‘গেইম অফ থ্রোন্স’ শেষ হওয়ায় ফ্যান্টাসি ড্রামার ফ্যানবেস যখন দুর্ভিক্ষের মাঝে তখন তাদের সামনে আগমন হলো ‘দ্যা উইচারের’। তবে এই উইচার সিরিজ আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ সেই সিদ্ধান্তে আপাতত না যাই।
পোলিশ লেখক ‘অন্দ্রে সাবকোওস্কি ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে, প্রথম, ‘দ্যা রোড উইথ নো রিটার্ন’ ছোট গল্পের হাত ধরে উইচারদের পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। উইচারের শুরু হয় ৪টি ছোট গল্পের মাধ্যমে। এক পোলিশ ফ্যান্টাসি ম্যাগাজিনে ছোট গল্প প্রতিযোগিতায় সেই ৮০’র দশকেই তৃতীয় স্থান অধিকার করে সাবকোওস্কির উইচার ছোট গল্প। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় ছোট গল্পগুলো মিলে ১৯৯৪ সালে পোল্যান্ডে দ্যা উইচারের প্রথম বই Krew elfów আর ১৯৯৯ সালে Pani Jeziora দিয়ে উইচারের ইতি টানেন লেখক। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয় উইচারের বই। দ্যা উইচার বইগুলো পোল্যান্ডসহ পুরো বিশ্বে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর অব্ধি প্রায় ১৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। মোট ৪টি ছোট গল্প ও ৫টি উপন্যাস মিলিয়ে এই উইচার উপাখ্যান।
ছোটগল্প
- দ্যা রোড উইথ নো রিটার্ন
- দ্যা লাস্ট উইশ (এন্থলজি)
- সোর্ডস অফ ডেস্টিনি (এন্থলজি)
- সিজন্স অফ স্টর্ম (এন্থলজি)
উপন্যাস
- ব্লাড অফ এলভস
- দ্যা টাইম অফ কনটেম্পট
- ব্যাপটিজম অফ ফায়ার
- দ্যা টাওয়ার অফ দ্যা স্যোয়ালো
- লেডি অফ দ্যা লেইক
উইচারের এই গল্প মোট ৩৭টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। পোল্যান্ডে উইচারের জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে উইচারের আলাদা কাল্ট ও তার অনুসারীর অভাব ছিল না। ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বে যখন উইচারের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ছিল, ২০০১ সালে মারেক ব্রোজকি, একজন পোলিশ নির্মাতা ‘দ্যা হেক্সার’ নামক সিনেমা নির্মাণ করেন যা উইচারের গল্প থেকেই অনুপ্রাণিত। তবে সিনেমা তেমন একটা সাড়া জাগাতে পারেনি।
২০০৯ সালে সিডি প্রজেক্ট রেড নিয়ে আসে রোল প্লেয়িং গেম, ‘দ্যা উইচার’। উইচার গেমের সাউন্ডট্র্যাকসহ পুরো গেমটিই গেমিং জগতে ও গেমারদের মনে ঘাটি গেঁড়ে বসে। চোখের সামনে প্রথমবারের মতো গম্ভীর গেরাল্ট অফ রিভিয়া আর তার সঙ্গিনীদের দেখা পায় গেমাররা। এরপরে ২০১১ সালে আসে দ্বিতীয় গেম ‘দ্যা উইচার ২: এসাসিন্স অফ কিংস’ । ২০১২ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১.