সূর্যকন্যা: আশির দশকের এক চিন্তাশীল নির্মাণ

সময়টা ১৯৭৬ সাল। দেশ কেবল স্বাধীন হলো। অর্থনীতির চাকা ভঙ্গুরপ্রায়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। চারদিকে বিরাজ করছে অস্থিরতা। ঠিক সেরকম একটি সময়ে চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভাব ঘটে সূর্যকন্যার। দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই ‘সূর্যকন্যা’ ছিল বছরের পর বছর বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার এক মৌন প্রতিবাদ, যেখানে পরিচালক আলমগীর কবির যুগ যুগ ধরে নারীদের প্রতি সমাজের দমন, নিপীড়ন, নির্যাতন ও প্রভুত্বের জীবন্ত চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।

পরিচালক আলমগীর কবির; Image Source: Cultural Yard

ড. নাদির জুনাইদ তার ‘প্রতিবাদের নান্দনিকতা ও প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র’ বইয়ে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীর নতুনত্ব: আলমগীর কবীরের সূর্যকন্যা (১৯৭৬) ও রুপালী সৈকত (১৯৭৯)’ নামক লেখায় এভাবে বলেছেন,

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের কর্তৃত্ব চর্চার মধ্যে যে অন্যায় টিকে আছে, সূর্যকন্যা তার বিরুদ্ধেই হয়ে ওঠে প্রতিবাদ।

সিনেমায় প্রধান চারটি চরিত্র; ‘মিস ক্যালকাটা’ উপাধিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়শ্রী কবির, বুলবুল আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, সুমিতা দেবী, রাজশ্রী বোস প্রমুখ চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা অভিনয় করেছেন।   

সিনেমার অন্যতম প্রধান চরিত্র লেনিন (বুলবুল আহমেদ) একজন কল্পনাবিলাসী চিত্রশিল্পী। যদিও বাবার (গোলাম মোস্তফা) ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু উদারমনা লেনিন পড়েছে আর্ট নিয়ে। তার স্বপ্ন চিত্রকর্ম দিয়ে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয়ার, সকল অন্যায় অবিচার ধুয়ে এক নতুন পৃথিবীকে রঙ-তুলির আবরণে সাজিয়ে দেয়ার। যেখানে বিরাজ করবে শুধু শান্তি আর ভালোবাসা। কল্পনাবিলাসী এই লেনিন নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করে নেয় তার কল্পনার ভেতর দিয়ে। সে স্বপ্ন দেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। কল্পনায় সে অপরাধীকে পেটায়ও। কিন্তু বাস্তবে সাহস হয়ে ওঠে না তার। তাই নিজের সর্বস্ব দিয়েই সাহায্য করে যায় অসহায়দের।

কল্পনায় লেনিন রেসকোর্সের মাঠে গিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। সেই ভাষণে লেনিন দারিদ্র্যকে চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার কথা বলে, যা আর কিছু নয়, তার অবচেতন মনে বাসা বাধা সাম্যবাদী লেনিনের আদর্শকেই নির্দেশ করে। এই লেনিনের কল্পনায় বিরাজ করা ‘লাবণ্য’ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে পরিচালক নির্মম পুরুষতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন সিনেমাটিতে।

পরিবারে বাবার গঞ্জনা এবং ডাক্তারি পড়া ছোট ভাইয়ের হেয় দৃষ্টির শিকার এই লেনিনকে উঠতে-বসতে কথা শুনতে হয় তার বেকারত্ব নিয়ে। আর এ গ্লানি তাকে আবার কল্পনায় নিয়ে যায়, যেখানে সে তার সবগুলো চিত্রকর্ম বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা মায়ের হাতে তুলে দেয়। লেনিনের অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার বিষয়টি ছোটখাট জিনিসের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে; বড় ভাইরা যেখানে ছোট বোনদের কড়া নজরদারি এবং আগলে রাখার নামে আটকে রাখতে চায়, লেনিন সেখানে ছোট বোনের প্রেমিকের চিঠি পৌঁছে দেয়।

