কাহলিল জিব্রান একজন লেবানিজ-আমেরিকান লেখক। বলা হয়ে থাকে ইতিহাসে যাদের কবিতার বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে জিব্রান তার মধ্যে তৃতীয়। তার আগে আছেন শেক্সপিয়ার ও লাওজি। তিনি একাধারে কবি ও অসাধারণ চিত্রশিল্পী। তার ‘দ্য প্রফেট’ সাহিত্য ইতিহাসের সাড়া জাগনো একটি বই। এই বই এ পর্যন্ত মোট চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯২৩ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। জিব্রানের এ বই এখনো এক বিস্ময়ের নাম। সবার কাছেই এক চমক। এত বছর পরেও এই বইয়ের আবেদন একটুও কমেনি।
বইয়ের মূল চরিত্র আল-মুস্তাফা। তিনি বারো বছর ধরে অপেক্ষা করছেন তার জাহাজের যাতে করে তিনি তার স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন। এই বারোটি বছর তিনি কাটিয়েছেন ওরফেলিসে। আল-মুস্তাফার একাকী সময়, দুঃখের সময়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ঐ দেশের মানুষ ও মাটি। একদিন পাহাড়ের উপর উঠে তিনি তার জন্য আসা জাহাজকে দেখতে পেলেন। জাহাজে তার স্বদেশী মানুষেরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তার মন আনন্দে ভরে উঠলো। আবার একইসাথে তাকে বিষণ্ণতায়ও ঘিরে ধরলো। কারণ এই বারো বছরে তিনি ওরফেলিসের জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাই বিদায় বেলায় এই দুঃখ তাকে জর্জরিত করে ফেলে।
“আমার আত্মার কত না ক্ষুদ্র অংশ আমি এই নগরীর পথে পথে ছড়িয়ে দিয়েছি, …আমি ব্যথিত এবং ভারাক্রান্ত না হয়ে কীভাবে তাদের ছেড়ে ফিরে যাব?”
আল-মুস্তাফার জাহাজের খবর পেয়ে ওরফেলিসের জনগণ একে একে তার কাছে চলে আসে। সবাইকে দেখে আল-মুস্তাফা নিজেকে বলে,
“বিরহের দিন কি তবে মিলনেরও দিন?”
মানুষজন সবাই একে একে মুস্তাফার কাছে আসেন এবং তাকে যেতে নিষেধ করেন। বিদায় বেলায় যেন আপনজনের মাহাত্ম্য আরও স্পষ্ট করে ফুটে ওঠে,
“চিরকাল এমনই হয়েছে, বিচ্ছেদের মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত ভালোবাসা তার গভীরতা বুঝতে পারে না।”
সবশেষে আলমিত্রা এগিয়ে আসে। ওরফেলিসে মুস্তাফা যেদিন প্রথম এসেছিলেন তখন আলমিত্রাই তাকে প্রথম দেখেছিলেন এবং বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি আল-মুস্তাফাকে তার স্বদেশে ফিরে যেতে বলেন। কারণ মুস্তাফার সব আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে তার স্বদেশ জড়িয়ে আছে। কিন্তু যাওয়ার আগে মুস্তাফাকে তার সত্য উপলব্ধি দিয়ে যেতে বলেন। যাতে ওরফেলিসের জনগণ সেই সত্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দিয়ে যেতে পারে। তখনই মুস্তাফা একে একে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার আত্মোপলব্ধি ও অন্তর জ্ঞান বর্ণনা করতে থাকেন।
ভালোবাসা
প্রথমেই আলমিত্রা তাকে অনুরোধ করলেন ভালোবাসা নিয়ে বলতে। তিনি শুরু করেন,
“ভালোবাসা যখন তোমাকে ইশারা করে, তখন তার সঙ্গে তোমার চলার পথ কঠিন এবং বন্ধুর হলেও তুমি তাকে অনুসরণ করো।”
