পাহাড়িকা বাসে চেপে গল্পের প্রধান চরিত্র সমর আর শান্তিপ্রিয়ার প্রবেশ। সমর, যার মানে যুদ্ধ, আর তারই একটু একটু পছন্দের পাত্রী শান্তিপ্রিয়া, রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসছে। অর্থাৎ টলস্টয়ের যুদ্ধ আর শান্তি পাশাপাশি বসে আলোচ্য উপন্যাসে প্রবেশ করে।
এই দৃশ্যপটটি যতক্ষণে পাঠক বুঝতে পারে ততক্ষণে এটাও পরিষ্কার হয় যে, কিছু কিছু শব্দের বানান লেখক একেবারে নিজের করে নিচ্ছেন। ফলত, বইয়ের বাইরে মন দিতে গেলে তার বেগ পেতে হয়। যেমন, চোখের সামনে ‘এতো’ কথাটা হয়ে ওঠে ‘অ্যাতো’, ‘কেমন’ কথাটি হয়ে যায় ‘ক্যামন’।
পিঁপড়ের মতো এই অসংখ্য কালো অক্ষর অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে তৈরি করে একবিংশ শতাব্দীর নিরেট চিত্র। তাই পাঠক ধীরে ধীরে সতর্ক হয়ে ওঠে। ভাবতে চেষ্টা করে, লেখকের বর্ণিত সমস্ত ঘটনার সঙ্গে তার পরিচয় আছে কি নেই।
লেখক তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড় সমরের ভাবনার মাধ্যমে আমাদের নিয়ে চলেন রাঙামাটি। লাল পাহাড়ের যে ইতিহাস আমরা কখনো স্পর্শ করতে চাইনি, যা নিয়ে আমাদের ভাবনার তেমন কোন অবকাশ ছিল না, সেই গহীন অরণ্যের ইতিহাস সম্বলিত নানা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন লেখক।এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গেলে ইতিহাসের পাতা থেকে বিভিন্ন চরিত্র আমাদের সামনে এসে আত্মপ্রকাশ করেন।
লেখক কেবল অক্ষরের পর অক্ষর বুনেই ক্ষান্ত হতে চাননি। চেয়েছেন লেখার ভেতর শব্দের অধিক কিছু রেখে যেতে। তাই আমরা যেমন একদিকে দেখি টাকা ছড়ানো ফুটবল, ম্যাচ ফিক্সিং আর পলিটিক্স। ঠিক তেমনি অন্যদিকে দেখি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইতিহাস। যেখানে মঞ্জু এক টুকরো মাটি কাগজে মুড়িয়ে তার দিদির হাতে দিয়ে অনুরোধ করে, ‘দি, গমে থোচ! এ মাদিয়ানর ভালত্তমান দাম আগে সি।’
তার দিদি অবাক হয়, এই মাটির দলার আবার কী দাম আছে! অথচ দুদিন পর দেখা যায়, কাপ্তাই বাঁধের পানিতে তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা সমস্ত ডুবে গেছে। কিন্তু যত্নে রাখা ঐ একটুকরো মাটির দলা ডোবেনি।
লেখকের পারদর্শিতা প্রকাশ পায় তার শব্দের দখলে, তার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে আর ঘটনার নিখুঁত বর্ণনায়। ইতিহাস আশ্রিত বই হাতে নিয়ে যখন টানটান উত্তেজনার খেলা উপভোগ করা যায়, তখন লেখককে বাহবা না দিয়ে আর উপায় থাকে না।
তবে বইয়ের ১৫ নং অধ্যায়ে সামান্য বিচ্ছিন্ন লাগে। যদিও পুরো বইতেই কোন শিরোনামের আশ্রয় নেননি লেখক। কিন্তু মনে হলো, এই অধ্যায়ের কৌশল যেন বারবার শিরোনামের দ্বারস্থ হতে বলছে। নয়তো কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উপস্থিতি কেমন খাপছাড়া লাগে। অপেক্ষায় থাকতে হয়, কখন অন্য আর কোন ব্যক্তির প্রসঙ্গ চলে আসে। তবে বুঝতে সময় লাগে না, যে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি বর্তমান প্রেক্ষিত’ প্রজেক্টে কর্মরত আরিফকে নয়, এ অধ্যায়টি মূলত পাঠককেই অবগত করছেন লেখক।
বইয়ের পাতা উলটে যেতে যেতে আমরা উপলব্ধি করছি এর গুরুত্ব। আমাদের সময় এবং তরুণ সমাজের মানসিকতা কী দারুণ জেনে নিয়েছেন লেখক! সমাজের প্রায় প্রতিটা ঘুণে ধরা প্রসঙ্গকে তিনি স্পর্শ করে গেছেন। কখনো কখনো চরিত্রের মুখে চলে এসেছে সমাজের নিপাট চিত্র। তারা বলছে, “বাংলাদেশ হইল ইস্যুর দেশ, ফলোআপ এইখানে চলে না।”
আবার বলছে, “জ্ঞান নয়, মেধা নয়, গলা যার যত বড়- সে’ই আজকের তারকা।”
ধারণা করি, আগামী প্রজন্ম এ বইয়ের মাধ্যমে আমাদের সময়কে জানবে। জানবে কী দারুণ দুর্দিন আমরা পার করেছি।
লেখক সুহান রিজওয়ানের একটানা গদ্য বলে দেয় যে, তার লেখা সচেতন পাঠক চায়। আর ঐ পাঠক যে তার হবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা দুটিমাত্র বই তার, অথচ সময়ের ব্যবধান বেশ দীর্ঘ। নিজের পরিশ্রমে যেন নিজেকেই তিনি ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। বই পড়তে পড়তে বুঝি উপন্যাসের পটভূমিতে যাতায়াত করেছেন লেখক। আর সে ভাষা নিজেও রপ্ত করেছেন।
স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তবে মনে হয় বহু আগে, এরকম এক অঞ্চল নিয়েই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন। বেশ কয়েক দফা তিনি সেদিকে গিয়েওছিলেন। কিন্তু তার সে কাজ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। নয়তো বাংলা সাহিত্য নিশ্চয় তৃতীয় কোন মহাকাব্যের স্বাদ পেতে পারতো।
যাই হোক, আমাদের সময়ের লেখক সুহান রিজওয়ান, যিনি এ বইতে এমন কিছু প্রশ্ন আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন, যেসব প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজতে গিয়ে ক্রমে আমাদের পদতলে চমকে ওঠে মাটি।
বইয়ের নাম: পদতলে চমকায় মাটি || লেখক: সুহান রিজওয়ান
প্রকাশনা: ঐতিহ্য প্রকাশনী || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম