ভাইভ্যারিয়াম: কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে আধুনিক জীবন আর বাস্তবের ভয়াল দর্শন

‘ভাইভ্যারিয়াম’ এর অর্থ হলো ঘের বা বেড়া বা কোনো কন্টেইনারে সেমি-ন্যাচারাল অবস্থায় কোনো প্রাণীকে পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে অবরুদ্ধ রাখা। আর সিনেমার নামটিই এর পৃষ্ঠতলের গল্পধারণা দেয়। সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যটিও যদি দেখা হয়, তাতে দেখা যায়, দু’টি সদ্য জন্মানো বাচ্চা পাখিকে তাদের নীড় থেকে বাইরে ফেলে দেয় দু’টি কোকিল, যারা স্বভাবে পরভৃত। ফেলে দিতেই মারা যায় বাচ্চা পাখি দুটো। এই দৃশ্যটিই রূপকার্থে, সিনেমায় সামনে কী ঘটতে চলেছে, তার সম্পূর্ণ পূর্বাভাস দেয়। 

সিনেমার কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র- টম এবং গেমা। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা গেমা, তার প্রেমিক টমকে নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে চায়। একটি সুন্দর, সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, যা আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষারই রূপায়ন। তো সেই সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে তথাকথিত ‘পারফেক্ট হোম’ খুঁজতে বেরোয় তারা, পরিবার গঠনের প্রথম ধাপস্বরূপ। পারফেক্ট হোমের সন্ধান দিতে অদ্ভুতদর্শন এক রিয়েল এস্টেট এজেন্ট তাদের নিয়ে চলে ‘ইয়ন্ডার’ নামক শহরতলিতে। শহরতলির প্রতিটি ঘরই দেখতে একই রকম। খোঁটা দিয়ে ঘেরা, সামনে পেছনে বড়সড় রোয়াক। চকচকে। দেখতে ভারি আমুদে। কিন্তু এই শহরতলি যেন ভীষণ প্রাণহীন, খটখটে। ভয়ের উদ্রেক ঘটায় রীতিমতো। ঘর ঘুরে দেখা শেষে টম আর গেমা আবিষ্কার করল, ওই এজেন্টের কোনো চিহ্নই কোথাও নেই।

এজেন্টের সাথে টম আর গেমার প্রথম সাক্ষাৎ;
Image Source: XYZ Films

বাতাসে মিলিয়ে গেল যেন। পুরো শহরতলিতে টম আর গেমা ছাড়া আর কেউই নেই। তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে গিয়ে তারা বুঝতে পারে, এখান থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। গোটা শহরতলিই যেন একটি গোলকধাঁধা। ঘুরেফিরে তাদের নয় নম্বর ঘরটির সামনেই এসে দাঁড়াচ্ছে তারা। উপায়ান্তর না পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত টম আর গেমা ওই ঘরটিতেই থাকতে শুরু করে। প্রতিদিন সকালে দৈব উপায়ে একটি বাক্স তাদের রোয়াকে হাজির হয়, যাতে তাদের খাবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকে। এমন করেই দুই কি তিনদিন পর একটি বাক্সে তারা একটি বাচ্চা আবিষ্কার করে। সাথে একটি চিরকুটে লেখা,

“একে বড় করে তোলো এবং মুক্তি অর্জন করে নাও!”

তবে অবাক হবার পালা এখানেই শেষ নয়। বাচ্চাটির বৃদ্ধি রাতারাতি বেড়েই চলে। আদৌ মানুষের বাচ্চা এটি? আরো অনেকগুলো প্রশ্নের সন্নিবেশ ঘটিয়ে দর্শকের ঈষৎ ফাঁকা চোয়াল ও কুঁচকানো ভ্রু জোড়ার অভিব্যক্তিকে লক্ষ্য বানিয়ে এগিয়ে চলে ভাইভ্যারিয়াম। 

ইয়ন্ডার নামক সেই শহরতলী;
Image Source: XYZ Films

 

