আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকায়। শৈশবের ফাঁকা ঢাকা শহর, দিনের ব্যস্ততা, রাতের সোডিয়াম লাইট ইত্যাদির সাথে তুলনা করে এখনের ঢাকার জীবন দুর্বিষহ মনে হয়। অনিঃশেষ যানজট, হুল্লোড় চিৎকারে তৈরি হওয়া বিরক্তি টেনে নিয়ে যায় শৈশবের সেই স্মৃতিময় ঢাকায়। এর থেকেই সম্ভবত আগ্রহ তৈরি হয়েছে পুরোনো দিনের ঢাকা সম্পর্কে। একাডেমিক তথ্যের চাপে নিরস হয়ে ওঠা বই নয়, অতীতের জানালা হিসেবে আমি খুঁজেছি আত্মজৈবনিক রচনার মতো স্বাদু জিনিস। কারণ, মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভালবাসে, তাই দু’মাস ভাড়া থাকা বাড়ি হয় ‘আমার’ পুরোনো বাড়ি। চাকরিজীবনের অ্যাপ্রেন্টেসি করা অফিস লোকে আঙুল উচিয়ে নির্দেশ করে “ঐ আমার প্রথম রুজির জায়গা”। এহেন মানুষ যখন আত্মজীবনী লিখতে বসে, সেটা হয় রসের দোকান। আপনমনে নিজেকে মেলে ধরে মানুষ সেসব রচনায়।
শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর দিয়ে শুরু, সেখানে পুরোনো ঢাকার একটা খণ্ডিত কিন্তু মোহময় রূপ পাওয়া যায়। তারপর মহিউদ্দিন খানের জীবনের খেলাঘরে, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘বহে জলবতী ধারা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘আত্মজৈবনিক’, আর সবশেষ সৈয়দ আলী আহসানের ‘জীবনের শিলান্যাস’।
এঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু সকলের চেয়ে আলাদা। গত শতকের তৃতীয় দশকের জীবনটাই মূলত বুদ্ধদেব বসুর রচনায় ধরা আছে। ব্যক্তি বুদ্ধদেবের মতো তার এসব রচনাও একান্ত নিজের জগতেই সীমাবদ্ধ, যার পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আসে সেকালের বর্ধিষ্ণু ঢাকা পুরানা পল্টনের মফস্বলি চিত্র। আর এই আলোচনা কেবলই আত্মজৈবনিকের মতো রচনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার সকল ধরনের রচনায় প্রসঙ্গ হিসেবে ঢাকা উঁকি দিয়ে গেছে। কবিতায় ‘একখানা হাত’, ‘কোন মেয়ের প্রতি’, গল্পে ‘তারা তিনজন’, উপন্যাসে ‘মৌলিনাথ’ এমনকি হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে প্রথম প্রবন্ধই ‘পুরানা পল্টন’ নামে।
এই দুই ব্যক্তিগত কথাকারের বাইরে আর যে তিনজনের সঙ্গে আমার পরিচয়, তারা এমন নিজের জগতে বন্দী নন। বরং তাদের আত্মজীবনীতে বাইরের কথা, বিপুল কলরোলে ঘেরা কর্মময় যৌবনের কথা এত পরিমাণে এসেছে যে, সেখান থেকে ব্যক্তিগত বলে আলাদা কিছু নির্ণয় করা মুশকিল।
মহিউদ্দিন খান ‘জীবনের খেলাঘরে’তে পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশে যে ইসলাম কেন্দ্রিক ‘ধর্মীয়’ সাহিত্য গড়ে ওঠে, তার পুরোধা হিসেবে নিজ ও দেশের তৎকালীন সামাজিক কর্মগুলোকে তুলে এনেছেন। আর আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এনেছেন এরই সমান্তরালে মুসলিম সাহিত্যের যে আকৃতি সে সময় দাঁড়াচ্ছিল, তাকে। কোনো কোনো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে অবশ্য তাদের দুজনকে বিপরীত ভূমিকায় আবিষ্কার করা যায়, যেমন ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গ।
