ব্যান্ড অব ব্রাদার্স: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খণ্ডচিত্রের এক বিস্ময়কর সেলুলয়েড প্রদর্শন

আজকের যুগে ‘টিভি সিরিজ’ এর সাথে পরিচিত নন এমন লোকজন নেই বললেই চলে। প্রযুক্তিনির্ভর এই প্রজন্মে স্যাটেলাইট চ্যানেলের ও ইন্টারনেট কানেকশনের সহজলভ্যতা তো আছেই। এছাড়া বিভিন্ন প্রযোজনাকারী প্রতিষ্ঠান ও বিনোদনধর্মী সংস্থার নিজেদের সৃষ্টিকে ব্যবসায়িক সাফল্য লাভের আশায় বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার সুবাদে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও টিভি সিরিজ হয়ে উঠেছে দারুণ জনপ্রিয়। আর এভাবেই আমাদের মাঝেও জন্ম নিয়েছে অনেক টিভি সিরিজপ্রেমী। যারা সিরিজ নিয়ে টুকটাক ভালোমন্দ জ্ঞান রেখে থাকেন, তারা মোটামুটি এযাবতকালে মুক্তিপ্রাপ্ত সব সেরা ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থিত টিভি সিরিজের সাথেই পরিচিত। আর আজকে এমন একটি বিশ্ব জুড়ে সাড়া জাগানো টিভি সিরিজকেই আপনাদের সামনে হাজির করা হয়েছে।

হলিউডে বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা মুভির পরিমাণ নিতান্তই কম নয়। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত মুভির কথা বললেও পার্ল হারবার, দ্য পিয়ানিস্ট, শিন্ডলার্স লিস্ট, সেভিং প্রাইভেট রায়ান, ডানকার্ক ইত্যাদি এমন অনেক কালজয়ী সিনেমার নাম উল্লেখ করা যাবে। আর সিরিজের কথা বললে? কেউ মানুক আর না মানুক, এ যাবতকালে যতগুলো সিরিজ নির্মিত হয়েছে, ‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ নামের সিরিজটি সেগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি। আর ওয়ার-ড্রামা জনরা হিসেবে বিচার করলে একে এই জনরার সর্বকালের সেরা সিরিজ বলে অভিহিত করা যাবে নিঃসন্দেহে।

যুদ্ধে যাবার জন্য প্রশিক্ষণরত সেনাদল; Source: Pinterest

‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ সিরিজটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের দিকে। সেই সময়ে আমেরিকান নেটওয়ার্ক চ্যানেল ‘এইচবিও’ তাদের ‘দ্য সোপ্রানোস’ টিভি সিরিজ ও ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ টিভি সিনেমার সাফল্যের জোয়ারে ভাসছিল। ওগুলোর জনপ্রিয়তার রেশ কাটতে না কাটতেই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের সবথেকে ব্যয়বহুল ও চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্টটি হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকান বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও লেখক স্টিফেন এডওয়ার্ড এমব্রোসের রচিত ‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ বইয়ের ওপর ভিত্তি করে আনুমানিক ১০ ঘণ্টার একটি টিভি সিরিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করে প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্লটের ওপর গড়ে ওঠা এই সিরিজে অন্যান্য আরও কয়েকজন প্রযোজকের সাথে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে জুটি বাঁধেন ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ সিনেমার নির্বাহী প্রযোজনা ও পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ও সিনেমাটির মূল চরিত্রের অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস।

সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত সেনাদল; Source: Pinterest

‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ সিরিজের ১০টি পর্বের জন্য চিত্রনাট্য রচনার দায়িত্বে সাতজনের একটি রাইটার প্যানেল নিয়োজিত ছিল। তবে প্লট আউটলাইন ও প্রতিটি পর্বের জন্য আলাদা আলাদা বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও সেগুলোর মেলবন্ধন করার গুরুদায়িত্ব টম হ্যাঙ্কস ও এরিক জেন্ড্রেসেন বহন করেছিলেন। তারা দুজন বেশ কয়েকমাস এমব্রোসের বইটির খুঁটিনাটি বিষয়ে গবেষণা ও বাস্তবের সাথে এর সামঞ্জস্যতা অনুসন্ধান করে, তারপরই সিরিজের মূল গল্প নির্ধারণে সুপ্রসন্ন হন। সবথেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, বাস্তব জীবনের ব্যান্ড অব ব্রাদার্সের একজন বীরযোদ্ধা ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ণয় করে সিরিজের প্লটকে আরও নির্ভুল করতে একজোট হয়ে কাজ করেছিলেন। আর সেই বীরযোদ্ধা হলেন সাবেক টেকনিক্যাল সার্জেন্ট ডোনাল্ড ম্যালার্কি। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মার্কিন সেনাবাহিনীর ইজি কোম্পানির অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা হিসেবে দেশের প্রতি নিজের কর্তব্যের পালন করেছিলেন।

‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ এর মূল প্লটটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘১০১তম এয়ারবোর্ন ডিভিশন’ এর অন্তর্গত ‘৫০৬তম প্যারাসুট ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট’ এর সেকেন্ড ব্যাটালিয়নের। অন্যান্য আরও অনেক ছোট ছোট দলের মধ্যে একটির ও সেই দলের সদস্য সেনাদের যুদ্ধকালীন চিত্র ফুটে ওঠেছে এখানে। আর সেই সেনাদলটির নাম হলো ‘ইজি কোম্পানি’। সিরিজের ১০টি পর্ব জুড়ে ইজি কোম্পানির যুদ্ধকালীন নানা স্থানে যাত্রা ও নানা পরিস্থিতি সম্মুখীনের ঘটনাবলীকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। শুধু যে গোলাগুলি ও রক্তারক্তি তা কিন্তু নয়। এই সিরিজে যুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি সেনাদের বৈরী পরিবেশের সাথে টিকে থাকার লড়াই, শত্রুকে মোকাবিলা করার আগে আত্মদ্বন্দ্বকে কাটিয়ে ওঠার অগ্নিপরীক্ষা, শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক বিধ্বস্ততা, নিজেদের মধ্যে আত্মিক বন্ধনে জড়িয়ে পড়া ও প্রতিটি সৈন্য যে দিনশেষে পদবী ও দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে রক্তে-মাংসে গড়া সামান্য একজন মানুষ সেই বিষয়গুলোর ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। মোটকথা, এই সিরিজের যুদ্ধের সামগ্রিক রূপকে একদম গভীরভাবে ও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ক্যামেরার পর্দায় ধারণ করা হয়েছে।

বাস্টনে আটকা পরা অবস্থায় ইজি কোম্পানি; Source: coub.com

‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ সিরিজ সমালোচক ও দর্শকদের দৃষ্টিতে এতটা প্রশংসনীয় হবার পেছনে সবথেকে বড় কারণ ছিল, এই সিরিজের কাহিনীর নির্ভরযোগ্যতা। এই সিরিজের গল্প যে শুধু এমব্রোসের বই থেকেই সংকলিত হয়েছে তা নয়। এর পাশাপাশি সত্যিকারের ইজি কোম্পানির জীবিত থাকা সেনাদের সাক্ষাতকার সংগ্রহ থেকে শুরু করে সিরিজের প্রতি এপিসোডের শুরুতে সেই সব সাক্ষাতকারের ধারণকৃত ভিডিও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই দর্শকদের সামনে বাস্তব জীবনে সেনাদের যুদ্ধ নিয়ে মতামত ও তাদের নিজেদের স্মৃতিচারণা শোনার সুযোগ হয়েছিল যা কিনা সিরিজের প্রতি কৌতূহল উদ্দীপিত করতে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।

‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ সিরিজটিতে মূলত ইজি কোম্পানির ইউরোপ অভিযানের ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরা হয়েছে। নিজের মাতৃভূমিকে ছেড়ে, আপনজনদের মায়া ত্যাগ করে ও নিজের প্রাণকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে কীভাবে একদল যুবক দৃপ্ত পদচারণয় ভিনদেশে গিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হয় ও তাদের মধ্যে অনেকেই সেই যাত্রাপথে ভিন দেশের মাটিতে শহীদের খেতাবপ্রাপ্ত হয়, সেটাই হচ্ছে এই সিরিজ ও বাস্তব জীবনের ইজি কোম্পানির দুঃসাহসিক অভিযানের সারাংশ।

এই সিরিজের বাজেটের কথা শুনলে তৎকালীন যুগে লোকজন হতবাক না হয়ে পারেনি। কারণ তখন তো আর ‘গেম অব থ্রোনস’ এর মতো এত বিশাল বাজেটের টিভি সিরিজ নির্মাণ করা হয়নি। ১৯৯৮ সালের দিকে তাই এই সিরিজটিই ছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ বাজেটের সিরিজ। প্রায় তিন বছর সময়ে তৈরি করা এই সিরিজটি নির্মাণ করতে প্রায় ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো খরচ পড়েছিল। তার মানে, প্রতি এপিসোডের পেছনে এর ব্যয়ভার প্রায় ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিরিজের নির্বাহী প্রযোজনা টম হ্যাঙ্কস বাজেট সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,

