‘দৃশ্যম’ শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘ভিশন’। বাংলায় আনলে দাঁড়াবে দূরদর্শিতা বা দূরদৃষ্টি, যেটি সংযুক্ত কল্পনাশক্তির সাথে। কল্পনাশক্তির প্রখরতাতেই একজনের দূরদর্শিতা প্রকাশ পায়। খানিকটা ভূমিকা বাড়ানোর কারণ, দূরদর্শিতার উপরই যে এই দুটো সিনেমা হয়ে গেল। তাই এ একপ্রকার নাটকীয় ভঙ্গিতে মঞ্চ সাজানোর চেষ্টা শুধু।
২০১৩ সালে যখন ‘দৃশ্যম’ এল, ভারতীয় সিনেমায় একটা নতুন মাত্রার থ্রিলার যেন যোগ হলো। ‘পারফেক্ট ক্রাইম’ নিয়ে সিনেমা তো কম হয়নি, সামগ্রিকে বললে। ‘দ্য কিলিং’ (১৯৫৬), ‘লে দিয়াবলিক’ (১৯৫৫), ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেইন’ (১৯৫১), ‘থিফ’ (১৯৮১)- এর মতো গ্রেট সকল সিনেমার উদাহরণ টানা যায়। যদিও নিয়তির পরিহাস তাতে মিশে আছে। তবে সম্পূর্ণ ‘পারফেক্ট কভার আপ’-এ নিহিত সিনেমার তালিকা খুব বেশি দীর্ঘ নয়। সেই ছোট্ট তালিকায় একটা যোগ্য সিনেমা ছিল দৃশ্যম, যেটা ‘দৃশ্যম ২’ দিয়ে এবার হলো সিরিজ। একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক।
আত্মরক্ষায় মারা পড়লো আইজির ছেলে। ক্লাস ফাইভ পাস পরিবারের কর্তা, যার গোটা দুনিয়ায় আছেই একটা পরিবার, তাকে নামতে হলো এই লাশের চিহ্ন মুছে ফেলায়। পরিবারকে বাঁচাতে সে যেকোনো চরমসীমায় পৌঁছাতে পারে। ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া একজন মানুষ, যার আছে ক্যাবলের ব্যবসা। তার কাজ হলো অফিসে বসে সিনেমা দেখা। সে আর কতটুকু কী পারবে? এমনটাই ধারণা করেছিল পুলিশ এবং দর্শক উভয়েই। কিন্তু প্রচণ্ড ধীশক্তি আর প্রখর বুদ্ধিমত্তায় গোটা গল্পটা কেমন দাঁড়িয়েছিল, তা তো দর্শক জানেনই।
ভারতের প্রতিটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেই রিমেক হতে থাকে এই সিনেমা। একটা ‘কাল্ট’ সিনেমা এরইমধ্যে দৃশ্যম হয়ে গেছে। তো ওমন সমাপ্তির পর সিক্যুয়ালের সম্ভাবনা বোধকরি কারো মাথাতেই উঁকি দেয়নি। কারণ সে জায়গা আর দরকা ছিল না। কিন্তু সিক্যুয়াল তো এল ৬ বছর পরে, যেখানে ৫ বছর শুধু চিত্রনাট্য তৈরিতে লেগেছে। এবং এসেই দৃশ্যম ২ যে দৃষ্টান্ত তৈরি করল, তা ভাবনাতীত। এখন বলতে হবে, এই সিক্যুয়াল ছাড়া দৃশ্যম ১ অসম্পূর্ণ। এবং এরচেয়ে বড় প্রশংসা বোধকরি আর হতে পারে না।
