জহির রায়হানকে স্মরণ করলে প্রথমেই এই কথাটাই মনে আসবে, জহির রায়হান একজন দ্যুতিময় আলোক বিচ্ছুরণ। তার জন্ম ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ফেনী জেলায়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লেখক জহির রায়হান ছিলেন ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার ও কথাসাহিত্যিক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যাদের হারিয়ে মেধাশূন্য হয়েছিল তাদের মধ্যে জহির রায়হান অন্যতম। তার লিখনশৈলী অমাদেরকে বাধ্য করে সমাজের কুসংস্কার,অন্যায় শোষণ, বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, অর্থ লোভে বিবাহ, বহুগামিতার পরিণতি উপলব্ধি করতে।
তার লেখা বরফ গলা নদী, কাঁচের দেয়াল, আরেক ফাল্গুন, হাজার বছর ধরে, একুশের গল্প যেন বারবার হাহাকার তুলতে বাধ্য পাঠক হৃদয়ে। ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে তিনি নিগার সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে ডকুমেন্টারি তৈরি করে একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা পুরো পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বকে জানান দিয়েছিল। উনার সব সৃষ্টিই যেন অমর, তবুও পাঠক এবং সিনেমাপ্রেমী হিসেবে এখানে উনার তিনটি অমর সৃষ্টি নিয়ে লিখতে চাই।
জীবন থেকে নেয়া
‘জীবন থেকে নেয়া’ তার এক অমর সৃষ্টি। ১৯৭০ সালে এর ১০ এপ্রিল এটি মুক্তি পায়। চিত্রায়নের পর কলকাতায় তিনি কয়েকটি প্রদর্শনী করিয়েছিলেন। প্রদর্শনীতে প্রাপ্ত অর্থ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে দান করেছিলেন। তার অনবদ্য চলচ্চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন অস্কার বিজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এছাড়াও মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক সহ অন্যান্য প্রথম সারির পরিচালকরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন এই চলচ্চিত্র দেখে।
এই চলচ্চিত্র যেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য নথি। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের শাসনকালের নিপীড়নের প্রেক্ষাপট এতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এর সাথে আড়াআড়িভাবে সংসারে একতরফা আধিপত্য বিস্তার কেমন করে নির্মমভাবে একটা সুন্দর পরিবার ও আত্মিক সম্পর্ক বিচূর্ণ করে তার প্রতিফলনও দেখিয়েছিলেন।
চলচ্চিত্রে মূল গল্পে দেখানো হয় ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার প্রতিবাদের কারণে অভিনেতা আনোয়ার হোসেন কারাগারে বেশিরভাগ জীবন-যাপন করেন। সেখানে বজ্র কণ্ঠের প্রতিবাদের গান, কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদির, কয়েদিরা গেয়ে উঠেন ঝাঁঝালো কণ্ঠে! এই গান আরেক কিংবদন্তি খান আতাউর রহমানের বজ্র কণ্ঠে গাওয়া যা কিনা মানুষের রক্ত কণায় হোলিখেলা তুলতে বাধ্য। সিনেমায় অভিনেত্রী রওশন জামিলের অভিনয় ছিল যেন স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের শাসনের প্রতিচ্ছবি।
চলচ্চিত্রে রওশন জামিলের ২ ভাই তার অমতে ভালোবেসে বিয়ে করে আনোয়ার হোসেনের দুই বোন সাথী ও বিথীকে। যারা সংসার জীবনে প্রবেশ করার পর ননদ প্রতিনিয়ত আসামী, খুনির বোন বলে তাদের সম্বোধন করতেন। এছাড়াও যৌতুক বা কোনো উপহার না পাওয়ায় তাদের মানসিক নির্যাতন করতেন। সারাদিন রান্নাঘরে তাদের হাড় খাটুনি কাজের পরেও তাদের, বিশেষ করে ছোট ভাইয়ের বউকে তিনি পেট পুরে খেতে দিতে চাইতেন না। এ যেন চিরাচরিত আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি। সিনেমায় তার কাপড়ের আঁচলে চাবি নিয়ে ঘুরাঘুরি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানুষ তার ক্ষমতাকে একচেটিয়াভাবেই দখল করতে চায়!