ভালোবাসা যদি কাউকে ক্ষতবিক্ষত করে তবেও তার ভালোবাসা উচিত। কারণ ভালোবাসার উদ্দেশ্য শুধু সুখ দেওয়া নয়। ভালোবাসা উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন আমাদের হৃদয়ের রহস্য বুঝতে পারি। এজন্য সে আমাদের গড়ে তোলে। আবার ভেঙ্গেচুরে আমাদের সেই প্রাসাদ ধ্বংস করে দেয়।
“কারণ ভালোবাসা তোমাকে যেমন রাজমুকুটে ভূষিত করে, তেমনই সে তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করে। সে যেমন তোমার বৃদ্ধি ঘটায় তেমনি সে তোমাকে ছেঁটেও দেয়।”
কিন্তু কেউ যদি শুধু ভালোবাসার সুখটুকু পেতে চায় কিন্তু কষ্টটুকু বরন করতে না চায়, তাহলে আল মুস্তাফা তথা জিব্রানের ভাষায়,
“তুমি হয়তো হাসবে কিন্তু প্রাণ খুলে হাসবে না, তুমি হয়তো কাঁদবে কিন্তু প্রাণ ভরে কাঁদবে না।”
ভালোবাসাকে কখনো দিক নির্দেশনা দিতে নেই। বরং ভালোবাসার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। তাহলে ভালোবাসা আমাদের পথ দেখাবে।
বিবাহ
এরপর আল মুস্তাফা বিবাহ নিয়ে কথা বললেন। তিনি বলেন, স্বামী স্ত্রী সবসময় একত্রে আছে এবং একত্রে থাকবে। আমাদের পরস্পরকে ভালোবাসা উচিত কিন্তু এই ভালোবাসার মাঝেও একটা দূরত্ব প্রয়োজন। যেন এর মাঝে স্বর্গীয় বাতাস বইতে পারে। আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে ভালবাসবো কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করবো না। তাকে তার সুরে গাইতে দেবো, তার লয়ে নাচতে দেবো। যাতে দুটি সতন্ত্র ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে তাদের ভালোবাসার সৌরভ ছড়ায়।
“তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, কিন্তু ভালোবাসার বন্ধন গড়ে তোলো না,
বরং তোমাদের ভালোবাসা হোক দুটি হৃদয়ের বেলাভূমির মাঝে এক উচ্ছ্বসিত সমুদ্র।”
সন্তান
জিব্রান এই কবিতার শুরুতেই বলেন, “তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়”। বাবা মার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো তার সন্তান। কিন্তু বাবা মা তার সন্তানকে তার দেখা স্বপ্ন অনুসারে পরিচালিত করতে চান। যেমন ধরা যাক, বাবা মার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হবে কিন্তু হয়তো তার সন্তান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়। এভাবে অভিভাবক তার সন্তানকে তাদের পথে পরিচালিত করতে চান। এতে করে সন্তান তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। জিব্রানের মতে সন্তানকে পিতামাতার চিন্তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সন্তানের জন্য পিতামাতার ভালোবাসাই যথেষ্ট।
“তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়,
তারা জীবনের জন্য জীবনের আকুল প্রত্যাশার পুত্র-কন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, কিন্তু তোমাদের ভেতরে জন্ম নেয় না।
এবং যদিও তারা তোমাদের সঙ্গে থাকে তারা তোমাদের সম্পদ নয়।”
