জমশেদ খান একজন উর্দুভাষী পাকিস্তানি পুলিশ অফিসার। তার পানিশমেন্ট পোস্টিং হয়েছে ‘চন্দ্রপুর’ নামে খুলনার এক মফস্বল শহরে। যেই লঞ্চে করে তিনি ঢাকা থেকে খুলনায় যাচ্ছিলেন সেই লঞ্চেই উঠেছে একই গন্তব্যের যাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসির ও ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী দীপ্তি। একজন বাউল বাংলায় গান গাইছে দেখে তার গায়ে হাত তুলে জমশেদ। সেখানেই তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করে নাসির ও দীপ্তি।
এভাবেই শুরু হয় তাদের দ্বৈরথ। এবং তা অব্যাহত থাকে চন্দ্রপুরেও, যেখানে এলাকার লোকজনের জন্য জমশেদ একাই ত্রাস হয়ে হাজির হয়। এ দেশের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যেন তার জন্মের শত্রুতা। বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা দাবি করে গ্রাম থেকে মুছে ফেলার প্রত্যয় নেয় জমশেদ। সব বাংলা সাইনবোর্ড উর্দুতে লেখা হয়, সাধারণ মানুষকে উর্দু শেখানোর জন্য মাওলানা ডেকে উর্দু ক্লাস নেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়। অপরদিকে এলাকার নাট্যদল শোষণের প্রতিবাদ হিসেবে নীলদর্পন মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নেয়। সেই নাট্যদলেই নাসির ও দীপ্তি নিজেদের চিনতে শুরু করে নতুন করে।
তৌকীর আহমেদ একজন পরিচালক ও গল্পকার হিসেবে যে কতটা শক্তিমান ও পরিপক্ব, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ আমাদের সে বিষয়টিই আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। তার পরিচালিত ষষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘ফাগুন হাওয়ায়’। পরিচালনা জগতে প্রবেশ তৌকীর করেছিলেন ‘জয়যাত্রা’ দিয়ে। এরপর পরিচালনা করেছেন ‘রূপকথার গল্প’ ও ‘দারুচিনি দ্বীপ’। দারুচিনি দ্বীপের পর এক বিশাল বিরতি নিয়ে ২০১৬ সালে আবার ফিরেন ‘অজ্ঞাতনামা’ দিয়ে। নয় বছর পর অজ্ঞাতনামা নিয়ে যেন তিনি পরিচালনায় ফিরেন নতুন এক রূপে। গল্প-বলায়, চিত্রগ্রহণে তার মুনশিয়ানা এবং অভিনেতাদের মধ্য থেকে সেরাটা বের করে আনার প্রচেষ্টায় ফুটে উঠা তার নতুন এই রূপ দেখে, যশপাল শর্মা তো তাকে বাংলাদেশের ‘মাজিদ মাজিদী’ হিসেবেই আখ্যা দিয়ে বসেন।
নির্মাতা তৌকীর বলতে গেলে একজন মেথড আর্টিস্ট। অজ্ঞাতনামা, হালদা, ফাগুন হাওয়ায়; তিনটি ছবিতেই হাতের কাছের সব গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জড়ো করেছেন। ওয়াইড এঙ্গেলের ব্যাপক ব্যবহারের পাশাপাশি প্রকৃতিকে যতটুকু পরিমাণ ফ্রেমে আনা সম্ভব আনা হয়েছে। তিনটি ছবিতেই সিম্বোলিজমের ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো।
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিতে পুরো পশ্চিম পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে রূপায়িত হয়েছে পুলিশ অফিসার জমশেদ; যে বাংলা ভাষাকে সহ্য করতে পারে না, বাংলা সংস্কৃতিকে সহ্য করতে পারে না; যে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিগ্রস্থ; এবং যার হাতে মানুষ এবং পশুপাখি কোনোটাই নিরাপদ নয়।
নাসির, দীপ্তি ও তাদের নাট্যদলটি হচ্ছে সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি ও আপসহীন বাঙালি সত্তার প্রতীকী। সিনেমার বিভিন্ন সময়ে আমরা দীপ্তিকে দেখি সেতার বাজিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে, পাকিস্তানিদের অত্যাচার নিয়ে আলোচনা করার এক পর্যায়ে দীপ্তি ও তার দাদাকে একসাথে ‘দেশলাই কাঠি’ আবৃত্তি করতে দেখি, গ্রামের নাট্যদলকে দেখি পাকিস্তানিদের নির্যাতনের প্রতি মানুষকে সচেতন করতে ‘নীল দর্পণ’ মঞ্চায়িত করার সিদ্ধান্ত নিতে, নাট্যদলের লোকগুলোর মধ্যেই আমরা দেশপ্রেমকে দেখি, ভ্রাতৃত্ব দেখি, দেখি ‘দেশলাই কাঠি’র ন্যায় শেষবারের মতো জ্বলে ওঠার স্পৃহা।
সিনেমার মূল চরিত্র জমশেদ। এই চরিত্রের জন্য পরিচালক দ্বারস্থ হয়েছেন ‘লাগান’-খ্যাত বলিউডের নামজাদা অভিনেতা যশপাল শর্মার। নামের মর্যাদা রেখেছেন যশপাল, পাকিস্তানি অফিসারের চরিত্রে করেছেন দুর্দান্ত অভিনয়। সিয়াম আহমেদ ও তিশার রসায়ন পর্দায় এতটা না জমলেও দুজনই ব্যক্তিগতভাবে তাদের সেরাটাই দিয়েছেন। ‘মুন্সি’ চরিত্রে অভিনয় করা ফারুক আহমেদ দিয়েছেন প্রয়োজনীয় কমিক রিলিফ। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু, সাজু খাদেম, শহীদুল ইসলাম সাচ্চুর মতো বাঘা বাঘা অভিনেতারা; যাদের সবাই তাদের নামের মর্যাদা রেখেছেন।
