হাজার চুরাশির সেই মা

‘হাজার চুরাশির মা’ মহাশ্বেতা দেবীর একটি কালজয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসের মূল বিষয় তৎকালীন ভারতবর্ষের নকশাল আন্দোলন। এই উপন্যাসের মধ্যে রূপকার্থে লুকিয়ে আছে মহাশ্বেতা দেবীর নিজ সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য।

‘হাজার চুরাশির মা’  উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে একজন স্নেহময়ী মায়ের চরিত্র, যার কাজ ছিল স্বামীর দৈহিক সুখের আশায় সন্তান জন্ম দেওয়া। এতে আছে নারীদেহের উপর আসক্ত একজন স্বামীর চরিত্র, যে তার স্ত্রীকে ভোগ করেই কেবল ক্ষান্ত হয়নি, বরং তার উগ্র যৌনতাকে শান্ত করার জন্য বেছে নিয়েছিল অবাধ নারীসঙ্গ।

এখানে আরও চিত্রিত হয়েছে তৎকালীন ধনিক শ্রেণীর মানুষের জীবনব্যবস্থা, যাদের কাজ গরীবদের শোষণ করে টাকার পাহাড় তৈরি করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন থাকা। আর এই বিকৃত ধনিক শ্রেণীকে নির্মূল করে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আবির্ভাব হয় এক যুবকের, যার পরবর্তী সময়ে স্থান হয় ‘হাজার চুরাশি’তে। আরও প্রদর্শিত হয়ছে এক সংগ্রামী প্রেমিকার চরিত্র। প্রদর্শিত হয়েছে কিছু স্বার্থবাদী মানুষের চরিত্র। যাদের আত্মস্বার্থের বলি হতে হয় অনেককে।

এতে আরও দেখতে পাওয়া যায় এক বিপ্লবের উত্থান-পতন, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিকদের ভণ্ডামি ও তৎকালীন প্রশাসনের বর্বরতা, যারা উদ্দীপ্ত যৌবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি। দেখতে পাওয়া যায় এমন এক সমাজ, যেখানে তরুণদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার নেই। এর বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করে, তাদের স্থান হয় ‘হাজার চুরাশি’র কোনো এক জায়গায়।

উপন্যাসের লেখক মহাশ্বেতা দেবী; Image Source: Feminism in India

‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক, যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে উপন্যাসের প্রতিটি জায়গায়।

সুজাতা

জ্যোতি, ব্রতী, নিপা, তুলির স্নেহময়ী জননী, যার একমাত্র কাজ ছিল পরিবারের সবার চাহিদা পূরণ করা। সে জন্ম দেয় চারটি সন্তান। তাকে নীরবতার সাথে সহ্য করতে হয়েছে স্বামী ও শ্বাশুড়ির অত্যাচার। এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তার পাশে কাউকে পায়নি সে। না স্বামী, না শ্বাশুড়ি। তবে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে গিয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে সুজাতা। কিন্তু ততক্ষণে তার আশ্রয়ের একমাত্র বস্তুটি কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। সুজাতাকে পরিচয় বহন করতে হয়েছে ‘হাজার চুরাশি’র মা হিসেবে।

সময় নামক জাহ্ণবী তার শোক নামক বেলাভূমিতে আস্তে আস্তে পলির সঞ্চার করতে থাকে।

সে রাতের অন্ধকারে স্বপ্নের মধ্যে কাছে ডাকে তার ‘হাজার চুরাশি’কে। সে দিনের আলোয় খুঁজে ফেরে তার ‘হাজার চুরাশি’কে। কিন্তু তার ‘হাজার চুরাশি’কে আর পাওয়া হয় না। ‘হাজার চুরাশি’কে খুঁজতে খুঁজতে সুজাতা ঢলে পড়ে জীবনের অন্তিম মুহূ্র্তে।

ব্রতী

পুঁজিবাদের কালো ছায়া যখন সমাজকে রাহুগ্রাস করে নিতে শুরু করেছে, ধনিক শ্রেণী গরীবদের শোষণ করে আরো ধনীতে পরিণত হচ্ছে, যখন তরুণেরা তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে, ঠিক তখনই সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রতীর আবির্ভাব।

ব্রতী সুজাতার চার সন্তানের একজন। সে ছিল প্রচণ্ড মাতৃভক্ত। কিন্তু মায়ের নীরবে অত্যাচার সহ্য করার প্রচণ্ড বিরোধী ছিল। সুজাতার সাথে এমনভাবে কথা বলতো যেন সুজাতাই ব্রতীর সন্তান। মা ছাড়া পরিবারের সবাই তার কাছে ঘৃণার বস্তু ছিল। কারণ, তার পরিবারের মানুষদের অর্থলোভ, বিকৃত যৌনতা, বিলাসবহুল জীবন, মেনে নিতে পারেনি ব্রতী। শুধু পরিবার না, গোটা সমাজের বিরুদ্ধে এই একই প্রতিক্রিয়া কাজ করতো তার। আর এজন্য ব্রতী যোগ দেয় সশস্ত্র সংগ্রামে।

কিন্তু কেউ কেউ যে দলের সব তথ্য ফাঁস করার জন্য দলে যোগদান করে একথা তখনও বুঝতে পারেনি ব্রতী।