পিতামাতারা হলেন তীরের ধনুকের মত। আর সন্তানরা হলো সেই ধনুক থেকে বের হয়ে যাওয়া তীর।
দান
আমরা আমাদের বৃহৎ সম্পদ থেকে ক্ষুদ্র অংশ দান করি। সেই দান আসলে দান নয়। আত্মোৎসর্গই হলো সবচেয়ে বড় দান। আমরা আসলে সত্যিকারের দাতা নই। ঈশ্বর বা প্রকৃতিই হলো সত্যিকারের দাতা।
“সত্য এই, জীবন জীবনকে দান করে এবং তুমি যদিও নিজেকে দাতা মনে কর, তুমি আসলে দানের সাক্ষী মাত্র।”
খাদ্য ও পানীয়
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অন্য জীবের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে সেই জীব না চাইলেও হত্যা করতে হয়। নবজাতক গরুর বাছুরকে তার মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত করতে হয়। জিব্রান বলছেন, তাই আমাদের খাওয়া দাওয়া হওয়া উচিত উপাসনার মতো।
“তোমার ভোজনের স্থান হোক মন্দিরের বেদী। অরণ্য ও সমভূমির নিষ্পাপ এবং নিরীহ সন্তানেরা মানুষের অন্তরের আরও নিষ্পাপ এবং আরও নিরীহ সত্ত্বার উদ্দেশ্যে নিজেদের সেখানে উৎসর্গ করুক।”
কারণ প্রকৃতির যে নিয়মে জীবরা আমাদের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে আমরাও সেই নিয়মের অধীনেই মারা যাবো। মানুষ ও বাকি জীব সবাই এক মহান সত্ত্বার উদ্দেশ্যের মাধ্যম মাত্র।
কর্ম
মানুষ যখন কাজ করে সে এই ধরণীর সাথে একাত্ম হয়ে পড়ে। কাজ না করলে সে পৃথিবীর ছন্দ থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। একজন মানুষ যখন কাজ করে তখন সে তার জন্য যে কাজ প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছে তা সে পূর্ণ করে। কাজ করতে হবে ভালোবাসার সাথে। এমনভাবে যেন হৃদয় থেকে সূতা বের করে সে সূতা দিয়ে প্রিয়তমার জন্য কাপড় বানানো হচ্ছে। জিব্রান কর্মকে ব্যাখ্যা করেছেন অসম্ভব সুন্দরভাবে,
“এবং আমি বলি, আকাঙ্ক্ষাহীন জীবন আসলেই অন্ধকার,
এবং জ্ঞানহীন যত আকাঙ্ক্ষা সকলই অন্ধ,
এবং কর্মহীন যত জ্ঞান সকলই বৃথা,
এবং ভালোবাসাহীন যত কর্ম সকলই নিষ্ফল।”
সুখ ও দুঃখ
সুখ ও দুঃখ পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুখ ও দুঃখের উৎপত্তি একই জায়গা থেকে। এক সময়ের দুঃখের কারণগুলোই সুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার যখন আমাদের মন দুঃখে ভারাক্রান্ত থাকে তখন নিজের ভেতরে তাকালে দেখা যাবে আমাদের এক সময়ের সুখের কারণই আমাদের দুঃখ দিচ্ছে। তাই সুখ বা দুঃখ কেউ কারো চেয়ে মহান নয়।
“তারা একত্রে আসে এবং তাদের একজন যখন একাকী এসে তোমার সঙ্গে একাসনে বসে, তুমি মনে রেখ, তখন অপরজন তোমার শয্যায় শুয়ে আছে।”
গৃহ
আমাদের ঘরবাড়িগুলো এখন কেবল ইট পাথরের দেয়াল। এতে কোনো প্রাণ নেই। কিন্তু এরকমটি হওয়ার কথা ছিল না। কারণ আমাদের গৃহ আমাদের বৃহত্তর দেহ। তাই আমাদের দেহের মতো আমাদের গৃহও হতে হবে প্রকৃতির সাথে যুক্ত। আমরা আয়েশের জন্য ইট পাথরের দালানে আবদ্ধ থাকতে চাই। কিন্তু তা আমাদের হৃদয়ের উচ্চাশাকে হত্যা করে।
