ট্রেন দেখলেই আমার ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করে। ঢাকা শহরে অনেকগুলো রেল ক্রসিং। গাড়ি নিয়ে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন যায় আর ভাবি, ট্রেনের যাত্রীরা কী সুখেই না আছে। আমার এই উপন্যাসটা ট্রেনের কামরায় শুরু, সেখানেই শেষ। কাহিনী শেষ হয়ে গেছে – ট্রেন চলছেই। মনে হচ্ছে ট্রেনের শেষ গন্তব্য অপূর্ব লীলাময় অলৌকিক কোনো ভূবন।
-হুমায়ূন আহমেদ
উপরের কথাগুলো পড়ে কিছু পাঠক নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ভাবছেন, পুরো একটা উপন্যাসের কাহিনী কীভাবে ট্রেনের এক ভ্রমণেই শুরু হয়ে আবার শেষ হতে পারে! কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কিছুক্ষণ’ বইটিতে ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। উপন্যাসটি ২০০৭ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়।
গল্পের শুরুটা হয় চিত্রা নামক এক তরুণীর ভোগান্তির মাধ্যমে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের তৃতীয় বর্ষের এই ছাত্রী তার অসুস্থ মামাকে দেখতে ট্রেনের মাধ্যমে দিনাজপুর যেতে চাচ্ছিলো, কিন্তু ট্রেনে বিরক্তিকর কোনো যাত্রীর সাথে যেতেও সে রাজি না। তাই সে তার বান্ধবী লিলির প্রভাবশালী এক মামার মাধ্যমে টু সিটার স্লিপারের একটি টিকিট দিতে বলেছিলো, যেখানে কেউ তার সাথে যাবে না।
কিন্তু ট্রেনে উঠে চিত্রা আবিষ্কার করে যে, তার টু সিটার স্লিপারে এক মধ্যবয়সী বুড়ো লুঙ্গি পরে বসে রয়েছে! সে কিছুতেই সেই বুড়োর সাথে এক কামরায় যেতে রাজি ছিল না। তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে ট্রেনের আরেক যাত্রী আশহাব। পেশায় ডাক্তার এই যুবক তার মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলো। সে নিজে ওই বুড়ো ভদ্রলোকের সাথে থাকার কথা বলে চিত্রাকে তার মায়ের কামরায় থাকার প্রস্তাব দেয়। চিত্রা সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে আশহাবের মায়ের কামরায় চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায় আরেক বিপদ!
সুন্দরী চিত্রাকে দেখে আশহাবের মা সাজেদা বেগম তার পুত্রবধূ নির্বাচনের জন্য ভাইভা সেশন শুরু করে দেন। চিত্রার মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই শুনে প্রথমে সাজেদা বেগম পিছু হটলেও কিছু সময় পর এই মেয়েকেই তার পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করে ফেলেন। সেটা শুধুমাত্র পছন্দ করাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো ক্ষতি ছিল না, কিন্তু তিনি এমনভাবে কথা বলতে শুরু করেন যা শুনে চিত্রা কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়।
এদিকে কামরা বদল করে আশহাব আবিষ্কার করে, যে বুড়ো লোকটিকে নিয়ে চিত্রা মহাবিরক্ত ছিল, তিনি পৃথিবীর সেরা দশ গণিতবিদের একজন, নাম আব্দুর রশিদ উদ্দিন। রশিদ সাহেবের সাথে আশহাব বেশ খাতির জমিয়ে ফেলে, তাকে ম্যাজিক দেখিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তও করে ফেলে। এমন সময়ে চিত্রা এসে সাজেদা বেগমের অদ্ভুত সব কথাবার্তার ব্যাপারে আশহাবকে জানালে সে নিজেও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কামরায় ফিরে গিয়ে সে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার নাছোড়বান্দা মা উল্টো তাকেই ভুলভাল বলার দায়ে অভিযুক্ত করে ধমকাধমকি করে। সব মিলিয়ে চিত্রা ও আশহাব দুজনই বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়।
সেই ট্রেনের আরেক কামরায় এক মাওলানা তার গর্ভবতী স্ত্রী আফিয়াকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলো। কিন্তু ট্রেনের ভেতরেই আফিয়ার প্রসব ব্যথা শুরু হয়ে যায়! হতভম্ব মাওলানা ট্রেনে একজন মহিলা ডাক্তারকে খুঁজতে থাকে, কিন্তু পুরো ট্রেনে কোনো মহিলা ডাক্তার ছিল না। চিত্রা ও রশিদ সাহেব মাওলানাকে আশহাবের কথা বলে এবং অনুরোধ করে আশহাবকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু মাওলানা কোনো অবস্থাতেই তার স্ত্রীর জন্য কোনো পুরুষ ডাক্তার নিয়ে যেতে রাজি হয় না। এদিকে আফিয়ার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে।
ট্রেনের সবাই কম-বেশি বিপদে থাকলেও অন্যতম অদ্ভুতুড়ে অবস্থায় ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল খায়ের খান। ট্রেনে উঠেই তিনি জানতে পারেন, মন্ত্রীর পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে মন্ত্রীর স্ত্রী সুরমার এক দুর্ব্যবহারের সূত্র ধরে ট্রেনের কর্মচারীরা তাদের উপর নানা ধরনের প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। এসব কর্মকাণ্ড দেখে মন্ত্রীর পরিবার বেশ ভীত হয়ে পড়ে।
শেষপর্যন্ত এই বিপদের হাত থেকে কীভাবে মন্ত্রী মহোদয় রক্ষা পাবেন? অন্য কামরায় থাকা মাওলানার স্ত্রীর কী হবে? আশহাব কি ওই মহিলাকে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পাবে, নাকি একজন মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? চিত্রা আর আশহাবেরই বা কী হবে? সাজেদা বেগমের অদ্ভুত সব পাগলামি কি কাজে লাগবে, নাকি তারা যে যার পথে চলে যাবে? এসব নিয়েই কিছুক্ষণের গল্প এগিয়ে গেছে।