সিনেপর্দায় রওশন জামিল সন্তানহীন ছিলেন তাই যখন তিনি বুঝতে পারলেন তার ভাইয়ের সহধর্মিণীরা মা হতে চলেছেন, সেই ব্যাপারটি তার ভেতরের পশুত্বকে জাগিয়ে তোলে। তাদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা যেন আর শেষ হবার নয়। সিনেমায় দুই বোনের একই হাসপাতালে বাচ্চা প্রসব হওয়ার পরে বড় বোনের সন্তানটা মৃত বলে ঘোষণা করে ডাক্তার। তখন ছোট ভাই তার বড় ভাইয়ের কষ্ট দেখে স্ত্রীকে না জানিয়ে বড় ভাই-ভাবীকে সন্তান দিতে একটুও কুণ্ঠিত বোধ করেননি কিংবা তার স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি!
পরিচালক জহির রায়হান রূপালী পর্দায় একজন মায়ের সন্তানকে তার কাছে না পাওয়ার যে আকুতি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা সত্যিই অনবদ্য। নারীরা তাদের স্বামী-সন্তানকে অন্য কারো দখলে কখনও দিতে পারেনি; এ যেন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। বড় বোন সাথী যখন দেখতো ছোট বোন বিথী বাচ্চাকে চুরি করে কোলে নিতো তখন বলেছিল, তুই আমার মেয়েকে কি করেছিস বল? ওর গায়ে এত জ্বর কেন! তার মেয়ের ছায়া মাড়ালেও সে ছোট বোনকে বিষ পান করিয়ে মেরে ফেলবে এই সংলাপটা যেন নারী হৃদয়ের সংবেদনশীলতা ও হারিয়ে ফেলার ভয়কে পুঁজি করে তোলে! বোনের সেই কথার তীর বল্লমের আঘাতে বিথী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সেই সুযোগে বিষ মেশানো জল নিজের পিতলের গ্লাসে রেখে যান রওশন জামিল।
উনি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন স্থানে গ্লাসটি রাখেন যাতে বড় বোন চোখের সামনে এসে দেখে সেটি নিয়ে ছুটে যান বোনের মুখে জল দিতে! বিথীকে জল পান করানোর পরে সে তার বোনের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে উঠে আপা তুই আমাকে এ কি খাওয়ালি? আমার বুকের ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে! পরে ঘটনাক্রমে হাসপাতালে নেওয়ার পর বিথী সুস্থ হয়ে উঠেন কিন্তু ততদিনে ছোট বোনকে হত্যার চেষ্টায় বড় বোন সাথীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। আদালতে আসামী পক্ষের উকিল হিসেব লড়ে যান রওশন জামিলের স্বামী খান আতাউর রহমান।
পরবর্তীতে স্ত্রীর মুখ থেকেই উনি বের করেন যে এক ঢিলে দুই বোনকে মারার জন্যেই এই ষড়যন্ত্র করেছিলেন রওশন জামিল। মামলার রায়ের দিন খান আতাউর রহমানের দিকে পরাজয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রওশন জামিল বলেছিলেন, “জানলে তোমাকেই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতাম।” এ যেন প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হওয়া মানুষের প্রলাপ! তারপরে ছোট ভাইয়ের বউকে বিষ পানে হত্যা করিয়ে বড় ভাইয়ের বউকে ফাঁসানোর চেষ্টায় সিনেমায় রওশন জামিলের কারাভোগের জীবন দেখানো হয়। উনার স্বামী তখন তাকে বলেন, তুমি তোমার পাপের ফল ভোগ করবে!