“নগর-প্রাচীরের ভেতরে গৃহনির্মাণ করার পূর্বে তুমি নির্জন অরণ্যে গিয়ে তোমার কল্পলোকের এক কুঞ্জ রচনা কর, কারণ গোধূলি বেলায় তোমার ঘরে ফেরার মতো তোমার অন্তরের দিশাহীন পথিকও ফিরতে চায়।”
পোশাক
আমরা পোশাক পরি শালীনতা রক্ষার জন্য। কিন্তু আমাদের শরীর প্রকৃতির খোলা বাতাস চায়। জিব্রান বলছেন, অসচ্চরিত্র লোক থেকে বাঁচার জন্যই পোশাক। যদি অসচ্চরিত্র লোক না থাকে তাহলে পোশাকের কোনো দরকার নেই বরং তা তখন অন্তরকে অপরিচ্ছন্ন করবে।
“এবং তোমরা এ কথাটি ভুলে যেও না, এ মাটি তোমাদের নগ্ন পায়ের স্পর্শে পুলকিত হয় এবং বাতাস তোমাদের কেশ নিয়ে খেলা করতে চায়।”
ক্রয়বিক্রয়
এই পৃথিবী প্রাচুর্যময়। যদি নেওয়ার জ্ঞান থাকে এবং সাথে থাকে পরিশ্রম তবে এই ধরণী কাউকেই ফেরায় না। অনেকেই আছে কাজ না করে কথার মাধ্যমে কার্য সাধন করতে চায়। কিন্তু কাজই পারে একমাত্র প্রাচুর্য দিতে। আর আমাদের উচিত পৃথিবীর দান সবার মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেওয়া। যদি লোভ লালসা আমাদের ঘিরে ফেলে তবে সবাই সমান অধিকার পাবে না। মানুষ বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হবে।
অপরাধ ও শাস্তি
এরপর এক বিচারক বললেন অপরাধ ও শাস্তি সম্বন্ধে বলার জন্য। মানুষের মধ্যে একই সাথে দেবতা এবং অসুরের বসবাস। কেউ অপরাধ করলে এটা বলার সুযোগ নেই যে তুমি অন্য জাতের মানুষ। মানুষ যত খারাপই করুক না কেন তা করার ক্ষমতা মানুষের প্রত্যেকের নিজের মধ্যেই আছে। আবার ভালো কিছু করার ক্ষমতাও মানুষের নিজের মধ্যে আছে। ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ আসলে একই সুতোয় বাঁধা। জিব্রানের ভাষায়,
“নিহত ব্যক্তি তার হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্ত নয়।
হ্রত ব্যক্তি অপহরণের দায় থেকে মুক্ত নয়।
ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি মন্দজনের দুষ্কর্মের দায় থেকে মুক্ত নয়।
যার হাতে রক্তের দাগ নাই সেও দুর্বৃত্তের নৃশংস অপরাধের দায় থেকে মুক্ত নয়।”
আইন
আমরা আইন বানাতে পছন্দ করি। কিন্তু আইন ভাঙতে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমরা অনেকসময় নিজের সীমাবদ্ধতাকে আরেকজনের জন্য আইন হিসাবে উপস্থাপন করি। কিন্তু যদি আলোর পথে থাকি কোনো আইনই আমাদের জন্য প্রয়োজন নেই। আলোর পথে মুক্ত বিহঙ্গের মতো চলার ক্ষেত্রে কোনো আইনই আমাদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
স্বাধীনতা
স্বাধীনতা বলতে সবকিছু থেকে মুক্তি বুঝায়। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা লাভের পরম ইচ্ছাকেই নিজেদের শৃঙ্খল বানিয়ে নিই। আমরা এই শৃঙ্খল থেকে তখনই মুক্তি পাবো যখন স্বাধীনতার পরম আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা আমাদের হৃদয়কে মুক্তি দিতে পারবো। আমরা ভীতি থেকে স্বাধীনতা চাই। কিন্তু যাকে আমরা ভয় করি ভয় তার মাঝে নেই। বরং আমার হৃদয়ে আছে বলেই তাকে দেখে ভয় জাগ্রত হয়। স্বৈরাচারী শাসক কোনো আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন মানুষের উপর ক্ষমতা চাপাতে পারে না। তাই আমরা যদি ভয় থেকে মুক্তি চাই, স্বৈরাচারী শাসক থেকে মুক্তি চাই তবে আমাদের হৃদয়ে জড়িত এসবের শৃঙ্খল থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে।
