পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেল; আন্তর্জাতিক খবরে চোখ রাখলেই দেখা যায়, নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশার সংবাদ। কখনো হয়তো ইসরায়েলি বুলডোজার গুড়িয়ে দিচ্ছে কোনো ফিলিস্তিনি গ্রাম, কখনো মাইনের বিস্ফোরণে উড়ে গেছে অবুঝ শিশুর হাত-পা, কখনো আবার দেখা যায় ‘মুক্তি চাই’ প্ল্যাকার্ড হাতে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ঢল নেমেছে জেরুজালেমের বুকে।
পৃথিবীতে এত এত মানবাধিকার সংস্থা। আছে স্বাধীন দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘ, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন ইসলামি জোট; কিন্তু কেন তারা এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর তীরের এই উত্তাল ভূ-খণ্ড ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারল না? কারণটা কি রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচ! নাকি ইচ্ছে করেই এই সমস্যা জিইয়ে রাখা? আর ফিলিস্তিনিদের সাথে ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের এই মারমার-কাটকাট দ্বন্দ্বই বা কী নিয়ে!
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের চোখ বুলাতে হবে পুরনো ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। খুলে বসতে হবে ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের পবিত্র তিন ধর্মগ্রন্থ।
এ কাজ অসম্ভব না হলেও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ বটে। কেননা এই বিষয়ের উপর লিখিত বাংলা বইয়ের সংখ্যা হাতেগোণা। তাছাড়া পবিত্র গ্রন্থগুলোর অনুবাদ পড়ে অনেক কিছু বোধগম্য হবে না, যদি ধর্মগুলোর আদি-অন্ত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকে।
তবে জ্ঞানপিপাসুদের হতাশ হবার কিছু নেই। ভালো খবর হলো, খুব সহজেই আপনারা পৃথিবীর জটিল এই সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারবেন নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে। তা-ও আবার সংগ্রহ করতে হবে না ইতিহাসের কয়েকশ বই, প্রয়োজন নেই অগাধ ধর্মীয় জ্ঞানেরও।
তাহলে কীভাবে জানা যাবে? ‘দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস’ বই আছে তো! যেখানে ধর্ম ও ইতিহাসের দলিলসহ তুলে ধরা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের পূর্ণ চিত্র। চমৎকার শব্দবিন্যাসে এই কাজ করেছেন তরুণ লেখক সোহেল রানা।
সোহেল রানার জন্ম কুমিল্লায়। শৈশব কেটেছে গোমতী নদীর তীরবর্তী এক পাড়াগাঁয়ে। উচ্চ-মাধ্যমিক পড়াশোনা তার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন রেডিও টুডে-তে।
বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে লেখকের আগ্রহ সেই মাধ্যমিক থেকেই। কৈশোরে হয়তো এ বিষয় ছিল কেবলই আড্ডার খোরাক, কিন্তু পরবর্তীতে জানার পাশাপাশি বিশ্লেষণও করেছেন। এভাবেই গণমাধ্যমে কাজের পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতি নিয়ে লিখতে শুরু করেন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। একসময় হাত দেন বই লেখার কাজে। ২০২০ সালে লেখকের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস’, যেখানে তিনি দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে তুলে ধরেন ইহুদি দখলদারিত্ব, সন্ত্রাসবাদ ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ইতিবৃত্ত।
দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস
১.
আজকের দিনে নিপীড়িত, উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের যে অবস্থা, গুণে গুণে ঠিক ১০০ বছর আগে ইসরায়েলিদেরও একই অবস্থা ছিল। পার্থক্য হলো- ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডে মার খাচ্ছে, আর ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অত্যাচারিত হয়েছিল যেখানে তারা ছিল সংখ্যালঘু।
প্রাচীন ভূমি মেসোপটেমিয়া ছিল ইহুদিদের আদি নিবাস। সময়ের পরিক্রমায় তাদের একটা অংশ ঠাই নেয় বর্তমান ফিলিস্তিনে। যখন তারা ফিলিস্তিনে যায় তখন সেখানকার আদি বাসিন্দারাও ছিল। এরপর ভাগ্য তাদের নিয়ে যায় মিশরে। কিছুকাল পর সেখানে তারা দাস শ্রেণীতে পরিণত হয়। একসময় মিশর থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় আসে ফিলিস্তিনে। কিছুকাল শান্তিতে থাকার পর আবার দুর্যোগ নেমে আসে, এবার রোমানদের তাড়া খেয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে ইহুদিরা।
ইউরোপে ইহুদিদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্পেন, রাশিয়া, জার্মানিতে কয়েক দফা গণহত্যার শিকার হয় তারা।
এত অত্যাচারিত হওয়ার পরেও এ জাতি নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। আধুনিক ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং সিস্টেমসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলো তাদের সবসময় শত্রুভাবাপন্ন চোখেই দেখত। তাই ইহুদিরা চাইছিল একটি ভূখণ্ড। যেখানে তাদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারবে। আর সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইহুদিদের নজর পড়ে ফিলিস্তিনের উপর যেখানে কয়েক হাজার বছর আগে তাদের বাস ছিল। কিন্তু হুট করেই কীসের ভিত্তিতে তারা এই ভূখণ্ডের দিকে আঙুল তুলবে? উত্তর হলো: জায়োনিস্টদের প্রমিজল্যান্ড থিওরি।
জায়োনিস্ট করা? তারাই জায়োনিস্ট যারা বর্তমান ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে। এমনকি তারা মুসলিম, খ্রিস্টান বা অন্যান্য ধর্মের হলেও। আর প্রমিজল্যান্ড হলো আল্লাহ্ হযরত ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর উত্তরসূরীদের বেথেলহামের যে পবিত্র ভূমি দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটা। আজকের ইহুদিরা ইয়াকুব (আ.) এরই বংশধর।
এখানে একটা মজার ব্যপার হলো, ইহুদিরা ফিলিস্তিনকে নিজেদের ভূমি বলে দাবি করার পেছনে যে যুক্তিগুলো দেখায় তার সবই বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট) থেকে নেওয়া। অন্য ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করে ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠন করার দাবি কতটা যৌক্তিক? বা তাদের এই দাবির বিপরীত অবস্থানেই বা কী ধরনের প্রমাণাদি রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়েছে ‘দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস’ বইয়ে, যেখানে লেখক নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক তথ্যগুলো।
২.
