয়ে তুলেছে বাস্কিন। ইমেজারিই সেই কাজটা করেছে। এবং অবশ্যই তাই প্রশংসা করতে হয় স্পেশাল ইফেক্টস, সেট ডিজাইনের। স্যাচুরেটেড কালারে, লাইটিং’য়ে আশির দশকের রেট্রো ভাইব দিয়েছে এ সিনেমা।
বাস্কিন পুরোপুরিই একটি গ্রাফিক হরর সিনেমা। একা ইমেজারির ক্ষমতাতেই যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারা যায়, অনুপ্রেরণা নেওয়া গুরু গর্ডন লুইস; লুসিও ফুলচি’দের সিনেমার ধারাতেই- তা প্রমাণ করেছে এভ্রেনলের এই সিনেমা। জনরা সিনেমাতে গেড়ে থাকা, জনরা সিনেমাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া, ভয় আর উপভোগ্যতাকে সমরেখায় আনা সিনেমা বাস্কিন।