দৃশ্যম ২ তার মুক্তির সময় ধরেই গল্পের বয়ান শুরু করে। বেশ ক’ বছর পার হলো সেই ঘটনার। জর্জকুট্টি এখন একটা সিনেমাহলের মালিক। তার সিনেমাপ্রেম আগের মতোই আছে এখনো। বাড়িঘর ভালো হয়েছে এখন। পরিবারও ধীরে ধীরে স্থির হচ্ছে সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা থেকে। মনের এক কোণে ভয়টা কিন্তু প্রত্যেকেরই রয়েছে, সামনাসামনি হবার সাহস দেখায় না তবে কেউই। তবে ভেতরে ভেতরে মফস্বলের অনেকেই অবশ্য টিপ্পনি কাটে এই বলে, খুনটা জর্জকুট্টিই করেছে। পুলিশকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে তার নম্র স্বভাবে লুক্কায়িত ধূর্ততা দিয়ে। জর্জকুট্টির উন্নতিই বোধহয় তাদের খুব চোখে লাগছে। এরইমধ্যে সেই ভেতরের ফিসফাস’টাকে জোর গলা করতে থানায় আসা নতুন পুলিশ অফিসার আবার সেই অমীমাংসিত কেসটার ফাইল খুলে। এটা হয়ে পড়ে সিনেমার দ্বিতীয় ন্যারেটিভ।
পুলিশের গাড়ির সাইরেন জর্জকুট্টির স্ত্রী রানী আর দুই মেয়েদের এক ঝটকাতেই ৬ বছর আগেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ফিরে ফিরে যায় সেই দুঃস্বপ্নে। বেখেয়ালে রানীর মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কিছু তথ্য। রানী বলেছিল সরল বিশ্বাসে, কিন্তু কে জানত, পুলিশ আগে থেকেই একটা ফাঁদ পেতেছিল, যে করেই হোক একটা তথ্য তাদের মুখ থেকে বের করতে। আইজি গীথা প্রভাকারান ফের এল চিত্রপটে। শুরু হলো তদন্ত, খোঁড়া হলো মাটি। এ রহস্যের শেষ কোথায়? জর্জকুট্টি তার পরিবারকে এবার কী করে রক্ষা করবে? কী করে সাজাবে সব? নাকি পুরোটাই সাজানো? শুধু শুরু হওয়ার বাকি।
দৃশ্যম ২ মোটের উপর দুটো ন্যারেটিভ নিয়ে চলে। প্রথম ন্যারেটিভ পুরোটাই জর্জকুট্টির পরিবারের অতীতের ট্রমা চাড়া দিয়ে ওঠা, আত্মদংশন আর মফস্বল শহরের মানুষ এবং তাদের মনস্তত্ত্বের চিত্র উপস্থাপন করে। আর দ্বিতীয় ন্যারেটিভ পুরোটাই পুলিশের তদন্ত হতে শুরু করে শেষ অব্দি বিস্তৃত। এই দুই ন্যারেটিভেরই আলাদা টোন আর আমেজ আছে। সিনেমা গল্পে ঢুকতে সময় নেয়। অনেকে সেখানে অভিযোগের সুরও তুলে বলেছেন, অতিরিক্ত সময় নিয়েছে। এখানে শুরুতে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। তা হলো, এটা পুরোটাই একটা ‘সেল্ফ-ইন্ডালজেন্ট’ কাজ।
তাছাড়া, দৃশ্যমের দুনিয়াটা বুঝে থাকলে এ অভিযোগ কিন্তু অযৌক্তিক। দৃশ্যমের কথা বলি আর দৃশ্যম ২-এরই কথা বলি, দুটো সিনেমাই প্রথম দৃশ্য থেকে মালা গাঁথা শুরু করেছে। একটার পর একটা পুঁতি বসিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সংযোগটা সরলরৈখিকভাবে করেনি। অনেক কিছুই যা মনে হয় অপ্রয়োজনীয়, শেষে গিয়ে সেসবই হয়েছে মালার শোভা বাড়ানোর অপরিহার্য উপাদান। দৃশ্যম ১-এ মফস্বলের মানুষরাই জর্জকুট্টির পরিবারের একটা বড় অবলম্বন হয়ে কাজ করছিল। কিন্তু এই সিনেমায় দেখা যায়, জর্জকুট্টির উন্নতি আর সময়ের সাথে মফস্বলের মানুষদের ওই পরিবার নিয়ে ধারণা কেমন পাল্টে গেছে। গ্রামগঞ্জে, ছোট শহরে কারো আকস্মিক কারো উন্নতি নিয়ে অন্যদের কানাঘুষার অভ্যাস তো আর নতুন কিছু না। আর মানুষের সেই ঈর্ষালু আচরণের দিকটি খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে এনেছে এই সিনেমা।
