সাফল্য কীসের হাত ধরে আসে? অবশ্যই পরিশ্রমের হাত ধরে! আচ্ছা, পরিশ্রম কীসের হাত ধরে আসে? পরিশ্রম আসে মেধার হাত ধরে। মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, কেরালার মুগ্ধতায় ঢাকা রাজ্যের মোহনীয় সিনেপাড়া। সেখানকার একজন অভিনেতার নাম মোহনলাল বিশ্বনাথ নায়ার। মেধা আর শ্রমের সম্মিলনে যিনি সাফল্য এনেছেন। চল্লিশ বছরের ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। যেখানে তাকে দেখা যায়, ভাবা যায়, কিন্তু ধরা অসম্ভব। সর্বভারতীয় চলচ্চিত্রেরই মোস্ট কমপ্লিট অ্যাক্টর মোহনলাল যেন কেরালার একটুকরো প্রশান্তি। যেন গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের সাহিত্য, হুডিনির মায়াজাল, ভ্যান গগের রংতুলির মিশেলে তৈরি জীবন্ত ভাস্কর্য!
ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ান ১৯৭৮ সালে। বন্ধুরা মিলে তৈরি করেন ‘তিরানোট্টাম’ নামের সিনেমা। তাতে কুটাপ্পা চরিত্রে অভিনয় করেন মোহনলাল। কুটাপ্পার চরিত্র ছিল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তির। প্রথম ছবিতেই ভিন্নধর্মী কিছু করার চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। সেন্সর জটিলতায় মুক্তিই পায়নি সেটি।
১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে পরিচালক ফাজিল প্রথম ছবির জন্য এক নতুন মুখ খুঁজছিল। এর আগে কখনো পরিচালনা না করা ফাজিল নিজেও ছিলেন নতুন মুখ। ‘মঞ্জিল ভিরিঞ্জা পোক্কাল’ নামক মুভিতে ভিলেনের ভূমিকায় নেন মোহনলালকে। দুর্ধর্ষ খলনায়কীতে ছাড়িয়ে যান সেই ছবির হিরো শঙ্করকেও! তারপর আর পিছু ফিরতে হয়নি। সিনেমার বক্স অফিস সাফল্য আর দক্ষ অভিনয়ের উপঢৌকন হিসেবে পরের চার বছরে একে একে ২৫টি সিনেমায় কাজ করেন মোহনলাল, যার অধিকাংশ নেতিবাচক ভূমিকায়। আলোর মুখ না দেখা তিরানোট্টাম মুভিতে সহকারী হিসেবে ছিল বন্ধু প্রিয়দর্শন। ততদিনে পরিচালনায় নাম লিখিয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে বন্ধু মোহনকে দিয়ে করিয়ে নেন কমেডি ড্রামা ‘পোচাক্করু মক্কুত্তি’, বক্স অফিসে পায় বিগ হিটের তকমা।
শুরু থেকে চলচ্চিত্রে মোহনলালের ভিত ছিল শক্ত। সেই খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করতে থাকেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সাল মোহনলালের ক্যারিয়ারে আসে বড়সড় ধামাকা। ‘৮৬-কে তার ক্যারিয়ারের মোস্ট ভ্যালুয়েবল সাল বললে ভুল বলা হবে না একরত্তিও! কী পাননি মোহনলাল সেই বছর? যেখানে হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। এক বছরে ৩৪টি সিনেমা রিলিজ করার বিশ্বরেকর্ড গড়েন। শুধু এর জন্য তাকে মনে রাখা যেত সবসময়। কিন্তু তিনি নিজেকে ভাঙা-গড়ার নেশায় মত্ত। সুপারস্টার হবার পথে একধাপ এগিয়ে যান সেই বছরই। নির্মাতা থাম্পি কান্নাথানাম ‘রাজাভিন্তে মাকান’ ছবির জন্য আরেক মালায়লাম কিংবদন্তি ম্যামুত্তিকে চুক্তিবদ্ধ করলেও শিডিউল জটিলতায় কাজ ছেড়ে দেন মেগাস্টার। তাতে নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর করেন মোহনলাল। এর পরের গল্পটুকু সোনার হরফে লিখে রাখেন তিনি। মুক্তির পর মালায়লামের অন্যতম বিগেস্ট হিটের তকমা পেয়ে যায় রাজাভিন্তে মাকান, কপালে লাগে সুপারস্টারের তকমা।