এই দুই ভূমিকার বাইরে সমন্বিতভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের যে ব্যাপক জীবন, তার প্রাণস্পন্দন টের পাওয়া যায় সৈয়দ আলী আহসানের জীবনের শিলান্যাসে। সদ্য গঠিত বাংলা একাডেমি, নাট্য আন্দোলন, আর্ট স্কুল, অভিধান প্রণয়ন, ইসলামি বিশ্বকোষ, আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগত ইত্যাদি মিলিয়ে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকার পরিচয়ের শুরুর দিনগুলোতে আলী আহসানের নাম অনস্বীকার্য। এমনকি তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক থাকাবস্থায় ডক্টর শহীদুল্লাহের মতো মানুষের সাথে কাজ করেছেন, যা নিয়ে জল ঘোলা করাও চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেছিলেন,
আমি আমার ছাত্রের অধীনে নয়, আদর্শের অধীনে কাজ করি।
পাকিস্তান আমলের মতো একটি সময়ে যখন ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ইসলাম ব্যবহারের একটা ধারা চলছে, সেই সময়ে বাংলাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হওয়ার পেছনে কাজ করেছে সৈয়দ সাহেবের পারিবারিক ঐতিহ্য ও তার মানসিক শিক্ষা। সুফি ঘরানার পরিবার থেকে উঠে আসা সৈয়দ আলী আহসান পেয়েছিলেন মমতা ও উদারতার একটি ঐশ্বর্য, যার কথা তিনি বারবার লিখেছেন, আর সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল প্রকৃতিপ্রেমের মতো মানবিক বৈশিষ্ট্য।
প্রকৃতির স্বাভাবিক কোমলতা তার সারাজীবনের সাহিত্যচর্চা ও কর্মজীবনে প্রভাব রেখে গেছে। এর ফলে তার কর্ম ও সাহিত্যজীবনের সারথী ও গুরুজনদের তালিকা ঈর্ষণীয় রকম বৈচিত্র্যময়। ড. শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওদুদ, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, মোহিতলাল মজুমদার, শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জসীমউদ্দিন, ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবু জাফর, কামরুল হাসান, জয়নুল আবেদীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ সহ ভিনদেশিদের মধ্যে ক্লেয়ার গল, পিয়ের এমানুয়েল, জন স্টেইনবেক, আরবার্তো মোরাভিয়া প্রমুখ।
এই বিপুল জনারণ্যের মাঝেও জীবনের শিলান্যাসে আলী আহসান নিজের আরেকটি পরিচয় তুলে ধরেছেন, যা একাকী শান্ত একজন ব্যক্তির জগত। তাই এই আলোচনায় বারবার এনেছেন জনতার মাঝে নির্জনতার প্রসঙ্গ। পারিবারিক সুফি ধ্যান-ধারণায় খোদাপ্রেম, ফরাসি বান্ধবী ক্লেয়ার গলের সান্নিধ্যে রমণীয় প্রেম আর বিভিন্ন নগর ও ব্যক্তির বরাতে শিল্প-সাহিত্যে নিজস্ব বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে প্যারিস আর সেখানের বিশ্ববিখ্যাত প্রেমিকা ক্লেয়ার গলের জবানিতে প্রেমের সুলুক সন্ধান করেছেন বহুবার।
‘বিশ্ববিখ্যাত প্রেমিকা’ কথাটা মজার হলেও এটি আহসান নিজেই ব্যবহার করেছেন, কারণ ক্লেয়ার গল ছিলেন একইসাথে পাবলো পিকাসো, মায়াকোভস্কি, মার্ক শাগাল, দেলোনো আর ইভান গলের প্রেমিকা। যাদের মধ্যে ক্লেয়ার গল পরিণীতা হয়েছিলেন ইভান গলের, আর বিরহে আত্মহত্যা করেছিলেন সমবয়সী মায়াকোভস্কি।