যুক্তি ও আবেগ
যুক্তি ও আবেগ যেন আমাদের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ সৃষ্টি করে। জীবনে আমাদের প্রায় এমন সময় আসে যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না আমরা কি মস্তিষ্কের কথা শুনবো নাকি হৃদয়ের। কিন্তু যুক্তির ধর্ম হলো স্থির আর আবেগ হলো দুরন্ত গতি। আমরা কেবল স্থিরতা দিয়েই গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তাই আমরা আবেগকে যুক্তি দিয়ে চালিত করবো।
বেদনা
আমরা যদিও বেদনাকে পছন্দ করি না বেদনা ঈশ্বরের দেওয়া এক চিকিৎসা স্বরূপ। আমাদের বেদনাকে আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করি আর ঈশ্বর বেদনা দিয়ে আমাদের সেই অন্তরের অসুখের চিকিৎসা করি। আমাদেরকে দুর্বলতাকে পুড়িয়ে ভেতর থেকে আমাদের হৃদয়কে জাগ্রত করে।
“ফলের হৃদয়কে সূর্যালোকে বের করে আনতে হলে তার আঁটিকে যেমন ভেঙ্গে যেতেই হবে, তেমনি তোমাদেরকেও বেদনার অনুভূতি লাভ করতেই হবে।”
আত্মদর্শন
আমাদের ভেতরকার আমি সবসময় সত্যকে জানে। কিন্তু তাও আমরা সত্যকে চোখের সামনে দেখতে চাই। মনের ভেতরে উপলব্ধ সত্যকে আমরা শব্দের দ্যোতনায় নিজ কানে শুনতে চাই। কিন্তু শব্দের মাধ্যমে হয়তো সত্যকে পুরোপুরি ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ হৃদয়ের গভীর সত্যকে কয়েকটি শব্দে ধারণ করা সম্ভব নয়। এজন্যই জিব্রান বলেছেন,
“তবে তুমি অজ্ঞাত ধনরত্ন ওজন করার জন্য নিক্তির সন্ধান করো না এবং তুমি তোমার জ্ঞানের গভীরতাও মাপদণ্ড কিংবা রশি ফেলে পরিমাপ করতে যেও না। কারণ তুমি অসীম এবং অপরিমেয় এক সমুদ্র।”
তাই তো জিব্রান বলেছেন, আমি সত্যকে পেয়েছি- এ কথা কখনো বলতে নেই। সকল সত্য অন্তরে নিহিত কিন্তু যখনই তা দৃশ্যমান জগতে প্রকাশের চেষ্টা করা হয় তখন তা পূর্ণ হিসেবে প্রকাশ পায় না। জিব্রানের ভাষায়,
“আমি সত্যকে পেয়েছি, এ কথা না বলে তুমি বরং বলো, আমি একটি সত্য পেয়েছি। আমি আত্মার পথ খুঁজে পেয়েছি একথা না বলে তুমি বরং বলো, আমি আমার চলার পথে আত্মার দেখা পেয়েছি। কারণ আত্মা সর্বপথগামী।”
আত্মা কোনো নির্দিষ্ট পথ মেনে চলে না। জিব্রানের ভাষায়, “আত্মা অসংখ্য পাপড়ি মেলা পদ্মের মতো বিকশিত হয়।”
শিক্ষাদান
শিক্ষক শিক্ষা দেবে আর ছাত্র শিখবে এটাই আমরা জানি। কিন্তু জিব্রান বলছেন প্রকৃতপক্ষে কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। বরং মনের মধ্যে যে সত্য সুপ্ত অবস্থায় আছে তা কেবল জাগ্রত করতে পারে। একজন শিক্ষক আসলে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন, এর বেশি কিছু নয়। তিনি তার নিজের অন্তরের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করেন।