স্বৈরাচারী হিসেবে দেখানো রওশন জামিল নিঃসন্তান ছিলেন। তাই হয়তো তিনি কারো সুখের সংসার সহ্য করতে পারতেন না। সিনেমার শেষভাগে দীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তি পায় লড়াকু আনোয়ার হোসেন। ছোট বোনের মেয়েকে কোলে তুলে বলেন- নাম হবে ‘মুক্তি’।
একই গল্পের পটভূমিতে মানুষের জীবনের নিবিড় সত্যগুলো ফুটিয়ে তুলে জীবন থেকে নেওয়া নামটা যেন বাংলার চিরাচরিত মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিচ্ছবি আর ভাষা আন্দোলনের অকাট্য নথি। এ সিনেমার জন্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন জহির রায়হান। তিনি ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করেছেন । মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয় (মরণোত্তর)। এছাড়াও তিনি মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যে।
একুশের গল্প
জহির রায়হানের আরেক অমর সৃষ্টি ‘একুশের গল্প’। এই গল্পের তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকা তপু আর রেণু ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু সংসার নামক জীবনে প্রবেশের আগেই হারিয়ে যায় তপু। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজপথে মিছিলে থাকা অবস্থায় তপু পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিখোঁজ হয়।
তপু ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র। তার হোস্টেল জীবনে সে সকাল বেলা রং চা বানিয়ে বন্ধুদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতো। সবাই রং চা খেয়ে তপুর ভূয়সী প্রশংসা করতো। নিখোঁজ হবার পর পুত্র শোকে তপুর মা ইহলোক ত্যাগ করেন। সেই ঘটনার দেড় বছর পরে চতুর্থ বর্ষে বন্ধুরা কঙ্কালতন্ত্র নিয়ে পড়তে গিয়ে একটি কঙ্কালের ডান পায়ের চেয়ে বাম পায়ের উচ্চতা ছোট দেখতে পান। তখন এক বীভৎস সত্য তাদের মনে পড়ে। তপুর এক পা আরেক পায়ের চেয়ে ছোট ছিল। তার কঙ্কাল ভেবে বন্ধুরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। তাদের বন্ধুদের একজন রেণুকে খুঁজে বেড়ায়। ভাগ্যক্রমে রেণুর সাথে কোনো এক পথের মোড়ে দেখা হয় তার। রেণুর বেশভূষা দেখে বন্ধুর বুঝতে একটুও দেরি হয়নি রেণু আবার সংসার নামক খেলাঘর গড়ে তুলেছে। রেণুর জীবনে অন্য কারো উপস্থিতি তপুর বন্ধুকে বিদগ্ধ করে।
তবে সে পরে বুঝতে পারে ভালোবাসা রং বদলায়, সবকিছুই একসময় নিষ্প্রভ হয়, নতুন কারো জন্যেও ভালোবাসা হয় এই প্রেক্ষাপট আমাদের পাঠককে অবচেতনে মনে করিয়ে দেয় আজকে যিনি জীবিত কালকে তিনি মারা গেলে লাশ! পাঠক হিসেবে তবুও কেন জানি মনে হয় তপু বেঁচে থাকলে রেণু তপুর একটা সুখের সংসার হতো। সেখানে ভালোবাসা থাকতো, রাগ-অনুরাগ হতো। রাগ ভাঙাতে তপু পলাশীর মোড় থেকে বেলি ফুলের মালা নিয়ে ঘরে আসতো! আর রেণু চিরকুট দিয়ে তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো।
তাদের ভালোবাসা অন্যদেরকে ঈর্ষান্বিত করতো, অনুপ্রাণিত করতো! জহির রায়হান ছাড়া আর কেউ কি পারবে পাঠকের হৃদয়ে এমন মানসিক অন্তর্দ্বন্দের ঝড় তুলতে?
হাজার বছর ধরে (Symphony of Agony)
