অঘোরে ঘুমিয়ে শিব দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের তৃতীয় বই। আগের দুটি বই যথাক্রমে ‘ঈশ্বর যখন বন্দী‘ এবং ‘নরক সংকেত‘। বইটি কলকাতার বুকফার্ম প্রকাশনী থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। থ্রিলার ঘরানার এই বইটির মূল গল্প তাজমহলকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। একদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, আরেকদিকে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের দ্বৈরথ- দুয়ে মিলে দারুণ জমেছে।
গল্পসার
গল্পের মূল চরিত্র রুদ্রের নাম আসলে রুদ্রানী। আগ্রার একটি ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার। তার স্বামী প্রিয়ম থাকে বিলেতে। সে নিজে আগ্রায় একা থাকে। বাবা-মা থাকেন সেই কলকাতায়।
গল্পের শুরুতেই রুদ্রের নামে একটি সাসপেন্ড অর্ডার আসে। কারণ, আগের দিনই তার ব্রাঞ্চে কে যেন একুশ কোটি টাকা পাঠিয়েছে। অথচ সে ব্যাংকের মূল অফিসে রিপোর্ট করেনি। আসলে পরদিন ছিল ছুটি। সে হিসেবে বাবা-মাও ঘুরতে আসছেন। ভেবেছিল, বাবা-মাকে নিয়ে একটু শান্তিমতো ঘুরবে। তার আর উপায় কই? ব্যাংককে কারণ দর্শিয়ে চিঠি পাঠাতে হবে। কারণ আর কিছুই না, বাবা-মায়ের আসার তোড়জোড় আর বিভিন্ন লোন শোধের জন্য গ্রাহকদেরকে খুঁজতে গিয়ে রিপোর্ট করতে সেদিন ভুলে গিয়েছিল রুদ্র।
প্রফেসর নিজামুদ্দিন বেগ পত্রিকায় ধারাবাহিক কলাম লিখতে শুরু করেছিলেন। সেই করতে গিয়ে ভিমরুলের চাকে ঢিল দিয়ে ফেলেছেন। তার লেখার বিষয় ছিল, প্রাচীন ভারতীয়রা কেমন করে দারুণসব জিনিস করেছেন আর সব কীভাবে ঢাকা পড়ে গেছে। যেমন, পাইয়ের মানের কথা লেখা আছে আর্যভট্টের শ্লোকে। তেমনি শিবপুরাণে লেখা আছে বেশ কিছু শিবমন্দিরের কথা। গাণিতিক হিসেবে একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব পরপর, নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো শিবমন্দির থাকার কথা। বর্তমানে আছে মাত্র ১২টি।
সমস্যা সেটি নয়। সমস্যা হলো, হিসেব বলছে, তাজমহল আগে মূলত শিবমন্দির ছিল। আজও ওর ভেতরে, নিচের যে দিকটা শাহজাহান সিলগালা করে দিয়েছেন, তাতে সেই শিবলিঙ্গটা রয়ে গেছে। তারমানে, তাজমহল শাহজাহানের অমূল্য কীর্তি না, বরং তার দখল করে নিজের মতো করে পাল্টে নেয়া এক শিবমন্দির।
এর পেছনের দলিল হিসেবে বাদশাহনামা নামের শাহজাহানের জীবনীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সম্রাটের সভাষদ তার গুণকীর্তন বাড়িয়ে করতে পারেন, কিন্তু দোষ বা মিথ্যে উল্লেখ করতে নিশ্চয়ই পারেন না। সম্রাটরা নিজেও তো সেসব পড়ে বা শুনে দেখতেন। অথচ সেই বাদশাহনামাতে এরকমই ইঙ্গিত দেয়া আছে যে, সম্রাট তাজমহল অধিগ্রহণ করেছিলেন।
তাজমহল কি আসলেই শিবমন্দির? মুঘলরা কি আসলেই এতো এতো মন্দির জবর দখল করে নিয়েছিল? নাকি, এটা আসলেই শাহজাহানের বানানো?