“তোমাদের মধ্যে যা সুপ্ত আছে তা ছাড়া অন্যকিছু কেউ তোমাদের মধ্যে জাগ্রত করতে পারে না।”
তার মানে দাঁড়ায় যে জ্ঞান আমরা অর্জন করি তার বীজ আমাদের হৃদয়ে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শিক্ষক শুধু আমাদের সেই বীজকে জাগ্রত করার উপায় দেখিয়ে দেন। একজন জ্যোতির্বিদ তার জ্ঞান সবাইকে দিতে পারলেও তার মহাকাশ নিয়ে উপলব্ধি কাউকে দিতে পারেন না। জ্ঞানের এই উপলব্ধির জন্যে প্রত্যেকের নিজের চেষ্টা করতে হয়।
বন্ধুত্ব
বন্ধুত্ব হলো খুবই সুন্দর একটি সম্পর্ক। বন্ধু সম্পর্কে জিব্রান বলছেন, “তোমার প্রয়োজনে যার সাড়া পাও সে-ই তোমার বন্ধু।” বন্ধুত্ব কেবল চিন্তা ও কথাবার্তাতে নয় বরং নীরবতাও বন্ধুত্বের অংশ। বন্ধুরা নিজেদের মধ্যকার নিরবতার ভাষা বোঝে। কারণ এই নিরবতা থেকেই জন্ম নেয় সকল কিছু। শুধুমাত্র অবসর সময় কাটানোর জন্য যাতে বন্ধুত্ব না হয়। জীবনের জোয়ার ভাটার সবকিছুই বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। নিজের সেরাটাই আমাদের বন্ধুকে দেয়া উচিত। আর বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্কে আমাদের জীবন পূর্ণ হোক।
কথা বলা
নীরবতার এক নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু সবাই এই নীরবতাকে সহ্য করতে পারে না। কারণ এতে তাদের হৃদয় তাদের সামনে নগ্ন রূপে ধরা দেয়। তাই তারা নির্ভর করে কথার উপর। এজন্য তারা কথা বাৎসল বন্ধু কামনা করে। জিব্রানের ভাষায়,
“তোমরা যখন অন্তরের নীরবতায় বসবাস করতে পার না, তখন তোমরা মুখের মুখরতায় বসবাস করো।”
কারণ শব্দের একধরনের সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। শব্দ যেন অন্য ভুবনে নিয়ে যায়। তবে এমন মানুষও আছেন যারা নীরবতায় বসবাস করেন। যাদের সব কাজে তাদের আত্মাই কথা বলে। “তাদের বক্ষে ছন্দিত নীরবতায় আত্মার বসবাস।” তারা কথা বলার সময় তাদের আত্মাই কথা বলে। তাদের সকল কাজে আত্মার রং ছড়িয়ে পড়ে।
সময়
আমরা সময়কে নিজেদের সুবিধামত ভাগ করে নিই। মাস, বছর, সপ্তাহ, ঘণ্টায় সময়কে ভাগ করি। কিন্তু সময়কে কি আসলেই ভাগ করা যায়? জিব্রান বলছেন, ভালোবাসা যেমন অবিভাজ্য এবং অসীম সময়ও ঠিক তেমনি অসীম। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময়ের সময় আর এখনকার সময়ে কোনো পার্থক্য নেই। তার মানে দাঁড়ায় অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। “সময় কি ভালোবাসার মতো অবিভাজ্য ও নিশ্চল নয়?” আরযদি সময়কে ভাগ করতেই হয় তাহলে যেন প্রতিটা সময় অন্য সময়ের সাথে জড়িয়ে থাকে। “আজকের দিন অতীতকে স্মৃতি চারণায় এবং ভবিষ্যতকে প্রত্যাশায় আলিঙ্গন করুক।”
ভালো-মন্দ
নগর সভার এক লোক ভালোমন্দ সম্বন্ধে বলতে বললেন। তখন তিনি বললেন,