দৃশ্যম ২-এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক, চিত্রনাট্য। ইতোমধ্যেই সে নিয়ে অবশ্য সবাই কথা বলছেন। তা কেন চিত্রনাট্য এত শক্তিশালী হলো? সেই কারণ নিহিত আসলে দৃশ্যম ১-এর দুনিয়ায়। খেয়াল করা হলে, চোখে পড়বে; দৃশ্যম ১-এর দুনিয়াটাকে কোনোরকম ত্রুটিবিচ্যুতি ছাড়াই পুনরায় নির্মাণ করেছে দৃশ্যম ২। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব খুঁটিনাটির সমন্বয় করে। এই সিনেমার চিত্রনাট্যে মানুষের অন্তর্জাত হিংসা, অনুশোচনা, শাপমোচনের মতো বিষয়াদি উঠে এসেছে। মফস্বলের মানুষদের আচরণে মানুষের মধ্যকার অন্তর্জাত হিংসার বিষয়টি উঠে এসেছে। ওদিকে রানী ও তার বড় মেয়ের চরিত্রে মিশে আছে আগের কাজটি নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব আর দায়মোচনের বিষয়টি এসেছে জর্জকুট্টির চরিত্রে।
পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার জিথু জোসেফ প্রত্যেকটি চরিত্রকেই নিজ জায়গায় স্বকীয় করেছেন এবং তাদের সকল অ্যাকশনের পেছনেই একটা যৌক্তিক কারণ দিয়েছেন, যে কারণগুলো চরিত্রদের চালিত করছে। এখানে কেউ চালিত হচ্ছে অপরাধবোধ দ্বারা, কেউ কেউ আবেগ দ্বারা, কেউবা কর্তব্য দ্বারা। “জর্জকুট্টির গোটা পরিবার শুধু পরিবার নয়, ওটা একটাই প্রাণ”- এই বার্তাটা দৃশ্যম ২-এ আরো প্রগাঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছেন জিথু জোসেফ, যে পরিবার আসলে তার নিজের পরিবারেরই ছায়া অবলম্বনে।
দৃশ্যম ১ এর কথা বলা হোক কিংবা ২-এর, দুটোই চালিত হয়েছে জর্জকুট্টির অবস্থান থেকে। দর্শককে খুব সূক্ষ্মভাবে জর্জকুট্টির দৃষ্টিকোণটায় ধরে ফেলা হয়। তাই দর্শক বুঝতে পারে, তার কাছে পরিবারের মূল্যটা। দর্শক মৌনসম্মতি দেয় তার প্রতিটা কাজে, কারণ তারা জানে এসবের পেছনে কারণ একটাই। তার পরিবার। যেকোনোভাবেই পরিবারকে রক্ষা করতে হবে, এটাই জর্জকুট্টির ব্রত, যার মাঝে পরিচালক নিজেরই ছায়া অঙ্কন করেছেন।
এবং সে ব্রত পালন করতে গিয়েই জর্জকুট্টি হয়ে উঠে ‘ক্লাসিক ক্রিমিনাল’, যেমনটা শোনা যায় তদন্তকারী পুলিশের মুখে। একজন সাধারণ মানুষের দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করলে কিংবা হুমকির মুখে ফেললে সে কেমন ভয়ংকর কিংবা অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে, তারই একটা দৃষ্টান্ত এই সিনেমা। সেই মানুষটার একমাত্র যুক্তি তখন, এই জিনিসটাই আমার সব এবং একমাত্র লক্ষ্য- তখন, একে রক্ষা করাই আমার দায়িত্ব; যা পাওয়া যায় জর্জকুট্টির চরিত্রে।