এর আগের নাম ছিল তেজো মহল, সেই থেকেই পরে তাজমহল এসেছে। সে সময়কার ফ্রেঞ্চ অলংকার ব্যবসায়ী টার্ভানিয়ার তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, তাজমহলের সবচেয়ে বেশি খরচ নাকি হয়েছে ইটের পেছনে। শাহজাহান যে পরিমাণ রত্ন দিয়ে বাঁধিয়েছেন বলে জানা যায়, তার খরচের কথা একজন অলংকার ব্যবসায়ীর চোখ এড়িয়ে যাওয়াটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়।
এরকম একটা দুটো নয়, আরো অনেকগুলো প্রমাণের কথাই উল্লেখ করছেন নিজামুদ্দিন বেগ। কিন্তু আর এগোতে পারলেন না। শেষ কিস্তি লেখার আগেই তার বাসায় হামলা হলো। নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন নাজিমুদ্দিন।
এদিকে অঘোরেশ ভাট নামের একজনের নামে কল এসেছে পুলিশের কাছে। সে লোক নাকি তাজমহলে হামলা করতে চায়। ভেঙেচুরে বের করে আনতে চায় ভেতরের শিবলিঙ্গ।
অস্ত্র ব্যবসায়ী মুন্নাকে ডেকে নেয়া হয়েছে। মোটা অংকে কেনা বস্তাভর্তি অস্ত্র চালান করে দিয় আসতে হবে সেই আগ্রায়।
ওদিকে নাগেশ সিং পিস সামিট আয়োজন করছেন আগ্রায়। ভদ্রলোক চাচ্ছেন, যেসব দেশের মাঝে যুদ্ধ হচ্ছে, তারা এখানে আসুক। একসঙ্গে হয়ে প্রতিজ্ঞা করুক, আর যুদ্ধ নয়। কারণ, যুদ্ধে সবারই ক্ষতি। লাভ শুধু অস্ত্র ব্যবসায়ীদের।
নাগেশ সিংয়ের মেয়ে উজ্জয়নী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। বাবা-মায়ের মাঝে সারাক্ষণ ঝগড়া ওর আর ভালো লাগছে না। ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে দূরে কোথাও ঘর বাঁধবে সে।
এদিকে, সারাদিন প্রিয়মকে ফোন দিয়েও পাচ্ছে না রুদ্র। প্রিয়মের মেইলের পাসওয়ার্ড জানে সে। খুলে দেখেছে, গত একদিনের সব ই-মেইল ওভাবেই পড়ে আছে। খোলা হয়নি। ওর মাঝে এসে হাজির হয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, ওর ব্র্যাঞ্চে আসা একুশ কোটি টাকার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোনো আন্তর্জাতিক চক্র। দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় হয়েছে রুদ্রের।
তাজমহল কি আসলেই শিবমন্দির? মুঘলরা কি আসলেই এত এত মন্দির জবর দখল করে নিয়েছিল? নাকি, এটা আসলেই শাহজাহানের বানানো? কিন্তু এর সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসার কী সম্পর্ক? কারা নাজিমুদ্দিনের বাসায় হামলা করলো? এতগুলো টাকাই বা ঢাললো কেন ওরা? তাজমহলকে শিবমন্দির বলে প্রমাণ করে ওদের কী লাভ? আর, যদি প্রমাণ না হয়? তাহলে কী হবে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ঠাস বুনোটের থ্রিলারটিতে।
লেখক পরিচিতি
দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাসই ছিল ‘ঈশ্বর যখন বন্দী’। রাতারাতি সাড়া পড়ে গিয়েছিল বইপ্রেমীদের মাঝে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে সিরিজের পরের বইগুলোতেও। সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘নরক সংকেত’ পাঁচমাসের মধ্যেই বিক্রি হয়েছে ৫০০০ কপিরও বেশি!