১৯৮৮ সালে বন্ধু প্রিয়দর্শনের সাথে ফের জুটি বাধেন। ‘চিত্রম’ টাইটেলের মুভিটি গড়ে বসে এক অনন্য রেকর্ড! ৩৬৫ দিন অর্থাৎ গোটা এক বছর জুড়ে কেরালার কোনো না কোনো থিয়েটারে চলেছেই এটি! সেখানকার মানুষ সাক্ষী হয় নতুন ইতিহাসের। মুভিতে সহজ-সরল বালক কিরেদামের চরিত্র রুপায়ন করে হাতে তোলেন জুড়ি বোর্ড ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। ‘৮৮-তে জুরি বোর্ড মেনশনে পুরস্কার জিতলেও সেরা অভিনেতা হিসেবে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে ‘ভারাতাম’ সিনেমার মাধ্যমে।
আট বছর বাদে ১৯৯৯ সালে আবার পান ‘ভানাপ্রস্থাম’ এর জন্য। এরপর একে একে অসংখ্য হিট ছবি উপহার দিয়ে পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো কেড়ে নেন তিনি। থুভানাথুম্বিকাল, নারোদিকাতু, আক্কারে আক্কারে আক্কারে, চন্দ্রলেখা, উড়ায়ানানানু থারাম- আরও কত কত কাজ! ‘কমেডিয়ান শ্রীনিবাস আর মোহনলালকে মুভিতে নাও, হিট নিশ্চিত’- নব্বইয়ের দশকে মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রিতে সাফল্যের টোটকা ছিল অনেকটা এমনই! এই জুটির অধিকাংশ সিনেমা পায় ইন্ডাস্ট্রি হিটের তকমা।
ভক্তরা আদর করে লালেট্টা বলে ডাকেন মোহনলালকে। লালেট্টা যেন মলিউডের (মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে মলিউড বলা হয়) বক্স অফিস মনস্টার! ছোট্ট এক ফিল্মপাড়া, যেখানে ১০ কোটিও একসময় অনেক মনে হতো। অথচ সেখান থেকে মোহনলাল বের করেছেন ১০০ কোটির সিনেমা! এতেই চোখ কপালে তুললে হবে না। পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে মলিউডের প্রথম ৫, ১০,২০, ৩০, ৫০, ১০০ কোটি আয় করা সবগুলো মুভির অভিনেতা একজনই- মোহনলাল বিশ্বনাথ!
একটা ছোট তথ্য দিয়ে তার জনপ্রিয়তাকে জাহির করা যাক। শুধু ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমা বাহুবলি ২, সেটি কারো অজানা নয়। ভারতের প্রায় সব রাজ্যের সমস্ত রেকর্ড চুরমার করে প্রভাষের ছবিটি। কিন্তু অক্ষত থাকে কেরালার রেকর্ড, যেটি যথারীতি মোহনলালের দখলে। কেরালার সর্বোচ্চ ১৬৫ কোটি রূপি আয় করা ‘পুলি’কে টপকাতে পারেনি বাহুবলি। তেলেগুতে জনতা গ্যারেজ নামে ছবিতে এনটিআর জুনিয়রের সঙ্গে জুটি বাধেন লালেট্টা। বক্স অফিসে ১০০ কোটি ছাড়ায় সেটি। অর্জনের মুকুটে যুক্ত হয় দারুণ এক পালক। একমাত্র মলিউড অভিনেতা হিসেবে মালায়লাম এবং তেলেগু দুই জায়গায় ১০০ কোটি আয় করা ছবি রয়েছে তার ঝুলিতে।
২০০০ সালে ‘নারশিমা’ সিনেমা দিয়ে মলিউডে নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যান। শাজি কৈলাসের নির্মাণে সেই মুভি বক্স অফিস ভেঙে-চুরে দেয়। লালেট্টা বনে যান সুপার হিউম্যান। কিন্তু খুব বেশিই হয়তো উপরে উঠে গিয়েছিলেন। ভক্তদের আশার পারদ চড়তে শুরু করে তরতরিয়ে। হঠাৎ করে টানা ফ্লপ যেতে থাকে মুভি। প্রজা, ওনামাম, থান্ডাভামের পর পর ব্যর্থতায় কমতে থাকে খ্যাতি। উত্থান যেখানে আছে, পতনের গল্পও থাকবে সেখানে।
কেরালা রাজ্যের ইলানথুর গ্রামে ১৯৬০ সালের ২১ মে জন্ম নেওয়া কমপ্লিট অ্যাক্টর খ্যাত মোহনলাল ভেঙে পড়েননি। যিনি ভিলেন থেকে শুরু করে অ্যাকশন, কমেডি, রোমান্টিক, এক্সপেরিমেন্টাল ক্যারেক্টার সবকিছুতে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন এমন একজন মানুষের ফেরা সময়ের ব্যাপার। ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে থানমাত্রা এবং পরদেশি মুভির জন্য মালায়লাম ফিল্মফেয়ার জিতে অলক্ষ্যে জানান দেন ফুরিয়ে যাননি। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দৃশ্যম’ দিয়ে এমনভাবে ফিরেছেন, হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিল গোটা ভারত!