সিরিজের দুটো সিনেমাতেই চিত্রনাট্যকার হিসেবে যতটা এক্সপ্রেসিভ হয়েছেন জিথু জোসেফ, পরিচালক হিসেবে ততটাই আন্ডারটোনে কাজ করেছেন। ফিল্মমেকিং’টা এখানে খুবই সূক্ষ্ম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা নিহিত ছিল অভিনয়শিল্পীদের পরিচালনায় আর সামগ্রিক বাতাবরণ সৃষ্টিতে। তাইতো মোহনলালের মতো একজন ওজনদার অভিনেতাকে মানিয়ে যেতে দেখা যায় এই চরিত্রে।
তার সহজাত অভিনয়প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সবরকম লাউডনেস, রাগ, ক্ষমতার ধারণা এই চরিত্র থেকে কেড়ে নিয়ে অভিব্যক্তিতেই তাকে দিয়ে অভিনয়টা করিয়েছেন। সংলাপে কম। শরীরের ভারটা দুই পায়ের পদক্ষেপে স্পষ্ট। আত্মদগ্ধ হওয়ায় ঘাড়ের উপর একটা অতিরিক্ত ভার আর শরীরি ভঙ্গিতে কিঞ্চিৎ ভয় দেখা যায়। কিন্তু চোখের ভাষাতে তা নেই। ওখানে শুধু দৃঢ়তা এবং ধূর্ততা। এবং এই চরিত্রটি হয়ে উঠেছে ক্লাসিক ক্রিমিনাল চরিত্র রূপায়নের একটা মডেল।
রানী চরিত্রটিও এবার আগের চেয়ে বেশি স্ব-মহিমান্বিত। স্বামী, সন্তানের পাশাপাশি একটা আলাদা অবস্থানে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে শুধু সে আর তার দ্বান্দ্বিক সত্ত্বা আছে। একজন আদর্শ স্ত্রী এবং মা হয়ে ওঠার পাশাপাশি তার আলাদা সত্ত্বার পরিচয়টা এসেছে। কিন্তু তা হতে পারত আরো গাঢ়। মীনার পরিমিত অভিনয় এই চরিত্রটাকে দর্শকের সংবেদনশীলতার সাথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে।
এই সিনেমা চলেছে সাসপেন্স থিওরিতে। তবে শক, সারপ্রাইজ, উত্তেজনার মতো থ্রিলারের মেকানিজমও এতে ছিল। স্পষ্টতই ছিল। কিন্তু সেসবকে জিথু জোসেফ ব্যবহার করেছেন সূক্ষ্ম এবং যতটা সম্ভব আন্ডারটোনে। পারিবারিক সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, আবেগকে রেখেছেন কেন্দ্রে। তাই কেন্দ্রবিন্দুতে, সিনেমা হয়ে উঠেছে পুরোপুরি ড্রামাটিক।
দৃশ্যম ২ তার শেষ অঙ্কে সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে একটা বড় নাটকীয় মুহূর্তের সামনাসামনি করে দর্শককে। একটার পর একটা পাজল মিলিয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ততায় ভরা চমৎকার চিত্রনাট্য, দক্ষ সম্পাদনা এবং আঁটোসাঁটো পরিচালনার যোগ্য ফলাফলটা প্রদর্শন করে। জর্জকুট্টিকে গ্লোরিফাই এই সিনেমা করেনি, শুধু এমন পরিস্থিতিতে তার অবস্থানের বর্ণনা করেছে। তবে কি সে সাজা পাবে না? শেষ দৃশ্যে সে প্রশ্নেরই উত্তরস্বরূপ দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’-এর প্রেরণা টেনে অপরাধবোধটাকে সামনে এসেছে সিনেমা। নিজের বিবেকের কারাগারেই যে সে বন্দী। এরচেয়ে বড় সাজা আর কীইবা হতে পারে?