এই উপন্যাসে প্রত্যেকটা চরিত্রই সমাজের পরিচিত মানুষের জীবনের পটভূমি। শুরুতেই মকবুল বুড়োর পূর্বপুরুষের কাহিনী দিয়ে শুরু হয় কাশিম সিকদার ও তার স্ত্রীকে নিয়ে যারা নিঃসন্তান দম্পতি ছিলেন। স্বামীর সুখের কথা ভেবে সতীন নিয়ে আসে। স্বামীর বিয়ের দিন রাতে ধুতুরা ফুলের বীজ খেয়ে তিনি জীবন নাশ করেন। এ যেন ভালোবাসার ভাগ দিতে না পারার পরাজয়ের গ্লানি। দ্বিতীয় বউয়ের সংসারে সন্তান সন্ততি আসে তাদের বংশধর হিসেবে মকবুল বুড়ো সে বাড়িতে এখন কর্তা। মকবুল বুড়োর তিন স্ত্রী- আমেনা, ফাতেমা আর টুনি। আছে এক মেয়ে হীরণ।
মকবুল বুড়োর ভাষ্যমতে দ্বিতীয় বউয়ের পেটের রোগ (ডায়রিয়া) থাকে, তাই বছরে ৬ মাস সে বাপের বাড়িতেই কাটায়। কাজ করতে না পারলে বসে বসে খাওয়ানোর কোনো মানে হয় না। মকবুল বুড়োর এক কন্যা সন্তান, তার নাম হীরণ। গল্পে হীরণ ১২ বছরের কিশোরী। তার সাথে অপূর্ব সখ্য থাকে মকবুল বুড়োর চপলা চঞ্চলা ১৫ বছরের স্ত্রী টুনির সাথে।
টুনিকে এই উপন্যাসের নায়িকা বলা যায়। কিন্তু মকবুল বুড়োর জীবনে না! মকবুল বুড়োর চাচাতো ভাই মন্তুর সাথে তার মন-ঘটিত ব্যাপারটা পাঠকের চোখে আঁচড় দেওয়া স্বাভাবিক। মন্তু টুনি রাতের শেষ ভাগে শাপলা তুলতে যায় সেখানে টুনির উচ্চস্বরে হাসির জবাবে মন্তু বলে, “আস্তে হাসতে পারছ না”।
তাদের এই বহু প্রেমের আরেকটা বড় কারণ মকবুল বুড়োর সাথে টুনির বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি, প্রায় ৪৫ বছর। সেই বাড়িতে ৮টি ঘরের একটিতে থাকে আবুল মিয়া। তার গল্প যেকোনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে। প্রথম স্ত্রী আয়েশাকে সে মারধর করতো পাষণ্ডের মতো। একদিন রক্ত বমি করে আয়েশার মৃত্যু হয়। এরপর স্ত্রীর কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করে আয়েশাকে ভুলতে না পারার ব্রত করে। কিন্তু পরে সে আরো ২টি বিয়ে করে।
আর তাদের বাড়ির আরেক ভাবী কানে ঢুকিয়ে দেয়, “তোর বউ তো নূরের লগে হাসি দিয়া কথা কয়! কি বেশরম মেয়ে মানুষ, পর পুরুষের সাথে এত কীসের মাখামাখি?” শুনে মাথায় রক্ত উঠে যায় আবুলের! সে আবারো বেধম মারধর করে তার বউকে। আবুলের মার আর অপমান সইতে না পেরে রাতের আঁধারে গাছের সাথে কাপড় ঝুলিয়ে ফাঁসি দিতে গেলে মন্তু তাকে বাঁচায়। এসব ঘটনার মাঝে হীরণের বিয়ে ঠিক হয়।
মকবুল বুড়ো তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের আয়োজনের কোনো কমতি রাখে না। কিন্তু ঐ বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ফকিরের মা বলে উঠেন বরপক্ষ ৮ জন কইয়া ১০ জন আইছে তাদের খাওনের ব্যবস্থা কেমনে অইবো! সেই বিয়েতে গান করে আম্বিয়া। আম্বিয়া হলো মাঝি বাড়ির মেয়ে যার রূপের আর গুণের বর্ণনা সবার কথায় চলে আসে উপন্যাসে।
আম্বিয়া ঢেঁকিতে ধান ভানতো আর কমলা সুন্দরী, বেহুলা সুন্দরীর গান গাইতো। আম্বিয়ার বাবা মৃত মানুষের কবর খুঁড়ে কিন্তু কলেরা হয়ে মারা যাওয়ায় তার বাবার লাশ দাফন করতে কেউ রাজি হয়নি। মন্তু আম্বিয়ার ভাইয়ের নৌকা চালায় বর্ষাকালে। সে সূত্রে মাঝি-বাড়িতে মন্তুর অবাধ যাতায়াত। আম্বিয়ার ভাইও কলেরা (ওলা বিবি)-তে মারা যায়। তখন মন্তুর অবচেতন মন আম্বিয়াকে বিয়ে করতে সাঁয় দেয়। এ খবর টুনি জানার পরে মকবুল বুড়োকে বলে আপনি বিয়া করেন আম্বিয়াকে, তাইলে আপনি কিছু জমি-জমা আর নৌকাটাও পাইবেন!
এ প্রস্তাব শুনে মকবুল বুড়ো টুনির উপর যারপরনাই খুশি হয়ে টুনিকে তার যোগ্য সহধর্মিণী বলে ঘোষণা করে। এই বিয়ের আগ্রহের প্রতিবাদ জানায় স্ত্রী আমেনা আর ফাতেমা। তাই মকবুল বুড়ো তালাক দেন তার ২ স্ত্রীকে! এই আলোচনার মাঝে আবুল বলে সে নিজে বিয়ে করবে আম্বিয়াকে!