বুক ফার্ম প্রকাশনীর সঙ্গেই কাজ করে যাচ্ছেন লেখক। আঘোরে ঘুমিয়ে শিব ছাড়া তার সাম্প্রতিক বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে ‘হারিয়ে যাওয়া খুনীরা’।
বই লেখা ছাড়া দেবারতি মুখোপাধ্যায় পেশাগত জীবনে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।
পর্যালোচনা
দেবারতির লেখা নিয়ে সবার আগে যে কথাটি বলতে হবে, তা হলো, তার লেখা পড়তে বেশ আরাম। তথ্য দিয়েছেন প্রচুর, কিন্তু তাতে একঘেয়েমি বা বিরক্তির অবকাশ আসেনি।
তবে, শুরুর দিকে তথ্য দেয়া হচ্ছিল গল্পের মতো করে। তাতে রহস্য সমাধানের ব্যাপার ছিল না। যেটা বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু পরের দিকে এসে বইটা অনেকটাই ড্যান ব্রাউনীয় মোড় নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরও ইতিহাসে দারুণ আগ্রহ। সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার না করে তিনি ইতিহাসের গল্প শুনছেন। কিংবা রুদ্র তার আগের অভিযানের গল্প শোনায় অফিসারকে। প্রমাণ বলতে, রুদ্রের বাসায় কেবল একটা ছবি। কিন্তু অফিসার তা শুনেই একজন সিভিলিয়ানের কথা বিশ্বাস করে তাকে সীমাহীন প্রবেশাধিকার দিয়ে দিচ্ছেন, যাচাই-বাছাইতে যাননি- এটা খুবই অদ্ভুত। কিন্তু এই বইটাকে ড্যান ব্রাউনীয় ঘেরে ফেলা যায় না, কারণ, দেবারতি শেষে এসে তথ্যের চেয়ে বাস্তব সন্ত্রাসের ত্রাস নিয়ে কাজ করেছেন, যা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।
অস্ত্রের বাজার নিয়ে তার আলোচনা এবং বিশ্ব অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্মীয় কোন্দলের পেছনে অস্ত্র বাজারের ভূমিকা খুবই বাস্তব হয়ে ফুটেছে। আসলে বাস্তবেও তো তা-ই হয়। একটা আস্ত বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছেই কেবল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনায়। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রতিটি প্রধান চরিত্রকে যথাসম্ভব সময় দেয়া হয়েছে। পরম মমতায় তাদেরকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে রুদ্র-প্রিয়মকে বোঝার জন্য আগের দুটি বই পড়ার প্রয়োজন পড়বে না। তা পাঠকের জন্য সুবিধাজনক। সেই সঙ্গে প্রচুর গৌণ চরিত্রও এসেছে। দুয়েক লাইনে তাদের কাজ এবং উদ্দেশ্য জানা যাবে। পাঠকের কাছে গৌণ চরিত্রদেরকেও ঠিক অপরিচিত যেন মনে না হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন লেখক।
বইটার আরেকটা দারুণ দিক এর আর্ট। জায়গায় জায়গায় দারুণ সব স্কেচ ধরনের আর্ট ব্যবহার করা হয়েছে। যেটা দেখে একটু আফসোসও হয়। আহ, আমাদের গল্পের বইগুলোও যদি এমন হতো!
তাজমহল নিয়ে বিস্তারিত ঐতিহাসিক দলিল ব্যবহার করেছেন তিনি। বইয়ের শেষে ৫২টি তথ্যসূত্র দেয়া আছে। এর মধ্যকার অনেকগুলোই খাঁটি একাডেমিক। আবার, অনেকগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক লিখেছেন। প্রতিটি তথ্যসূত্র যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য। কিন্তু তাতে করে ঐতিহাসিক এই রহস্যের কিনারা হয় না। কারণ, সত্য কোনো চিরায়ত জিনিস নয়। সত্য নির্মিত হয় এবং তা নির্মাণ করেন বিজয়ী বা ক্ষমতাসীনরা।
তাজমহল শেষ পর্যন্ত এক অদ্ভুত রহস্য হয়েই থাকবে আমাদের কাছে। এর ইতিহাস, এর সৌন্দর্য যুগে যুগে মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে, এবং করেই যাবে।
প্রিয় পাঠক, তাজমহল নিয়ে যদি আপনার আগ্রহ থেকে থাকে, এই বই আপনার সেই আগ্রহ আরো অনেকগুণ উসকে দেবে। বই শেষে গল্প ফুরোবে, কিন্তু আপনার মনে হবে, কেমন যেন ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’! হয়তো তথ্যসূত্রগুলো নিয়ে আপনিও ঘাঁটতে বসে যাবেন। অন্তর্জালের কল্যাণে তা করে তৃপ্তি বাড়বে বৈ কমবে না। হয়তো স্বচক্ষে তাজমহল দেখে আসার ইচ্ছেটা বেড়ে যাবে কয়েকশত গুণ। এখানেই রচয়িতার পরম সার্থকতা।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বই ও সিনেমা’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
অনলাইনে বইটি সংগ্রহ করতে ভিজিট করতে পারেন রকমারি.কম