“আমি তোমাদের ভেতরের ভালো সম্বন্ধে বলতে পারি কিন্তু মন্দ সম্বন্ধে বলব না। কারণ মন্দ আপন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় পীড়িত ভালো ছাড়া আর কী? ভালো যখন ক্ষুধার্ত হয় তখন সে নিশ্চয়ই অন্ধকার গুহাগুলোতেও খাদ্যের সন্ধান করে এবং যখন সে তৃষ্ণার্ত হয় তখন সে বদ্ধ জলাশয়ের জল-পান করে।”
আসলে সকলের ভেতরেই ভালো আছে। কিন্তু সময় ও অবস্থা ভেদে সে ভালো থেকে দূরে সরে যায়। তাই বলে সে মন্দ হয়ে যায় না। যারা এভাবে ভালো থেকে দূরে সরে যায় তারা ভালোও নয়, মন্দও নয়। বরং তারা তাদের অবহেলার জন্য দিশা হারিয়েছে।
“তুমি অসংখ্য বিবেচনায় ভালো এবং তুমি যখন ভালো নয় তখন তুমি মন্দ নও। তুমি শুধু আলস্যে মন্থর হয়ে দিশা হারিয়েছো।”
যারা এভাবে পথ হারিয়েছে তারাও হয়তো একদিন পথ ফিরে পাবে। কিন্তু যারা এমনিতেই ভালো আছে তারা যেন দিশাহীনদের করুনা দেখাতে গিয়ে নিজেদের ভালো কাজের গতি কমিয়ে না দেয়।
“এবং সুস্থ সবল দ্রুতগামী মানুষেরা একথা স্মরণে রেখো, তোমরা দয়া দেখাতে গিয়ে বিকলাঙ্গদের সামনে খুঁড়িয়ে চলো না।”
যারা ভালো মানুষ তারা দুর্বল মানুষের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন করে না।
“প্রকৃত ভালো মানুষ বস্ত্রহীন মানুষকে ‘তোমার বস্ত্র কোথায়?’- এ প্রশ্ন করে না। কিংবা গৃহহীন মানুষকে ‘তোমার ঘরের কী হয়েছে?’ এ প্রশ্নও করে না।”
প্রার্থনা
আমাদের স্বভাব হলো আমরা যখন বিপদে পড়ি তখনই কেবল তাকে ডাকি, তার কাছে প্রার্থনা করি। কিন্তু আমাদের সুখের সময় কোনো প্রার্থনা করি না। কিন্তু আমাদের উচিত সুখ দুঃখ সবসময় প্রার্থনা করা। কারণ এতে আমরা আমাদের হৃদয়কে বিস্তৃত করি। “কারণ জীবন্ত ইথারে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া প্রার্থনা আর কী?”
প্রার্থনা করার সময় আমরা ঊর্ধ্ব আকাশে উঠে ঐ সময় যারা প্রার্থনা করছে তাদের সাথে একত্রিত হই। প্রার্থনা ছাড়া আমরা এই অচেনা মানুষগুলোর সাথে আর একত্রিত হতে পারি না। এর মাধ্যমে এক অদৃশ্য উপাসনালয়ের সৃষ্টি হয়। “অতএব এই অদৃশ্য উপসনালয়ের তোমার আগমন হোক শুধুমাত্র স্বর্গীয় আনন্দ লাভ এবং সু-মধুর জন্যে।”
কিন্তু কোনোকিছু চাওয়ার জন্য চাইলে তা মিলবে না। এমনকি নিজেকে বিনীত করার জন্য কিংবা মঙ্গল চাওয়ার জন্য আসলেও কেউ শুনবে না। দ্রষ্টা বলছেন, “তোমার জন্য অদৃশ্য উপাসনালয়ে প্রবেশ করাই যথেষ্ট।” কারণ স্রষ্টা আমাদের অন্তরের কথা আমাদের চেয়েও ভালো জানেন।
ভোগ-সুখ
আমরা ভোগ-সুখকে অনেকে খারাপ চোখে দেখি। জিব্রান বলছেন, সুখের প্রতি এই খোঁজের দরকার আছে। একজন যেমন শিকড়ের খোঁজ করতে গিয়ে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিল ঠিক তেমনি সুখের সন্ধান করতে গিয়ে মানুষ জীবনের গুরুতত্ত্বও লাভ করতে পারে। কিন্তু সেই সুখে জড়িয়ে পড়লে হবে না। দ্রষ্টার ভাষায়,
“সুখ এক মুক্তির জ্ঞান,
কিন্তু তা মুক্তি নয়
এ তোমার কামনার ফুলের বিকাশ;
কিন্তু এ তার ফল নয়।”
তাই আমাদের সুখের সন্ধান করা উচিত। কিন্তু তাতে একেবারে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