পিঁড়ি দিয়ে আবুল মকবুল বুড়োর মাথায় আঘাত করে। শয্যাশায়ী থাকার পরে মকবুল বুড়ো মৃত্যুবরণ করে। এ সময় তার সেবা যত্ন করে টুনি। টুনির অবচেতন মন পতি ভক্তিতে নত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বউ গৃহ ত্যাগ করেন আর টুনিকে তার বাপের বাড়িতে নিয়ে রওয়ানা হয় মন্তু। চপলা চঞ্চলা টুনি এক নিমেষেই বট বৃক্ষের মতো দৃঢ়, শান্ত, পরিপক্ব হয়ে যায়।
সেই নৌকা মাঝপথে আসলে মন্তু বলে, মনোয়ার হাজীরে কইলে বিয়ার একটা ব্যবস্থা কইরা দিবো চল টুনি যাই। মনোয়ার হাজীর সাথে তাদের পরিচয় হয় যাত্রা দেখতে যাবার সুবাদে। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে টুনি বলে উঠে, “তা আর অয়না মিয়া; তা আর অয়না!” টুনির এ পরিবর্তন যেন মন্তু মেনে নিতে পারে না। মন্তুর হাত থেকে নৌকার বৈঠা পড়ে যায়।
শেষ অবধি শুধুমাত্র মন্তুই সুখী হয়। সে আম্বিয়াকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে তাদের ১ জন পুত্র সন্তান হয়েছে। আর মকবুল বুড়োর মেয়ে হীরণ মৃত সন্তান প্রসব করে স্বামী পরিত্যক্ত হয়েছে। এ যেন প্রকৃতির এক নির্মম প্রতিশোধ। এর চিহ্ন উপন্যাসে ফুটে উঠেছিল মকবুল বুড়োর কৃতকর্ম যেন তার মেয়ের জীবনে অমানিশার কালো হয়ে ফিরে এসেছে।
বাড়িতে আজকে পুঁথির আসর বসেছে এর মাঝে সবাই যেন মনোমুগ্ধ শ্রোতা। কিন্তু এর মাঝেও মন্তুর টুনির কথা মনে পড়ে আর অবচেতন মনে বেজে উঠে, তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল, নাকি আমার মন? মন্তুর জীবনে টুনি আজ নেই! কিন্তু তাও যেন মনে হয় কোথাও না কোথাও স্মৃতি হিসেব রয়ে গেছে।
রাত বাড়ছে হাজার বছরের পুরনো সেই রাত। আবহমান বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনবোধ, জীবন দর্শন এবং জীবন অনুভূতিকে উপজীব্য করে সত্যিই এক কালজয়ী উপন্যাসের চরিত্র লিখনশৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার জহির রায়হান। এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপায়ন করেন জহির রায়হানের সহধর্মিণী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা। চলচ্চিত্রটি ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে ২০০৫ সালে মরণোত্তর পুরস্কার লাভ করেন জহির রায়হান।
জহির রায়হান ১৯৭২ সালে সহোদর শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পত্রিকায় শিরোনাম আসে জহির রায়হান নিখোঁজ। জহির রায়হান যদি অতল গহ্বরেরে হারিয়ে না যেতেন তাহলে বাংলা সাহিত্য নিঃসন্দেহে আরো সমৃদ্ধ হতো। যখন ১৯৯৩ সালে পরিচালক সত্যজিৎ রায় অস্কার পেয়েছিলেন সেই ভিডিওটা দেখে মনে হয় যদি জহির রায়হান এভাবে অকালে শহীদ না হতেন, তাহলে আমরাও হয়তো অস্কার বিজয়ী জহির রায়হানকে দেখতে পেতাম।
বিদেশি কাহিনী অনুকরণের ভিড়ে আমরা যাতে নিজস্বতা না হারাই, উনার কাজগুলো যেন আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় সবসময়। ভাষা আন্দোলনের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির গর্ব ভাষা আন্দোলনের রাজ পথের যোদ্ধা, ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানে রাজপথ উত্তাল করা এই প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানকে। এমন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ কয়েক শতাব্দীতে একবারই আসে। আমরা যেন অকুণ্ঠচিত্তে গর্ব করে বলি আমাদের একজন প্রভাত-পুরুষ জহির রায়হান ছিলেন। বাঙালি ভাগ্যগুণে জহির রায়হানকে পেয়েছিল। জহির রায়হানের জীবন নশ্বর হলেও তার সৃষ্টি অবিনশ্বর।