ফিল্মফেয়ার, নন্দী, স্টেট অ্যাওয়ার্ড, কেরালা ফিল্ম সোসাইটির পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননাসহ অজস্র স্মারক বাগানো লালেট্টার বয়স ষাট ছাড়িয়েছে। পুত্র প্রণব মোহনলালের অভিষেক হয়েছে সিনেমায়। ‘আধি’ নামের সেই ছবিতে দারুণ স্ট্যান্টবাজি দেখায় সে! বুঝিয়েছে শরীরে কার রক্ত! লালেট্টার বয়স যত বাড়ছে, ততই পরিণত হচ্ছেন, সমৃদ্ধ হচ্ছে অর্জনের ভান্ডার। মলিউডকে এখন সমীহের চোখে দেখে সবাই, যার কৃতিত্বের অনেকখানি মোহনলালের। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত সরগরম থাকে লালেট্টার নিত্যনতুন লুক, চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্য।
একটা বয়সে ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার। হয়ে ওঠেনি। হলে হয়তো পাওয়া হতো না এমন সব্যসাচী অভিনেতাকে। ফের মাথাচাড়া দেয় পুরনো খায়েশ। ভারতীয় সেনা দপ্তর বরাবর আবেদন করেন। তারা সাদরে গ্রহণ করে দেশের এমন রত্নকে। বিশেষ প্রশিক্ষণের পর প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০০৯ সালে তাকে দেওয়া হয় সম্মানসূচক কর্নেল উপাধি। ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে তায়কোয়ান্দোর সদর দপ্তরে সম্মেলন অনুষ্ঠানে তায়কোয়ান্দোতে ব্ল্যাক বেল্ট প্রদান করা হয় মোহনলালকে। যা এর আগে অভিনেতা হিসেবে পেয়েছিলেন কেবল শাহরুখ খান। ২০০১ সালে ভারতের চতুর্থ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী এবং ২০১৯ এ তৃতীয় সম্মান পদ্মভূষণ লাভ করা মোহনলাল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী হিসেবে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দুবাইয়ে রেস্টুরেন্ট কিংবা কেরালার বিশিষ্ট মশলা ব্যবসায়ী হিসেবে লালেট্টা পৌঁছেছেন খ্যাতির শিখরে।
চার দশকে ৩৪১টি সিনেমা, ২০টি ব্লকবাস্টার উপহার দেওয়া মোহনলাল বলিউডে ২০০২ সালে জুটি বাধেন রাম গোপাল ভার্মার সঙ্গে ‘কোম্পানি’ সিনেমায়। সেখানে ঠান্ডা মাথায় একটি সংলাপ ছাড়েন, “পুলিশ সবসময় নিয়মের ভেতরে থেকে কাজ করে, এই কথা কে বলেছে?” সেই সংলাপের মতো মোহনলালও নিয়মে বাঁধা ছকে চলেননি। চলেননি বলেই হয়তো আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছেন! পরিচালক রাম গোপাল ভার্মা একবার বলেছিলেন, “কাজ দিয়ে যদি ডিরেক্টরদের শতভাগ খুশি কেউ করতে পারে সেটি মোহনলাল।” মাস্টারমেকার মনি রত্নম তো জানিয়ে দিয়েছেন, “তার সঙ্গে কাজ করতে গেলে আমি কাট বলতে ভুলে যাই।” তামিল সুপারস্টার রজনীকান্ত বলেন, “তিনি এমন কিছু চরিত্র করেছেন, যেগুলো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না!”
তবে সবাইকে ছাপিয়ে অমিতাভ বচ্চনই হয়তো বলেছেন সবার না বলা কথা, “তিনি চমৎকার অভিনেতা!“