গত শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপে নিপীড়িত ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদি নিধন শুরু হলে ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয়দের পরাজয়ের পর জেরুজালেম চলে যায় ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে। সেসময় ফিলিস্তিনে যেসমস্ত ইহুদিরা প্রবেশ করেছিল, তারা স্থানীয় মুসলমানদের কাছ থেকে জমিজমা কিনে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা হুট করে বেড়ে গেলে তারা স্থানীয় আরবদের উপর চড়াও হতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে জোরাল হতে থাকে ইহুদিদের রাষ্ট্র গঠন আন্দোলন। স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে অনুধাবন করে যে, ইহুদিরা দখলদার হয়ে উঠছে। আর তাদের এরূপ কাজে মৌন সহায়তা দিচ্ছিল ব্রিটিশরা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭-৪৮ পর্যন্ত ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল ফিলিস্তিন। এই সময়ের মাঝে ইহুদিরা একটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয় ফিলিস্তিনের মাটিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই সেই শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আনুষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব শুরু হয় ইহুদি আর ফিলিস্তিনিদের মাঝে। ফলে সমাধান হিসেবে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্রস্তাব দেয়, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নামে দুটো পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
এ সময় ইহুদিরা ছিল মোট ভূখণ্ডের মাত্র ৬ শতাংশের মালিক তাই তাদের জন্য এই প্রস্তাব ছিল আনন্দের। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাতে অস্বীকৃতি জানায়। আবার ইহুদিরাও জেরুজালেমের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপত্তি তোলে। ফলে কোনো সমাধান তো আসেইনি, বরং দুই পক্ষ জেরুজালেমের দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় সশস্ত্র সংঘাত।
সেই যে বিরোধ শুরু হয়েছিল তা আজও চলমান। ১৯৪৮-৭৩ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল ও আরবদের মোট ৪টি যুদ্ধ সংগঠিত হয়, যে যুদ্ধগুলোতে বারবার ব্যর্থ হয় আরবরা, আর শক্তিশালী হয়ে ওঠে ইহুদিরা।
বর্তমানে গোটা পৃথিবীতেই ইসরায়েল সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বেশ সামর্থ্যবান। তবে দুর্বল হলেও ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ, প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একসময় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন পিএলও-র নেতা ইয়াসির আরাফাত, যার প্রচেষ্টায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি মেলে ফিলিস্তিনের। সাথে মুক্তিকামী সংগঠন হামাসও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
তবে এখানে কিছু সমস্যাও রয়েছে। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠনগুলোকে দুর্বল করতে বিভিন্ন কৌশলে তাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখেছে ইসরায়েল। সেই সাথে আরব বিশ্বের স্বার্থান্বেষী নেতাদেরও বেশ গাফিলতি রয়েছে ফিলিস্তিন নিয়ে। এই ব্যাপারগুলো অনেকের জানা থাকলেও ভেতরের আরও অনেক গল্প আছে যা হয়তো অনেকেরই অজানা। পাঠকদের হতাশ হবার কিছু নেই! মুদ্রার ওপিঠ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে ‘দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস’ বইয়ে।
বইটিতে যে শুধুমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এমন নয়। বরং লেখক খুব চমৎকারভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার উত্থান, কী উপায়ে ব্রিটেন-রাশিয়াকে টেক্কা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকানরা আধিপত্য বিস্তার করল, হঠাৎ করেই ডলার কীভাবে বৈশ্বিক বিনিময়ে মাধ্যম হয়ে উঠল, ধনকুবের রথচাইল্ড পরিবারের উত্থানসহ সমসাময়িক বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। সেই সাথে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও ইহুদিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে বইটিতে।