ইংরাজিতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্য আছে- ‘History is written by the victors’, অর্থাৎ, ইতিহাস রচিত হয় বিজয়ীর হাতে। প্রবাদটি প্রথম কে বলেছিলেন, এ বিষয়ে বিতর্ক আছে। প্রবাদের স্রষ্টা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রবাদটির সারবত্তা নিয়ে অনেকেই একমত হবেন। আজ অবধি পৃথিবীর ইতিহাসে যত যুগান্তকারী ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেগুলো বেশিরভাগই বিজয়ী পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। এ কারণে সেসব কাহিনীতে পরাজিত পক্ষকে সর্বদাই একপ্রকার খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। অন্যদিকে বিজয়ী পক্ষের মহিমান্বিত বীরগাথায় যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই দেখানো হয় মানবতা রক্ষার ন্যারেটিভ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, ভয়াবহতা, রাজনীতি এগুলোর সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। অক্ষশক্তি কারা আর মিত্রশক্তিই বা কারা, এ তথ্যও সকলেই মোটামুটি জানে। মিত্রশক্তির অন্যতম শক্তি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পার্ল হারবার হানার পর যাদের যুদ্ধে যোগদান যুদ্ধের গতিপথটাই পালটে দিয়েছিল। তাই বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে হলিউডে যে সমস্ত সিনেমা বানানো হয়েছে আজ অবধি, বেশিরভাগই সেই মহিমান্বিত বীরগাথারই পরিচায়ক। কষ্টের চিত্র যা দেখানো হয়েছে, তাও যুদ্ধে প্রিয়জন হারানো মার্কিনি সাধারণ মানুষেরই কষ্ট।
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারানো সেসব সৈনিক এবং তাদের হতভাগ্য পরিবারের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি রেখেও বলা যায়, সেসব সিনেমাতে কোথাও পরাজিত জাতির পীড়নের চিত্র কিন্তু অঙ্কিত হয়নি। কয়েকটা অবশ্য সেরকম ছবি রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাপানি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো, ক্লিন্ট ইস্টউড পরিচালিত ‘লেটারস ফ্রম ইয়ো জিমা’।
যুদ্ধকে গ্ল্যামারাইজ করে দেখানোর এই হলিউডি ট্রেন্ডের একদম বিপরীত স্রোতে হেঁটে জাপানি চিত্রপরিচালক ইসাও তাকাহাতা বানালেন জাপানি অ্যানিমে ছবি ‘হোতারু নো হাকা’, যে ছবিকে আমরা ‘গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইস’ নামেই বেশি চিনি। চিরাচরিত অ্যানিমেশনের থেকে জাপানি অ্যানিমে ফর্ম্যাটটি খানিক স্বতন্ত্র। জাপানি ঔপন্যাসিক ও গীতিকার আকিয়ুকি নোসাকা রচিত একই নামের একটি আত্মজৈবনিক ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত ছবিটি।
নোসাকার পালক পিতা কোবে বোমাবর্ষণের সময়ে নিহত হন, তার দুই বোন মারা যান অপুষ্টির কারণে। নিজের জীবনের সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাকেই বর্ণনা করলেন গল্পে। আর ১৯৮৮ সালে স্টুডিও ঘিবলির প্রযোজনায় তা থেকে তৈরি হলো সিনেমা। সেখানেও একইভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতায় আক্রান্ত সাধারণ জাপানিদের বিপন্নতার নিখুঁত পরিস্ফুটন করলেন পরিচালক তাকাহাতা।
সিনেমার শুরুই হচ্ছে একটি শিহরণ জাগানো উক্তির মাধ্যমে। ‘সেপ্টেম্বর ২১, ১৯৪৫। সেই রাতেই আমি মারা যাই।’ বক্তা একজন সপ্রতিভ কিশোর, বা বলা ভালো, কিশোরটির মৃত আত্মা। কথাটি উচ্চারণ করার পরপরই নিজের মৃত্যুদৃশ্য দেখতে পাচ্ছে সে। ব্যস্ত রেলযাত্রীরা এড়িয়ে যাচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী ছেলেটিকে। তারপর একসময় অন্ধকার স্টেশন-চত্বরে শেষ নিঃশ্বাস পড়লো তার।
তার সঙ্গে থাকা একটি ছোট টিনের কৌটোকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো স্টেশনের সাফাইকর্মীটি। কৌটোটা সামনের জঙ্গলে যেখানে গিয়ে পড়লো, সেখানে এবার আবির্ভূত হচ্ছে ওই মৃত কিশোরের ছোট্ট বোনটি। সেও মৃত। পরপারে পৌঁছে মিলন ঘটছে ভাইবোনের। এক মায়াবী আবহে তারা ট্রেনের কামরায় উঠছে। সেখানে তারা ছাড়া আছে শুধু একঝাঁক জোনাকি। হ্যাঁ, তারাও মৃত, পার্থিব বন্ধনমুক্ত। অস্বাভাবিক শান্ত সেই পরিবেশ থেকেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাচ্ছে ছবির দৃশ্য, যেখানে কেবলই বিষাদের ক্যালেইডিওস্কোপ।