পরিচালক লরকান ফিনেগানের ভাইভ্যারিয়াম একইসাথে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং দ্ব্যর্থবোধক। একটু লম্বা করে দম নিয়ে শুরু হতেই এই সিনেমা তার নিজস্ব ছন্দ এবং টোন প্রতিষ্ঠিত করার কাজে লেগে পড়ে। বলাই বাহুল্য, সেটি অশুভ এবং খুবই সুচিন্তিত। বেশকিছু বিষয়সমূহকে এই সাই-ফাই, হররে একীভূত করেছেন পরিচালক ফিনেগান। এর মাঝে তুলনামূলক সহজ রূপকে নাগরিক জীবনযাপনে জড়িয়ে থাকা একাকিত্বকেই যে কেন্দ্রে রেখেছেন পরিচালক, সেটুকু বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। সিনেমায় ইয়ন্ডারের সেই শহরতলিতে আর কোনো লোকজন দেখা যায় না।

এছাড়া, চিত্রনাট্যে দেখা যায়, টম আর গেমা প্রতিদিন ওই একই বিরক্তিকর, রুটিনবাঁধা পন্থাতেই কাটায়। একই রুটিনে বাঁধা তাদের ওই জীবন, যান্ত্রিক নাগরিক জীবনের একঘেয়েমিরই বহিঃপ্রকাশ। পারফেক্ট হোম, পারফেক্ট লাইফের নামে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজনের অর্থহীন শূন্যতা কেনার ছোটাছুটিকে তীব্রভাবে প্রকাশ করে এই রুটিন। সাথে বলে যায়, সত্যিকারের কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া অর্থহীন হয়ে পড়ে জীবন। এ বক্তব্যের মাঝেই মানুষের অস্তিত্বের বিষয়টিকে প্রতিফলিত করে ভাইভ্যারিয়াম।

শুধু এই-ই নয়, বাক্সে খুঁজে পাওয়া সেই বাচ্চার সাথে যে চিরকুটটিও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তাতে লেখা লাইনটিও একটি গূঢ় অর্থ প্রকাশ করছে। ফিনেগান এ লাইন দিয়ে এই একুশ শতকের প্যারেন্টিংয়ের ধরনকে কটাক্ষ করছেন। সন্তান বড় করা এখন শুধুই যেন একটি দায়িত্ব। সন্তানের সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বাবা-মা’রা আজকাল বোঝেন, তাদের লেখাপড়ায় টাকা ঢেলে, বড় হলেই সেই টাকা ঘরে আনার পন্থা। এ-ও যেন আরেক বিনিয়োগ প্রথা, যা চালিত হয় গভীর আবেগ দ্বারা। সে কারণেই এটিকে বাণিজ্য বলতে মানা। পয়সা আয়ের মেশিন হিসেবে এই পুঁজিবাদী সমাজে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, পিতামাতাদের কাছে সমস্তটাই যেন ব্যর্থ।

তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ বিচরণের এ যুগে বিশ্বাস, ভালোবাসা এখন মুহূর্তে-মুহূর্তে ইন্টারনেটের জালে জমা হওয়া লক্ষ-কোটি ডাটার মতো যেন। বাকিটুকু দায়সারা দায়িত্ব। পরিচালক এই সবকিছুকেই একটা ফাঁদ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যে ফাঁদে গল্পের পৃষ্ঠতলে টম আর গেমা নিজেই পড়েছে। 

সেই শিশুটি পাওয়ার পর;
Image Source: XYZ Films

 