আকারের দিক থেকে ‘কিছুক্ষণ’ বেশ ছোট আকারের উপন্যাস, তাই একেকটি চরিত্র পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠতে যতটা সময় দরকার ততটা সময় পাওয়া যায়নি। তারপরও স্বল্প সময়ে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে লেখক বেশ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
চিত্রা
গল্পের নায়িকা চিত্রাকে নিয়েই উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয়েছে। চিত্রা কিছুটা অন্তর্মুখী ধরনের মেয়ে, নতুন কারো সাথে মানিয়ে নিতে তার সমস্যা হয়। তবে অপরিচিত আশহাবের সাথে সে অল্প সময়েই বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিলো। আশেপাশের অপরিচিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে চিত্রা বেশ সচেতন। এ কারণেই সাজেদা বেগম যখন পানে জর্দা না থাকায় আশহাবের সাথে রাগারাগি করছিলেন, তখন সে নিজেই সাজেদা বেগমের জন্য জর্দা কিনে এনেছিলো।
তার পরোপকারী চরিত্রের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় মাওলানার স্ত্রী আফিয়ার প্রসব বেদনার সময়ে, সে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে আফিয়াকে বাঁচাতে চেষ্টা করে গেছে। একদম কঠিন সময়ে সে অপরিচিত আফিয়ার জন্যই কেঁদেছে।
আশহাব
কিছুক্ষণের নায়ক আশহাব বহুমুখী গুণের অধিকারী। গল্পের শুরুতেই চিত্রাকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে সে যেভাবে এগিয়ে আসে তাতে তার পরোপকারী চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেভাবে অল্প সময়েই সে চিত্রা কিংবা রশিদ সাহেবের মতো অপরিচিত মানুষের সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে তাতে তার আসর জমানোর ক্ষমতার ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। পুরো উপন্যাস জুড়েই নিজের মা সাজেদা বেগমের অদ্ভুতুড়ে আচরণ নিয়ে সে বিরক্ত ছিল।
আশহাবের সেন্স অফ হিউমারও দারুণ, গল্পের কঠিন সময়েও কৌতুকময় কিছু সংলাপ বলে সে পরিস্থিতিকে হালকা করার চেষ্টা করে গেছে। চিত্রার সাথে তার সংলাপগুলোও বেশ আকর্ষণীয়।
রশিদ উদ্দিন
গল্পের শুরুতে রশিদ সাহেবকে অজপাড়াগাঁয়ের সাধারণ কোনো মানুষ মনে হলেও পরে জানা যায় তিনি একজন বিখ্যাত গণিতবিদ। অতি বিখ্যাত মানুষের সাদামাটা জীবনযাপনের এক দৃষ্টান্ত এই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি সবকিছুতেই অঙ্কের ছোঁয়া খুঁজে আনন্দ পান, তবে তার জগত শুধুমাত্র অঙ্কের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। আফিয়ার জীবন বাঁচাতে তিনি যেভাবে মাওলানার সাথে তর্ক করেছেন, তাতে মানুষের প্রতি তার মমতাটাও ফুটে ওঠে। একদম শেষের দিকে তিনি যেভাবে কঠিন সত্যগুলো বলে মন্ত্রীকে কটূক্তি করেছেন, তাতে তার সাহসী মনোভাবের পরিচয়ও পাওয়া যায়।
সাজেদা বেগম
উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি হাসির উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন আশহাবের মা সাজেদা বেগম। তিনি এমন একজন মানুষ যার কাছে নিজের মতটাই সব, অন্যের মতামতের গুরুত্ব তার কাছে নেই। চিত্রাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ হওয়ার পর তার উদ্ভট আচরণগুলো সেটার প্রমাণই দেয়। যদিও আশহাবের ভাষায় সবকিছুই তার মায়ের পাগলামি, কিন্তু আসলেই এগুলো পাগলামি নাকি নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার একটা উপায় তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে বহু উল্টাপাল্টা কথা বলা এই মহিলাই যখন আফিয়ার বিপদে তার পাশে দাঁড়িয়ে বিপদ মোকাবেলার চেষ্টা করতে থাকে তখন তার বিচক্ষণতারও প্রমাণ পাওয়া যায়।
এছাড়াও উপন্যাসে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল, যাদের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে। মন্ত্রী আবুল খায়ের ও তার পরিবারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এ দেশের ক্ষমতার লোভে অন্ধ মানুষদের একটি চিত্র তুলে ধরে। এছাড়া উপন্যাসে সশরীরে উপস্থিত না থেকেও মোবাইলে বিভিন্ন উদ্ভট কথাবার্তা বলে চিত্রার বান্ধবী লিলি বেশ আনন্দ দিয়ে গেছে।
‘কিছুক্ষণ’ একটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস, তবে বিভিন্ন মজার ঘটনার মাঝেই লেখক সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের সেরা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হলে হয়তো এই উপন্যাস একটু পেছনের দিকে থাকবে, তবে পাঠক যদি নির্মল বিনোদন পেতে চান, তাহলে নির্দ্বিধায় এই উপন্যাসটি পড়ে নিতে পারেন। বিশেষ করে কোনো ট্রেন ভ্রমণের মাঝে পড়লে বইটা আরো বেশি ভালো লাগবে। মন খুলে কিছুক্ষণ হাসার জন্য হলেও ‘কিছুক্ষণ’ উপন্যাসটা পড়া যেতেই পারে।