“সত্যিকার অর্থেই, এটা দারুণ ব্যয়বহুল। এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলে, আপনার পকেট ভারি হতে হবে। আর এইচবিওর পকেট নিঃসন্দেহে ভারি।”

ক্যারান্টনের ময়দানে ইজি কোম্পানির সেনাদল; Source: Pinterest

সিরিজের কয়েকটি অসাধারণ দিক রয়েছে যেগুলোর কথা না তুলে ধরলেই নয়। মাত্র সাতশ পাঁচ মিনিট সময়সীমার এই সিরিজের পেছনে অত্যন্ত বিশাল একটি প্রোডাকশন টিম কাজ করেছে। সত্তরের কাছাকাছি সেনাদলকে পর্দার সামনে দাঁড় করাতে প্রায় ২,০০০ আমেরিকান ও জার্মান আর্মি ইউনিফর্ম, ১,২০০ ভিনটেজ কস্টিউমস ও প্রতিদিন প্রায় ১৪,০০০ রাউন্ড গুলির ব্যবহার করা হয়েছে। সবথেকে মজার ব্যাপার হলো, স্পিলবার্গ ও হ্যাঙ্কস কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে সিরিজের সেনাদের চরিত্রে অভিনয়কারী সব শিল্পীদের হাতে সত্যিকারের রাইফেল তুলে দিয়েছিলেন। এই সিরিজে ব্যবহারের উদ্দেশ্য তারা প্রায় ৭০০টি রাইফেলের যোগান দেন যাতে সিরিজটিকে আরও বাস্তবসম্মত করে তোলা যায়। সিরিজের শুটিং শুরু হবার পূর্বে, অভিনয়শিল্পীদের ১০ দিনের জন্য একটি বুটক্যাম্পে একসাথে রাখা ও সেনাদের জীবনধারার সাথে পরিচয় করানো থেকে শুরু করে টুকটাক ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছিল।

ক্যাপ্টেন ড্যাল ডাই নামের একজন সাবেক মেরিন সেই ক্যাম্পে অভিনয়শিল্পীদের সার্বিক দেখাশোনা ও প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা করে সেনা প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। যদিওবা সিরিজে দেখানো হয়েছে ইজি কোম্পানি ইউরোপের প্রায় অর্ধেক স্থানেই ভ্রমণ করে ফেলেছে, কিন্তু আসলে শুটিংয়ের বেশিরভাগ অংশ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই হয়েছিল। ‘হ্যাটফিল্ড এরোড্রোম’ নামের একটি পুরনো ব্রিটিশ এরোস্পেস ফ্যাক্টরিতেই সিরিজের অধিকাংশ শুটিং সম্পন্ন করা হয়েছিল। সমগ্র ইউরোপকে একই স্থানে চিত্রাঙ্কন করাটা আসলেই প্রোডাকশন হাউজের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে তারা সেটা সফলতার সাথে জয় করতে পেরেছিল। এই সিরিজের আরও একটি বিস্ময়কর দিক হলো, এটি আজকের যুগের অনেক তারকার জন্ম দিয়েছিল। আজকের স্বনামধন্য অভিনেতা টম হার্ডি, জেমস ম্যাকঅ্যাভয়, সিমন পেগ, কলিন হ্যাঙ্কস, ডমিনিক কুপার, জিমি ফ্যালন এই সিরিজে একদম নব্য অভিনেতা হিসেবে পর্দার সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন।

এভাবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয় অনেক বীর যোদ্ধা; Source: Pinterest

সিরিজটি যুক্তরাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপক দর্শকনন্দিত হলেও, যুক্তরাজ্যে প্রচারের আগে কিছু বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছিল। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি মেইল’ সিরিজটিকে সংকীর্ণতা জর্জরিত বলে আখ্যায়িত করেছিল ও সিরিজে ব্রিটিশ সেনাদলের অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। যদিও সিরিজের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আমেরিকান একটি নির্দিষ্ট সেনাদলকে রাখা হয়েছিল বলে তাদের সমালোচনার বিষয়বস্তু তেমন জোরালো হয়ে ওঠেনি। আর তাই এই বিতর্কের জের ধরে পরিস্থিতি প্রতিকূল অবস্থা ধারণ করার আগেই, এর রেশ কেটে গিয়েছিল। আর সিরিজটি ইউরোপেও ভালো ব্যবসা করতে ও সুনাম কামাতে সমর্থ হয়েছিল।

‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ সিরিজটি সমালোচকদের দৃষ্টিকোণ থেকে অঢেল প্রশংসার পাশাপাশি প্রতিটি চরিত্রের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটনের ব্যাপারটাকে প্রশ্নবিদ্ধও করেছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিল যে, “এটা ১০ পর্বের অনন্যসাধারণ একটি সিরিজ, যেটার সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধকালীন সেনাদের বীরত্বগাথা ও যুদ্ধের ভয়াবহতাকে সমানতালে ফুটিয়ে তোলা।

‘ইউএসএ টুডে’র রবার্ট বিয়াঞ্চোর মতে, দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালীন প্রতিটি চরিত্রকে আলাদাভাবে চেনার উপায় ছিল না, যাকে তিনি সিরিজের মন্দ দিক বলে বিবেচনা করেছিলেন। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর ফিলিপ ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, “গত কয়েক বছর সিনেমাতেও এত চমকপ্রদ কিছু দেখিনি, স্পিলবার্গ ও হ্যাঙ্কস ১০ পর্বে যা দেখালেন”।

অন্যদিকে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার টম শেলস সিরিজটিকে অগোছালো বলে দাবি করে বলেন যে, “টানা দুই ঘণ্টা দেখার পরেও বোঝার উপায় নেই কারা মূল চরিত্রে অভিনয় করছেন”।

তবে সিরিজটি যে ২য় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিরিজগুলোর ক্ষেত্রে ‘বেঞ্চমার্ক’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ কারো নেই। আইএমডিবি-তে সর্বোচ্চ রেটিং ৯.৫ ও রটেন টম্যাটোসে ১০০% রেটিং প্রাপ্ত এই সিরিজের ঝুলিতে ৭টি প্রাইম এমি এওয়ার্ড ও সেরা মিনি টিভি সিরিজ হিসেবে ১টি গোল্ডেন গ্লোব উঠেছিল।

আহা! যুদ্ধ শেষ!; Source: Pinterest

এবার সিরিজের দশটি পর্বের নামসহ প্রতি পর্বের সংক্ষিপ্ত প্লট তুলে ধরছি।

পর্ব ১ – ‘কারাহি’

ক্যাপ্টেন হারবার্ট সবেলের নেতৃত্বে ইজি কোম্পানি ট্রেনিং ক্যাম্পে পরস্পরের সাথে যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার সময় পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করে। সবেল অন্যান্য কোম্পানির নেতাদের থেকে তাদের দিয়ে বেশি পরিশ্রম করাতো ও নিজের দোষ তার অধীনস্থ সেনাদের কাঁধে চেপে দিতে চাইতো। এই পর্বে মূলত ক্যাপ্টেন সবেলের কাণ্ডকারখানা ও সেনাদের যুদ্ধের যাওয়ার প্রস্তুতির ওপরই আলোকপাত করা হয়েছে। এই পর্বের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ফিল অ্যাল্ডেন রবিনসন।

পর্ব ২ – ‘ডে অব ডেজ’

ইজি কোম্পানি নরম্যান্ডিতে এসে পৌঁছালেও, তারা বিশৃঙ্খলভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ও হন্ন হয়ে তাদের গন্তব্যের সন্ধানে নেমে পড়ে। মূলত পুরো দলের আবার একত্রিত হবার যুদ্ধ নিয়েই এই পর্ব। এর মধ্যে তারা আবার তাদের আগের কমান্ডারের প্ল্যানে গুলি বর্ষণের ফলে তিনি মারা গেলে, কোম্পানি নতুন কমান্ডার হিসেবে প্রথম লেফটেন্যান্ট উইন্টারকে বেছে নেয়। এই পর্বটির নির্দেশক ছিলেন রিচার্ড লনক্রেইন।

পর্ব ৩ – ‘ক্যারেন্টন’

এই পর্বে ক্যারেন্টনের যুদ্ধকে তুলে ধরা হয়েছে। আর এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইজি কোম্পানি কীভাবে সত্যিকারের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করে ও প্রাইভেট আলবার্ট নামের এক সেনা যুদ্ধের ভয়াবহতা নিজ চোখে দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মূলত তাকেই এই পর্বে ফোকাস করা হয়। মাইকেল সলোমন এই পর্বটি পরিচালনা করেন।