৭ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় এই গেমের। তবে প্রথম উইচারের তুলনায় এটি সমালোচকদের কাছে অতটা জনপ্রিয় হলো না। ২০১৫ সালে আসে উইচার জগতের সবচেয়ে বড় গেম ‘দ্যা উইচার ৩: ওয়াইল্ড হান্ট’ । এটি রিলিজ হওয়ার আগে প্রি অর্ডার আসে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কপির। রিলিজের পরে, সে বছর ‘ব্যাটেলফিল্ড হার্ডলাইন’কে পিছে হটিয়ে ইউকের বেস্ট গেম অফ দ্যা ইয়ার হয় উইচার থ্রি। সুন্দর গ্রাফিক্স আর শ্রুতিমধুর সাউন্ডট্র্যাকের এই ৯০-১২০ ঘন্টার গেইম, রোল প্লেয়িং গেইমের জগতে হয়ে গেল গেমারদের প্রথম সারির পছন্দের গেমগুলোর একটি।
২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর সাবকোওস্কির ‘দ্যা লাস্ট উইশ’ ও ‘সোর্ডস অফ ডেস্টিনি’, এই দুই এন্থলজির সমন্বয়ে ল্যরেন স্মিথ হিসরিচ নেটফ্লিক্সে নিয়ে আসেন ‘দ্যা উইচার’ সিরিজ। ‘দ্যা ডিফেন্ডার্স’, ‘ডেয়ারডেভিল’, ‘দ্যা আমব্রেলা একাডেমি’র মতো জনপ্রিয় সিরিজের চিত্রনাট্যকার, হিসরিচ, দ্যা উইচার সিরিজের প্রধান চরিত্র, গেরাল্ট অফ রিভিয়ার ভূমিকায় বেছে নিয়েছেন নতুন যুগের সুপারম্যান হেনরি ক্যাভিলকে।
বাস্তব জীবনে হেনরি ক্যাভিল একজন গেমার। হিসরিচ বলেন, যখন তাদের প্রথম দেখা হয় তার আগেই হেনরি এই গেইম সিরিজের সবকটি শেষ করেছিল আর যখন হেনরি জানতে পারল নেটফ্লিক্স উইচার সিরিজ নির্মাণের চিন্তা করছে তখন সে সবকটি বইও পড়ে শেষ করে। তখনো নেটফ্লিক্সের কাস্টিং শুরু হয়নি তবে হেনরির এই আগ্রহ দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলেন নির্মাতা।
মোট ২১৭ জন গেরাল্টের অডিশন শেষ করে হিসরিচের মাথায় গেরাল্ট চরিত্রের জন্য হেনরির কণ্ঠই উপযুক্ত মনে হচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ হেনরিকে ফোনে গেরাল্ট সম্পর্কে বলতেই হেনরিও রাজী হয়ে গেলেন। এভাবেই নেটফ্লিক্সের পর্দায় প্রথমবারের মতো গেরাল্ট অফ রিভিয়ার আগমন ঘটে। এবার উইচার শুধু বইপ্রেমী কিংবা গেইমারদের নয় সিনেমা-সিরিজ প্রেমীদেরও সম্পদে পরিণত হলো।
উইচার গল্পের গেরাল্ট অফ রিভিয়ার চরিত্রের জন্য বেশ কঠিন ডায়েটে ছিলেন হেনরি ক্যাভিল। এক ইন্টার্ভিউতে তিনি বলেন, এক শার্টলেস দৃশ্যে তার মাসল খুব সূক্ষ্মভাবে বোঝা যাওয়ার জন্য, প্রায় তিনদিন খুব অল্প পরিমাণ পানি পান করেছিলেন। পানির পরিমাণ এতই কম ছিল যে তিনি আশেপাশে কোথাও পানি থাকলে, তৃষ্ণায় সে পানির গন্ধ পেতে শুরু করতেন। এই বিশাল ডেডিকেশনের পাশাপাশি পাগলামোটাও কম ছিল না। উইচারে ব্যবহার করা বেশ কয়েকটা আর্মর ও ড্রেস তিনি নিজের বাড়ি নিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন।
অনেক তো হলো ভূমিকা। এবার একটু গল্পের দিকে যাই। পা বাড়াই উইচারের জগতে। জেনে নিই কে এই উইচার, কী তার কাজ?