“তোমরা তোমাদের হৃদয় ঢেলে দিয়ে সে গান গাইলে আমি আনন্দিত হতাম, তবে আমি সে গানে তোমাদের হৃদয় হারিয়ে যেতে দিতাম না।”
কিন্তু তাই বলে সুখ-ভোগের দিনগুলোকে নিয়ে অনুতাপে ভোগা ঠিক নয়। কারণ এই সুখের অনুসন্ধানই তাকে জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে।
“অনুতাপ মনকে পরিচ্ছন্ন না করে তাকে মেঘাচ্ছন্ন করে।”
কারণ ভোগসুখকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। মনের কোনো কোনে তা ঘাপটি মেরে থাকবে। যার প্রকাশ হতে পারে আরও খারাপভাবে। তাই দ্রষ্টা বলেছেন, ভোগ সুখের ব্যাপারে মৌমাছি ও ফুলের মতো হওয়ার জন্য। যেখানে মৌমাছি ফুলের মধু খেয়ে সুখ পায় আর ফুলও তার মধু বিলিয়ে সুখ পায়।
সৌন্দর্য
সৌন্দর্য আমাদের সকলের কাম্য। কিন্তু সৌন্দর্য কী তা আমরা অনেকেই বুঝি না। এক একজন মানুষের কাছে সৌন্দর্য এক এক রকম। “আহত মানুষ বলে, সৌন্দর্য সদাশয় এবং শান্ত।” মানুষ তার নিজের অবস্থা অনুযায়ী সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করে। তুষারবন্দী মানুষের কাছে বসন্ত হচ্ছে সৌন্দর্য। গ্রীষ্মের গরমে যখন কৃষকেরা কাজ করে তখন তাদের কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে ঠাণ্ডা বাতাস।
ধর্ম
আমরা সবসময় ধর্মকে জীবন থেকে আলাদা করে ফেলি। মনে করি এই অংশটুকু ধর্মের জন্য, বাকিটুকু নিজের জন্য। কিন্তু আসলে জীবনের পুরোটাই ধর্মের অংশ। এখানে একটা অংশ আধ্যাত্মিক বাকি অংশ পার্থিব এরকম কোনো বিষয় নেই। জীবনকে কোনো নীতিশাস্ত্রে বাঁধা যায় না তাই জিব্রান বলছেন,
“যে ব্যক্তি নীতিশাস্ত্র দিয়ে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে সে তার গানের পাখিকে পিঞ্জরে বন্দি করে। মুক্ত কণ্ঠের গান বন্দিশালা থেকে আসে না।”
মৃত্যু
পরিশেষে ত্রিকালদর্শী আলমিত্রা আল মুস্তাফার কাছে মৃত্যু সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। মুস্তাফা বলে চললেন- মৃত্যুকে কেউ যদি জানতে চায় তাকে অবশ্যই জীবনকে জানতে হবে। কারণ,
“নদী ও সমুদ্র যেমন এক তেমনি জীবন ও মৃত্যুও এক।”
মৃত্যুকে যদিও আমরা ভয় পাই কিন্তু মৃত্যুর মাধ্যমে জাগতিক জীবনের জোয়ার ভাটা থেকে মুক্তি পাই। একজন রাখাল যেভাবে রাজার সামনে উপস্থিত হওয়ার আগে ভয় পায়, আমরাও ঠিক তেমনি মৃত্যুকে ভয় পাই। কিন্তু রাজার সাথে দেখা হওয়ার যে আনন্দ, আমাদের মৃত্যুর পরেও সেই আনন্দ অপেক্ষা করছে।
বিদায় বেলায়
অবশেষে সময় হয় আল মুস্তাফার বিদায়ের। তার দেশের নাবিকেরা জাহাজে তার অপেক্ষা করে। এত বছর ধরে মানুষের মধ্যে থেকে তিনি নির্জনে তাদের অবলোকন করেছেন। তাই তিনি আজ তাদের জন্য কিছু কথা রেখে গেলেন। এই কথাগুলোর মর্ম যতদিন যাবে মানুষ তত উপলব্ধি করবে। যাওয়ার বেলায় তিনি বলে গেলেন আবার যদি প্রয়োজন হয় তিনি আসবেন অন্য কোন দেহে।
“আর অল্প কিছুক্ষণ, আমি বায়ুভরে এক মুহুর্ত বিশ্রাম করব, তারপর অন্য কোন নারী আমাকে তার গর্ভে ধারণ করবে।”