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে টিটো রহমানের ছোটগল্প ‘বউ কথা কও’ এর ছায়া অবলম্বনে। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন তৌকীর আহমেদ নিজেই। সত্যি কথা বলতে ছোটগল্পটির খুব অল্প অংশই ধারণ করা হয়েছে সিনেমার চিত্রনাট্যে। সিনেমার মাত্র একটি চরিত্রই এসেছে ছোটগল্প থেকে; সেটি হচ্ছে উর্দুভাষী পুলিশ অফিসার জমশেদ। গল্পে এই পুলিশ অফিসারের নাম আবার আজীজ। গল্পের আজীজ সাহেব জমশেদের মতো অতটা জাঁদরেল না, দেখতেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতো না। সুতরাং, চিত্রনাট্য বলতে গেলে তৌকীর আহমেদের মৌলিকই। আগের দুই ছবিতে প্রান্তিক মানুষের গল্প বলার পর এবার ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার পালকও যুক্ত হল তৌকীরের মুকুটে। সময়কে ধরার প্রয়াস চিত্রনাট্যে ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয়েছে। ঐতিহাসিক পটভূমিকে তাৎপর্যমন্ডিত করতেই কি না, সিনেমার সংলাপ কিছু জায়গায় বেশ নাটকীয় মনে হয়েছে।
ঐতিহাসিক সিনেমা বা পিরিয়ড পিস নির্মাণ করা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং, এবং একইসাথে ব্যয়বহুল, যে কারণে আমাদের দেশে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না বললেই চলে। বায়ান্ন নিয়ে এর আগে মাত্র দুটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে; জীবন থেকে নেয়া এবং বাঙলা। এই দুটি সিনেমাতেও বায়ান্ন এসেছে আংশিকভাবে। পুরোপুরি ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ফাগুন হাওয়ায়। এই সংখ্যাটাই আসলে বলে দেয় ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা কতটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তবে সেই চ্যালেঞ্জটা ভালোভাবেই নিয়েছে তৌকীর এন্ড কোং। সেট ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইন, আর্ট ডিরেকশন সব কিছুতেই ছিল সময়কে ধরার প্রয়াস। বাজেটের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো হালকা বিচ্যুতি হয়েছে, কিন্তু কোথাও যত্নের কোনো কমতি ছিল না। সিনেমা দেখতে গিয়ে এই একটি বিষয় আপনি হারে হারে উপলব্ধি করবেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘নির্বাচনের জন্য পোস্টারই যথেষ্ট, কিন্তু বিপ্লবের জন্য চাই সাহিত্য’। বায়ান্ন, উনসত্তর বা একাত্তর; সব গণ-আন্দোলনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে শিল্প-সাহিত্য। হোক সেটা নজরুলের গান, কিংবা জহির রায়হানের চলচ্চিত্র; আমাদের জাতিসত্তাকে জাগ্রত করে মূলত এই শিল্প সাহিত্যই। ফাগুন হাওয়ায় চলচ্চিত্রটি আমাদের আবার সেই কথা মনে করিয়ে দেয়। মায়ের ভাষার জন্য শুধু আমরাই প্রাণ দিয়েছি। কিন্তু এই গর্বের বিষয়টি কেন আমাদের চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে, সেই উত্তরটা যখন আমরা খুঁজতে যাবো, তখন জাতীয় জীবনে কেন আমাদের এত দুর্দশা সেই কারণটিও হয়তো খুঁজে পাবো।
আমাদের জাতিসত্তার ধারক-বাহককে হিমঘর থেকে বের করে এনেছে ফাগুন হাওয়ায়। আমাদেরকে আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে জাতি হিসেবে আমাদের উন্মেষ একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ তা-ও আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
সিনেমাটি আমাদের নিয়ে গিয়েছে বায়ান্নতে, আমাদের মুক্তির আন্দোলনের শেকড়ে। আবার মনে করিয়ে দিয়েছি বাঙালি কখনো শোষকের সাথে আপোষ করেনি। যে কারণে কোনো শোষকই টিকতে পারেনি আমাদের সামনে। জাতীয় জীবনে আমরা যখন প্রায় মেরুদণ্ডহীন তখন ছবিটি হয়তো আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে নতুনভাবে আমাদের অতীতকে উপলব্ধি করার। সেই সাথে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ভবিষ্যতে আরও ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে ফাগুন হাওয়ায়।