নিস্তব্ধ এক জঙ্গল। হঠাৎ কর্দমাক্ত ডোবা থেকে উঠে এলো কিম্ভুতকিমাকার এক জন্তু। সাদা চুলের বিশালদেহী একজন যোদ্ধা তার তলোয়ার চালিয়ে নিমিষেই কুপোকাত করলেন তারচেয়ে ৪-৫ গুণ বড় সেই প্রাণীকে। অন্ধকারের মতো কালো দুই চোখের মণি এই জন্তুকে হত্যার পরেই হলুদ হয়ে গেল। অলৌকিক শক্তির অধিকারী সেই উইচার; গেরাল্ট অফ রিভিয়া, ফিরে এলেন তার মানুষরূপে। চললেন তার প্রাপ্য অর্থ আদায় করতে।
উইচার হচ্ছে মিউটেশন এবং ম্যাজিকের মাধ্যমে সৃষ্ট; অনেকখানি ভাবলেশহীন, অনুভূতিহীন এবং অতি প্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী মানুষ ও পশুর মাঝামাঝি এক প্রাণী। শিশু অবস্থাতেই অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানের ভরণপোষণ করতে না পেরে উইচার তৈরি করার কারিগরদের হাতে তুলে দেন। এই কারখানাগুলো মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম ক্যার মোরহেন। সেখানে বছরের পর বছর ট্রেনিং ও ম্যাজিকের অত্যাচারে বেঁচে ফিরে যে ক’জন, তারাই হয়ে উঠেন উইচার। অর্থের বিনিময়ে দৈত্য-দানো ও জন্তু হত্যা করাই উইচারদের কাজ। এজন্য তাদের আরেক নাম, মনস্টার স্লেয়ার।
মহাদেশের উত্তরের দিকে যখন মানুষ বসবাস করতে শুরু করে তখন তাদের বিভিন্ন জীব-জন্তু, দৈত্য, ভুত-প্রেতের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকাটা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। তাই শাসকেরা তাদের মেইজ অর্থাৎ যাদুকরদের/জাদুকরীদের, এমন এক যোদ্ধা সৃষ্টির আদেশ দেন যে কিনা তাদের এই মুশকিল আসান করতে পারবে। এভাবেই উইচারদের আবর্তন ঘটে। আদতে তারা মানুষদের জীবনের মুশকিল দূর করতে আসলেও মানুষ তাদের তেমন একটা ভালো চোখে দেখে না। রাজা থেকে শুরু করে রাস্তার ভিখারির কেওই উইচারের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করেন না। তবে প্রয়োজনে ডাক পড়ে উইচারের ঠিকই।
গেরাল্ট অফ রিভিয়া, অনেকগুলো উইচারদের মধ্যে বিখ্যাত একজন উইচার। গল্পের আরেক চরিত্র সিরি। যে কিনা সিন্ট্রা রাজ্যের রাজকন্যা। সিরির বাবার এক কার্স ব্রেক করায় গেরাল্ট অফ রিভিয়া উপঢৌকন হিসেবে কী চায় প্রশ্ন করা হলে, গেরাল্ট ‘ল অফ সারপ্রাইজ’ এর সাহায্য নেয়। ‘ল অফ সারপ্রাইজ’ হচ্ছে একটি বরের আবদার করা, যা কী ধরনের বা কী হতে পারে এই নিয়ে দু’পক্ষের কারোরই ধারণা নেই। সাধারণত এই বর হিসেবে অনেকেই তাদের প্রথম সন্তান যে কিনা তাদের সবচেয়ে প্রিয়, তাদের দিয়ে থাকেন। কিন্তু গেরাল্ট জানতেন না যে, সিরি তার মায়ের পেটে ভ্রূণ অবস্থায় আছে। আর এভাবেই গেরাল্ট আর সিরির ভাগ্য এক সূত্রে গেঁথে যায়।
এই সিন্ট্রা রাজ্য আক্রমণ করে নিল্ফগার্ড নামের আরেক রাজ্য। রানী আত্মহত্যা করেন আর ছোট্ট প্রিন্সেস সিরি প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। মৃত্যুর আগে রাণী ক্যালান্থি নাতনিকে বলে যান ভবঘুরে উইচার গেরাল্ট অফ রিভিয়াকে খুঁজে বের করতে। ওদিকে সিন্ট্রার ওপর নিলফগার্ডের এই আক্রমণ শুনে গেরাল্ট বেরিয়ে পড়ে সিরিকে খুঁজতে। দুজন দুজনকে খুঁজলেও মাঝে বাঁধা বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায় অনেক কিছুই।