পর্ব ৪ – ‘রিপ্লেসমেন্ট’

এই পর্বে কিছু নতুন সেনার আবির্ভাব ঘটে ও পুরো দল নেদারল্যান্ডসের দিকে রওয়ানা হয়। অপারেশন মার্কেট গার্ডেন নামক মিশনের চিত্র এই পর্বে ফুটে উঠানো হয়। এই পর্বে ফোকাসে থাকে সার্জেন্ট ডেনভার র‍্যান্ডেলম্যান। এই পর্বের নির্মাতা ছিলেন ডেভিড নাটার।

পর্ব ৫ – ‘ক্রসরোডস’

টম হ্যাঙ্কস পরিচালিত এই পর্বে অতর্কিতভাবে জার্মানদের আক্রমণের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে। জার্মান এক তরুণ সেনাকে হত্যা করার পর কাকতালীয়ভাবে জার্মানরা হামলা করে বসেছিল।

পর্ব ৬- ‘বাস্টন’

১৯৪৪ সালের ক্রিসমাসে বোস্টনে ইজি কোম্পানি ও অন্যান্য দলগুলোকে জার্মানরা চারদিক থেকে ঘেরাও করে রাখা অবস্থায় মার্কিন সেনাদের দুর্দশার চিত্র এই পর্বে বর্ণিত হয়েছে। কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহে আর খাবারের অভাবে সেনাদের কেমন নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল, সেটা খুব দারুণভাবে এই পর্বের পরিচালক ডেভিড লিল্যান্ড চিত্রায়িত করেছেন।

পর্ব ৭ – ‘দ্য ব্রেকিং পয়েন্ট’

এই পর্বে বেলজিয়ামের ফয় নামক অঞ্চলের নিকটে যুদ্ধে লিপ্ত হবার কাহিনীচিত্র দেখানো হয়েছে। এই পর্বে মূলত ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট নরমান ডিকের নেওয়া সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়ে যাচাই-বাছাই ও কোম্পানির লিডারশীপের পরিবর্তন আনার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এই পর্বের নির্দেশক ছিলেন ডেভিড ফ্র্যাংকেল।

পর্ব ৮ – ‘দ্য লাস্ট পেট্রোল’

টনি টোয়ের নির্মিত এই পর্বে ১৯৪৫ সালে ইজি কোম্পানির অ্যাগানোর মিশনের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই পর্বটি সদ্য হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ময়দানে ফিরে আসা ডেভিড ওয়েবস্টারের ধারাভাষ্যে বর্ণনা করা হয়েছে।

পর্ব ৯ – ‘হোয়াই উই ফাইট’

যুদ্ধ তখন প্রায় শেষের দিকে। ইজি কোম্পানি জার্মানিতে ততদিনে প্রবেশ করে ফেলেছে। জার্মানির একটি ক্যাম্পে জিম্মিদের আটক করে রাখা অবস্থায় উদ্ধার করে ও যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের মনে নতুন এক উপলব্ধি বাসা বাঁধে। এই পর্বের পরিচালক ছিলেন ডেভিড ফ্র্যাংকেল।

পর্ব ১০ – ‘পয়েন্টস’

যুদ্ধ শেষ। ইজি কোম্পানি তখন পুরো ব্যাটালিয়নের সাথে অস্ট্রিয়াতে অবস্থান করছে। সবার মনের ভেতর বাড়ি ফিরে যাবার তাড়না। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ইজি কোম্পানিকে আবারো যুদ্ধ ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে জাপানে উদ্দেশে পাঠানো হলো। মূলত ইজি কোম্পানির জাপান যাত্রার মধ্য দিয়ে এই সিরিজের কাহিনীর সমাপ্তি টানা হয়েছিল। এই পর্বটি পরিচালনা করেন মাইকেল সলোমন।

আপনি যদি সত্যিকার অর্থে সিরিজপ্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে এমন একটি মাস্টারপিস মিস করাটা আপনার জন্য একদমই ঠিক হবে না। আর সিরিজপ্রেমী না হলেও, যারা ওয়ার জনরার সিনেমা ভালোবাসেন ও ইতিহাস নিয়ে জানতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই সিরিজ চমৎকার বিনোদনের পাশাপাশি অবিস্মরণীয় একটি শিক্ষণীয় সিরিজ হিসেবে অভিহিত হয়ে উঠবে নির্বিশেষে।

ফিচার ইমেজ- HBO

Related Articles

Exit mobile version