প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারা লেনিন চলচ্চিত্রের একপর্যায়ে এক নারীর প্রেমে পড়ে। তার কল্পনায় সে নারী হয়ে ধরা দিলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল এক মূর্তি। তার নাম লেনিন ‘লাবণ্য’ দেয়। লাবণ্য, অর্থাৎ মূর্তিটির মাধ্যমেই পরিচালক আলমগীর কবীর পুরুষতন্ত্রের ক্ষত তুলে ধরে নারীমুক্তির কথা বলে যান।

এই মূর্তিটিই নারী হয়ে ধরা দেয় লেনিনের কল্পনায়; Image Source: cloudfront.net.media  

বিভিন্ন দৃশ্যে লেনিন লাবণ্যকে (রাজশ্রী বোস) ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কখনো নৌকায় চড়ে, কখনো সমুদ্রের পাড়ে, কখনো আবার মাঠে-প্রান্তরে। লাবণ্য-লেনিনের গল্পে উঠে আসে সেই সৃষ্টির শুরু থেকে নারীর ইতিহাস। নারী-পুরুষের অধিকারের গল্প। এ গল্পের সংলাপে পরিচালক নারীর স্বাধীনতার কথা বলেছেন। পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালে নারী কী করে কুড়ে কুড়ে মরছে, তা দেখিয়েছেন।

“আমাদের তো ভোরের আলো দেখবার অধিকার নেই।”

লাবণ্যের এ কথাটি দিয়ে মূলত বোঝানো হয়েছে, নারীরা এখনও পুরুষের বেড়াজালে ঘরের অন্ধকারে বন্দী। সে সময়ের নারীরা শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, কর্ম, সামাজিক, রাজনৈতিক সবদিক থেকে পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। বাইরের পৃথিবী দেখবার অধিকার তাদের ছিল না। তাই সে বলে,

“আমরা কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র; ভোগের সামগ্রী।”

সিনেমার একপর্যায়ে লাবণ্যকে একটি পুরনো জমিদার বাড়িতে দেখা যায়। যেখানে সে তাদের আদি পরিচয় যে সূর্যকন্যা, তা বলতে থাকে। আগে তারা স্বাধীন ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে পুরুষ তাদেরকে বন্দী এক পুতুল, ভোগের সামগ্রী করে রেখেছে। পুরনো জরাজীর্ণ ঐ ইট-পাথরের দালান যেন লাবণ্য তথা নারীর বন্দিত্ব এবং অন্ধকার জীবনেরই ইশারা দিচ্ছিল।

লেনিন, মনিকা এবং রাসেল; Image Source: canvasmegazin.com 

সিনেমার আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো মনিকা এবং রাসেল। রাসেল চরিত্রটি ঠিক যেন লেনিনের বিপরীত। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ধারণকারী রাসেলের কাছে নারী মানেই ভোগ্যপণ্য এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। এমনকি তার সংলাপে এটাও স্পষ্ট যে, স্ত্রীর মর্যাদা পাওয়াই একজন নারীর জন্য অনেক বড় এবং যথেষ্ট একটি প্রাপ্য। কিন্তু তার প্রেমিকা মনিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। স্বাধীন, দৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ী একটি চরিত্র ‘মনিকা’। সামাজিক, চারিত্রিক, অর্থনৈতিক, মানসিক সবদিক থেকেই স্বনির্ভর এবং নারীবাদী এই মনিকা চরিত্র দিয়েই হয়তো পরিচালক নারীর চারিত্রিক দৃঢ়তাকে বোঝাতে চেয়েছেন সমাজের কাছে। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে যথেষ্ট অপমানিত হয়েও মনিকা ভালোবাসার খাতিরে সেই অপমান মেনে নেয়নি, বরং দৃঢ় এবং শক্ত থেকে এর নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে।