যার কারণে ব্রতী ও তার চার বন্ধুর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আর ব্রতীদের স্থান হয় ‘হাজার চুরাশি’তে। সমাজ শুধু তার জীবন নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, নিজস্ব বাড়িতে তার সব স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ছিল বদ্ধপরিকর। ব্রতী কথিত ধনিক শ্রেণীর বিলাসবহুল জীবনযাপন মেনে নিতে পারত না, মেনে নিতে পারত না তাদের নোংরামিকে। এজন্য নিজের বাবার সাথে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যেখানে তার ভাইবোনেরা ছিল অন্ধ পিতৃভক্ত। তারা তাদের পিতার বিকৃত যৌনকামনাকে পুরুষত্ব বলে দাবি করত। কিন্তু ব্রতী তা মেনে নেয়নি। আর সেই পুরস্কারস্বরূপ ব্রতী পায় মৃত্যু ও মৃত্যুর পর পরিবার কর্তৃক তার শেষ স্মৃতিটুকু নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা। এভাবেই ব্রতী থেকে যায় ‘হাজার চুরাশি’ হিসেবে।

প্রচ্ছদ

দিব্যনাথ

দিব্যনাথ ছিল ব্রতীর পিতা ও সুজাতার স্বামী। এ মানুষটি সমাজের তথাকথিত উঁচু শ্রেণীর একজন প্রতিনিধি, যার ছিল বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা। সুজাতার সাথে তার সম্পর্ক ছিল যৌনকার্য সম্পাদনের বস্তুর মতো। যখন দিব্যনাথ উগ্র যৌনতা অনুভব করত, শুধু তখন সে সুজাতাকে কামনার স্বরে ডাকত। এর বাইরে সুজাতার সাথে তার কোনো মানবিক বা মানসিক সম্পর্ক ছিল না। এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়ও সে সুজাতার পাশে ছিল না। সে নিজেকে তার পরিবারের প্রভু হিসেবে দাবি করত। এজন্য ব্রতী তাকে ‘বাবা’ বলার পরিবর্তে ‘বস’ বলত।

সুজাতার বাইরেও দিব্যনাথের অনেক নারীর সাথে সম্পর্ক ছিল। যাদের সাথে দিব্যনাথ যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতো। দিব্যনাথের এই বিকৃত যৌনতার অনেক অন্ধভক্ত ছিল, যারা তার যৌনতাকে পুরুষত্ব বলত। একদিন ব্রতীর হাতে ধরা পড়ে দিব্যনাথ, আর তখন থেকেই দিব্যনাথের সাথে ব্রতীর দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

নন্দিনী

‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে বিপ্লবী নারী চরিত্র হলো নন্দিনী। যে চেয়েছিল একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। একপর্যায়ে ব্রতীর সাথে সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাদের দুজনের মধ্যে ছিল অগাধ বিশ্বস্ততা। কিন্তু ব্রতী আর নন্দিনী তাদের দলের অন্যদের বিশ্বাস করতে ভুল করেছিল। যার কারণে ব্রতীর জীবন প্রদীপ নিভে যায় এবং নন্দিনীকে কারাবরণ করতে হয়। আর সেখানে সহ্য করতে হয় অকথ্য শারীরীক নির্যাতন। কিন্তু, এর পরও নন্দিনী বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। সে এখনও তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বদ্ধপরিকর।

সমু, বিজিত, পার্থ, লালটু

এরা ছিল ব্রতীর বিপ্লবী বন্ধু। যারা প্রত্যেকেই তাদের পরিবারের নয়নের মণি ছিল, ছিলো মেধাবী ছাত্রও। তারা চেয়েছিলে সমাজটাকে বিনির্মাণ করতে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। তাদের ‘হাজার চুরাশি’র তালিকায় পড়ে থাকতে হয়। তাদের নিথর দেহ পড়েছিল লাশকাটা পুকুরের ধারে, তারপর পুলিশের মাধ্যমে শ্মশানে । তাদের আখ্যা দেয়া হয় সমাজবিরোধী হিসেবে। দেশের কোনো স্মৃতিফলকে স্থান হয়নি তাদের। শুধু তা-ই নয়, তাদের পরিবারের স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেনি সমাজপতিরা।

নক্সাল আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটি; Image Source: Open magazine

হেম

মায়ের পর এই মানুষটি একমাত্র আপন ছিল ব্রতীর। যে ব্রতী পরিবারের কারো সাথে কথা বলত না, সেই ব্রতীর সাথে সমাজের এই শোষিত মানুষগুলোর এত সুসম্পর্ক- তা সুজাতাও জানতো না। কিন্তু পুঁজিপতিরা তার এই সম্পর্ককে মেনে নেয়নি। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ব্রতীর জন্মদিনে হেম শোকে ভেঙে পড়লে তাকে শুনতে হয় অকথ্য গালাগালি।

‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে আরও রয়েছে এক দরিদ্র মায়ের পুত্রের জন্য হাহাকার, এক অসহায় বোনের ভাইয়ের জন্য আহাজারি। আছে বিপ্লবের উত্থান-পতন, বিপ্লবীদের চাওয়া-পাওয়া, কিছু ‘সহযোদ্ধা’র বিশ্বাসঘাতকতা। আছে এক শোষিত নারী, এক শোকাতুর মা, যে কি না সারাক্ষণ হাতড়ে বেড়ায় তার প্রিয় সন্তান ‘হাজার চুরাশি’কে। আর এজন্য ‘হাজার চুরাশির মা’ টিকে থাকবে পৃথিবীর অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত।

বইয়ের নাম: হাজার চুরাশির মা || লেখক: মহাশ্বেতা দেবী

প্রকাশক: করুণা প্রকাশনী || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম

This article is in Bangla language. This is a review on a novel named 'Hajar Churashir Maa' written by prolific writer Mahashweta Debi.

Featured Image: amarboi.com

RB/AC

Related Articles

Exit mobile version