লরফান ফিনেগান অনেক ধারণাকেই সংঘবদ্ধ করেছেন ভাইভ্যারিয়ামে, সেটুকু অস্বীকারের উপায় নেই। তবে তার ধারণা ও বক্তব্যগুলো যে খুব নিগূঢ় হয়ে উঠেনি, তেমনটি অস্বীকারের উপায় নেই। তলিয়ে দেখতে গেলে খুব একটা তল এখানে পাওয়া যায় না। অনেকটা পৃষ্ঠতলের আশেপাশেই থেকেছে। এবং যখনই গভীরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ হয়েছে, তখনই এই সিনেমা তার পরাবাস্তব প্রকৃতিকে ঝেড়ে ‘এলিয়েন ইনভ্যাসন’ ধাঁচের হররে ভিড়েছে। তৃতীয় অঙ্কে চিত্রনাট্য ‘হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট’-এর পরত যুক্ত করেছে। 

চিত্রনাট্যে চরিত্রায়নের দিকটি বেশ সংকীর্ণ, যার মন্দ প্রভাব সিনেমায় পড়েছে। ‘জেসি আইজেনবার্গ’-এর চরিত্রটি গম্ভীর। এই চরিত্রে প্রগাঢ়তা যোগ করার সুযোগ ছিল, কিন্তু কাজে লাগানো হয়নি। এক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো যেতে পারে, শেষত গল্পটি গেমা চরিত্রের। তেমন যুক্তির পিঠে দেখতে গেলে, মাঝের অংশে সহমর্মিতা যোগ করেই কিছুটা গভীরতা গেমা চরিত্রটিকে দেওয়া হয়েছে। এ চরিত্রে ইমোজেন পুটসের অভিনয়ই অভিযোগের সুরটাকে ক্ষীণ করে তোলে। তবে তার আর টমের প্রেমময় সম্পর্কটাকে ঠিকঠাক গড়ে তোলার সুযোগও চিত্রনাট্য দেয়নি। এবং সিনেমার উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধারণাগুলোকে ঠিকঠাক স্তরীকরণ করার মতো শক্ত চিত্রনাট্যও এটি নয়। নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি ধরতে গিয়ে যথার্থ চরিত্রায়ন এবং বিবরণের অভাবে দ্বিতীয় অঙ্কে দুর্বল ও ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে চিত্রনাট্য। 

তবে অনেক অনেক ধারণা ছাড়াও স্টাইলের দিক থেকে অনেককিছু দেওয়ার আছে ভাইভ্যারিয়ামের। স্বকীয় স্টাইল আছে পরিচালক ফিনেগানের। বিশেষত, প্রোডাকশন ডিজাইনিং চোখে পড়ার মতো। সবক’টি ঘরের সবুজ রঙ, আলাদা আলাদা রুমে সবুজ, নীল, বাদামির ডুয়েল টোন প্রাকৃতিক সেটিংয়ের কথা মনে করালেও কেন্দ্রে সেই শীতল একাকিত্বকেই ধরে রাখে। শেষ অঙ্কে গাঢ় লাল হঠাৎ করে চোখ ভড়কানোর পাশাপাশি হররের আবহটাকে আদ্যোপান্ত নিজের করে নেয়। ক্লস্ট্রোফোবিক অনুভূতি জাগায়। 

শেষ অঙ্কে রঙ পরিবর্তনের একটি দৃশ্য;
Image Source: XYZ Films

 

ভাইভ্যারিয়ামের শেষ অঙ্ক প্রথম প্রথম ছন্দের পতন ঘটিয়েছে মনে হলেও, সিরিয়াস ভাবনাতে দেখা যায়, ছন্দটা সংসক্ত এবং সূক্ষ্ম। বক্তব্যটুকুও সময়োপযোগী। ওই ফাঁদে টম আর গেমা’ই নয়, গোটা একটা সভ্যতা পড়ে রয়েছে। সেই বক্তব্যের কারণে ভাইভ্যারিয়াম সীমাবদ্ধতা সাথে নিয়েও বিষয়াদির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভাববার অবকাশ আছে এবং প্রয়োজনীয়তাও আছে।

This article is a review of the film 'Vivarium' (2020). It's the debut film of the director Lorcan Finnegan. It's an ambitious sci-fi film. It's not a great film of the sci-fi genre, but an under appreciated one. 

Featured Image: XYZ Films

Related Articles

Exit mobile version