কিশোরের নাম সেইতা আর তার ছোট বোনটির নাম সেতসুকো। বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্ব। ক্রমাগত মার্কিন আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জাপান। কোবে শহরের ওপর মার্কিন যুদ্ধবিমান তখন অগ্নিবর্ষণ শুরু করেছে। সেইতা-সেতসুকোদের বাড়ির কাছে, তাদের চোখের সামনেই চারিদিক আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। আগুনের লেলিহান শিখায় ভয় পেয়ে কেঁদে উঠছে ছোট্ট সেতসুকো। সেইতা-সেতসুকোর মতো হাজার হাজার নিরপরাধ কোবেবাসীর কান্নায় হেলদোল নেই বোমারু বিমানের। তারা নিজেদের কাজ করেই চলেছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন সকলে। আকাশ জুড়ে নেমে আসছে বোমার বৃষ্টি। ছোট্ট সেতসুকো এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করে দাদাকে, যারা এমন করে মারছে, তাদের কিছু হবে না? দাদা উত্তর দেন, বাবা তাদের ঠিক শায়েস্তা করবে।
এ বিষয়ে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র-সমালোচক ওয়েন্ডি গোল্ডবার্গ মন্তব্য করেছেন- ‘সেইতা আসলে এই কথার মাধ্যমে অন্ধ দেশপ্রেমকেই তুলে ধরে।’ বলা বাহুল্য, কথাটির মধ্যে চূড়ান্ত একমুখিতার পরিচয় রয়েছে। যে কিশোর জন্মসূত্রেই জাপানি, যুদ্ধের সময়ে সে জাপানের জয়লাভই কামনা করবে, সে জাপান যতই অপরাধ করুক, এটাই স্বাভাবিক। আর তার তখনো যুদ্ধের রাজনীতি বোঝার মতো পরিণতিবোধ তৈরিই হয়নি। সুতরাং, মার্কিনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এ ধরনের উপসংহার টানা একমুখী ও সেইসঙ্গে দুঃখজনক।
সিনেমায় আপাতদৃষ্টিতে খলনায়িকা বলতে গেলে মাসির চরিত্রটিকেই তুলে ধরতে হয়। খাবার আনার জন্য সেইতাকে তাদের মায়ের জামা-কাপড় জোর করে বিক্রি করতে বাধ্য করে। ক্রমাগত তাদের বুঝিয়ে দেয়, এই যুদ্ধের বাজারে তারা রীতিমতো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে সেই কংক্রিটের আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে হ্রদের ধারে একটি পরিত্যক্ত শেল্টারে আশ্রয় নেয় ভাইবোন।
এক্ষেত্রে মাসিকে নির্দয়, অমানবিক মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মাসি কেবল একজন নিমিত্ত মাত্র। আসলে সর্বগ্রাসী যুদ্ধই সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষকে পরিস্থিতির শিকার করে তোলে। একটিও বিস্তারিত যুদ্ধদৃশ্য না দেখিয়েও যুদ্ধের স্বরূপকে এভাবে যে জীবন্ত ফুটিয়ে তোলা যায়, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক তাকাহাতা।
দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে যুদ্ধের নিরর্থকতাকে দেখিয়ে গেছেন পরিচালক। যে হ্রদের ধারে তারা আশ্রয় নিয়েছিল, তার ঠিক অপর পাড়েই একটি গৃহস্থ বাড়িতে ফিরে আসছে পরিবারের সকলে। পরিবারের তিনবোনের হাবেভাবে মনে হচ্ছে, এতদিন যেন কিছুই হয়নি। জানলা খুলে দিয়ে বাইরের হ্রদের সৌন্দর্য দেখে তারা উৎফুল্ল। কিন্তু ওপারেই পড়ে থাকা ভাঙা ছাতা, উনুন, বালতি তাদের চোখেও পড়ে না। আসলে যুদ্ধের শেষে কারও জীবনে নেমে আসে অন্ধকার, কেউ বা পুরনো জীবন ফিরে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হয়ে ওঠে।
সাধারণত, অ্যানিমেশন সিনেমা বললেই আমাদের কাছে যে প্রচলিত ছবিটা ফুটে ওঠে, তা হল ছোটদের জন্য বানানো মজাদার কোনো চলচ্চিত্র। সেখানে সেই প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে এরকম একটি ছবি বানানোর সাহস দেখিয়েছিলেন বটে তাকাহাতা। এই প্রসঙ্গে সমালোচক রজার এবার্ট বলেছিলেন-‘Grave of the Fireflies forces a rethinking of animation.’
গল্পের লেখক নোসাকার মতো তাকাহাতাও বিশ্বযুদ্ধের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২৯শে জুন ওকায়ামা শহরের ওপর যখন মার্কিন বিমানহানা হয়, তার হাত থেকে কোনোমতে বেঁচেছিলেন তিনি এবং তার পরিবার। তাই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা একপ্রকার কাছ থেকে দেখার কারণে পর্দায় সেই বাস্তবতা খুব নিখুঁতভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। জাপানি-মার্কিন লেখক রোলান্ড কেল্টস তার ‘জাপানামেরিকা’ বইতে এই ছবির চরিত্র সম্পর্কে লিখেছেন-
‘It tells about the failure of heroism and nobility in desperate circumstances and in that way, it’s almost an anti-Hollywood film. Hollywood will have you believe that heroes are needed when times are tough. Isao Takahata shows us the humble opposite, that when times are tough what you need most is humility, patience and self-restraint. That’s how one survives.’
ফর্ম্যাট (অর্থাৎ, অ্যানিমেশন) এবং জঁর (অর্থাৎ, ওয়ার), চলচ্চিত্রের দুই ভিন্ন শ্রেণীর ক্ষেত্রেই নতুন করতে সংজ্ঞা প্রদান করতে একশো শতাংশ সক্ষম হয়েছিল ‘গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইজ’। সেজন্যেই, নিঃসন্দেহে পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই সিনেমা এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।