সিরিকে খোঁজার এই যাত্রাপথে গেরাল্টের দেখা হয় ইয়েনেফার অফ ভেঙ্গারবার্গের সাথে। ইয়েনেফার ছিলেন এক দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী, কুৎসিত আকৃতির কন্যা। এই কুৎসিত কন্যাকেই তার বাবার কাছ থেকে খুব স্বল্প মূল্যে কিনে নিয়ে যায় এক জাদুকরী। তার কাছে থেকেই এই কুৎসিত ইয়েনেফার হয়ে উঠে রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুন্দরী জাদুকরী। অনুভূতিহীন উইচারের মনে এই জাদুকরী ধীরে ধীরে স্থান দখল করতে থাকে। সিরিকে খুঁজতে ইয়েনেফারের পাশাপাশি আরেক বন্ধু যাকে গেরাল্ট প্রকাশ্যে বন্ধু বলে স্বীকার না করলেও, মনুষ্যজাতির মধ্যে এই ব্যক্তিই হয়ত তার প্রকৃত বন্ধু। সে হচ্ছে ড্যান্ডিলায়ন। নেটফ্লিক্স সিরিজে নির্মাতা যার নাম দিয়েছেন ‘হাস্কেয়ার’। গেরাল্ট অফ রিভিয়া, সিরি, ইয়েনিফার আর হাস্কেয়ারের গল্প নিয়েই প্রথম সিজনের সমাপ্তি হয়।
ইয়েনিফার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী ‘অন্যা চালোত্রা’। গেরাল্টের পরে এই চরিত্রের গভীরতা দেখানো হয়েছে পর্দায় সবচেয়ে বেশি। এক কুৎসিত মেয়ে থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী আর সকলের সমীহের চরিত্র হওয়ার এই যাত্রাপথের অভিনয় অন্য মাত্রা লাভ করেছে বেশ ভালভাবেই। এছাড়া সিরি চরিত্রে আছে ২০ বছর বয়সী ‘ফ্রেয়া এলেন’। অভিনয় দক্ষতায় তাকেও ভালো নম্বর দেওয়া যায়। হাস্কেয়ার এর চার্মিং চরিত্রে বেশ সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছেন ‘জোয়ি ব্যাটি’। সব মিলিয়ে কাস্টিং নিয়ে তেমন একটা অসন্তোষ প্রকাশ করেনি উইচার প্রেমীদের কেওই। সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে গেরাল্ট চরিত্রে হেনরির দুর্দান্ত অভিনয়। শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে কণ্ঠের গাম্ভীর্য সবকিছু মিলিয়ে তিনি দশে দশ।
ইতোমধ্যে উইচারের দ্বিতীয় সিজনের ট্রেইলার ইউটিউবে ছেড়েছে নেটফ্লিক্স। ১৭ ডিসেম্বর নেটফ্লিক্সে প্রিমিয়ার হবে দ্বিতীয় সিজন। ভক্তদের অধীর আগ্রহের অবসান ঘটিয়ে আরো কিছু নতুন চরিত্র নিয়ে সাজানো হয়েছে সিজন ২। সিজন ১ শেষে আইএমডিবি তে ৮.২ রেটিং পেলেও, রোটেন টমেটোসে উইচার পায় ৬৮%।
এবার ফিরে যাই গেইম অফ থ্রোন্সের সাথে তুলনা নিয়ে উঠে আসা এক বিশাল প্রশ্নে। এই প্রশ্নের উত্তরে খোদ গেরাল্ট অফ রিভিয়া তথা হেনরি ক্যাভিল বলেন, দুই সিরিজের জনরাই ফ্যান্টাসি। গেইম অফ থ্রোন্সের সাথে উইচার সিরিজের তুলনা করা যাবে যদি এটি পপুলারিটিতে অন্যটির সমমানে পৌঁছায় তবেই। কিন্তু তিনি বেশ আশাবাদী। তাহলে কী হতে যাচ্ছে? তার জন্য দর্শকদের করতে হবে অপেক্ষা।