আহসানের সাথে ক্লেয়ারের প্রথম দেখা হয়েছে অবশ্য বিগতযৌবনে, ততদিনে ক্লেয়ার গল বেঁচে আছেন মৃত সঙ্গী ইভান গলের স্মৃতি নিয়ে। কবরখানার পাশে একটি ফ্ল্যাটে বাস করেন, যার জানালা খুললে ইভানের কবর দেখা যায় আর প্রতিদিন সকালে একটি প্রজাপতি এসে বসে ক্লেয়ারের জানালায়। যেন স্মরণ করিয়ে দেয় পাশেই শুয়ে থাকা মৃত দয়িতের, যে কবরখানা সম্পর্কে ভিক্টর হুগো বলেছেন, এখানে সমাহিত হওয়াও মর্যাদার।
প্যারিসের পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লেয়ারের মুখে আহসান শোনেন প্রেমের সংজ্ঞা, প্রেম হচ্ছে আমাদের হৃদয়ের বিস্ময়, শরীরের উৎকণ্ঠা, বুদ্ধিমানের কৌতুকস্পর্শ এবং বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির শব্দ। প্রেম ক্ষুদ্রকে গ্রহণ করে না, মহৎকে গ্রহণ করে। প্রেম হচ্ছে সূর্যের অভ্যুদয়ের মতো৷ তাই প্রেম বোঝাতে ফরাসিতে ব্যবহার হয় ‘আমুর’, যার অর্থ একইসঙ্গে স্নায়ু চৈতন্য, মাধুর্য, লীলা, বিলাস, আনন্দ ইত্যাদি সকল কিছু। আহসান একে তুলনা করেছেন সংস্কৃত ‘রতি’র সাথে।
এই ফরাসিনীর সাথে আহসানের সম্পর্ক ছিল বহু বছর, প্যারিসে গেলে যতটা সময় সম্ভব এঁর সান্নিধ্যে ব্যয় করতেন, পার্কে সিনেমায় আড্ডায় সঙ্গী হতেন। আটান্নোতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ক্লেয়ারের অনুরোধে ইভান গলের কবিতাও অনুবাদ করেন।
সৈয়দ আলী আহসান নিজের কবিতায় এবং শিল্পচেতনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন প্রকৃতি দ্বারা। বসন্ত, বৃষ্টি, নীরব প্রকৃতি এসবের সারল্য, সতত পবিত্রতা তার কাব্যে ছাপ রেখে গেছে। নিজের যৌবনকে আবিষ্কার করেছেন প্রকৃতিতে; তার ভাষায়,
“মানুষ যৌবনকে কখন কীভাবে আবিষ্কার করে বলা কঠিন। পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করে আমার মনে হচ্ছে, আমি বৃষ্টির মধ্যে যৌবনকে অনুভব করেছি। অতীতের অনুভূতিগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে গিয়ে এভাবেই যৌবনকে বারবার আবিষ্কার করেছি।
একজন কবি অনন্ত সময় ও কালের বিস্তারের মধ্যে বসবাস করে, তাই তাকে বেদনার অনুকম্পন আবিষ্কার করতে হয়। এ বেদনা স্মৃতির মধ্যে যতটা বিকশিত, জীবনের বর্তমান বা ভবিষ্যতের মধ্যে ততটা প্রবাহিত নয়। প্রভাতের অরুণশ্রেণির সুন্দরতার মত সমস্ত প্রাচীন বেদনা এবং ঘটনা কবির চিত্তে নতুন উপলব্ধির ব্যঞ্জনায় জাগ্রত হয়। যে উন্মুক্ত প্রকৃতিকে বিশেষ পরিমণ্ডলে আমি ভালোবেসেছিলাম, তাকে কখনও হারিয়ে ফেলতে চাই না।”
প্রকৃতির আবেগময়তাকে সঙ্গী করলেও শিল্প বিচারে সেটাকেই কেবল একমাত্র নির্ণায়ক বানাননি। তার নিকট শিল্প ও সৌন্দর্যের অর্থ হলো প্রকাশময়তা। একজন সার্থক শিল্পী তার শিল্পকর্মে বোধ ও সিদ্ধান্তের মহত্তম প্রকাশ করতে পারবেন। এই প্রকাশ করতে সক্ষম হওয়া না হওয়ার বিবেচনায়ই তার কাছে কোনো শিল্প কালজয়ী ও সার্থকতার মর্যাদা পায়।
একজন অধ্যাপক, গবেষক, শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধা বিদ্বান মানুষ হিসেবে সৈয়দ আলী আহসানের এই আত্মজৈবনিক রচনা একইসঙ্গে তথ্যবহুল, উপাদেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতির উত্থানের দিনগুলোকে বুঝতে হলে এই রচনা আমাদের পথ দেখাবে, সন্দেহ নেই।