আত্মসম্মানে আঘাত লাগে বলে সে যখন রাসেলের দোকানের চাকরিটা ছেড়ে দেয়, রাসেল তখন ক্ষতিপূরণ বাবদ মনিকার কাছে টাকা পাঠায়। এতে মনিকা চরমভাবে অপমানিত বোধ করে এবং সেই টাকা ফিরিয়ে দেয়। নীরবে সয়ে অন্য পুরুষকে বিয়ে করে সুখী হওয়ার চেষ্টা না করে সে দেশের বাইরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, যা তার চরিত্রের দৃঢ়তা এবং বলিষ্ঠতাকেই তুলে ধরে। মনিকার কাছে বিয়েটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। কারণ কোনো পুরুষ নয়, সে নিজেই নিজের অবলম্বন। পরিচালক এই চরিত্র দিয়ে নারী যে কোনো ভোগের সামগ্রী নয় এবং অর্থলোভে পড়ে থাকা দাসীও নয়, তা দেখিয়েছেন।

চলচ্চিত্রটির অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর গান নির্বাচন। বিখ্যাত বাংলা গান- ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ এবং একটি ইংরেজী গান ‘অন আ নাইট লাইক দিস’ এবং ‘আমি যে আঁধারের বন্দিনী’ এই তিনটি গান ব্যবহার করা হয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘আমি যে আঁধারের বন্দিনী’ গানটি নারী মুক্তির গান। নারীর চিন্তা-চেতনা এবং হাত পায়ের শেকল ভেঙে মুক্তির প্রার্থনা চেয়েই গানটি রচিত, যা ১০৮ মিনিটের এই চলচ্চিত্রের মূল বার্তাটিকে তুলে ধরে।

সূর্যকন্যা – দ্য ডটার অব সান; নারীমুক্তি নিয়ে তৈরি এই চলচ্চিত্র ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায়, যা সেই সময়ের জন্য সত্যিই সাহসের বিষয় ছিল। শুধু সাহস নয়, দর্শকের কাছে নারীদের মুক্তির বার্তা পৌঁছানোর এই চেষ্টাটুকু সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এছাড়া পরিচালক এখানে একটু ভিন্ন উপাদান ‘অ্যানিমেশন’ যোগ করেন, যে বিষয়টি তৎকালীন বাংলা সিনেমাতে একপ্রকার দুর্লভই ছিল।

অ্যানিমেশনের ব্যবহার; Image Source: Roar Media

তবে সিনেমার শেষাংশটুকু দেখে বোঝা যাবে, পরিচালক ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। কিছুটা অসংলগ্নতা এবং অবাস্তবিক বিষয় চলে এসেছে শেষে। হয়তো সেন্সরশিপ এড়াতেই সমাপ্তির অংশে কিছুটা অবাস্তবতা এনেছেন। সিনেমাটি নারীবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরোধী বলে বিজ্ঞজনদের সুনাম অর্জন করলেও ‘সূর্যকন্যা’ আরো কঠোর হয়ে ধরা দিতে পারত, যদি লাবণ্য চরিত্রটি কাল্পনিক না হয়ে বাস্তব হতো। কিন্তু কেন পরিচালক এ কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, তার পেছনে কারণ হিসেবে ড. নাদির জুনাইদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা ব্যবস্থায় সরাসরি সমালোচনা হয়তো সে সমাজে কঠিন যেখানে ক্ষমতাশালীরা পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত নয় (জুনাইদ, ২০১৭; পৃ। ৪৫-৪৬)। এই গবেষকের মতে, সেন্সরের বাধা কাটাতে পরিচালক এখানে সুচিন্তিতভাবে ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়েছেন।

This article is in Bengali language. It is a review of the film 'Surjo Konna'.

References are included in the article.

Featured Image: Bdnews24.com

Related Articles

Exit mobile version