মিনেচার সেটে লাল সোয়েটার গায়ে, টেনিস জুতা পায়ে তিনি এসে বসলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে পিয়ানোর দু-তিনটি নোটের শব্দ ভেসে আসলো। ক্যামেরার দিকে সরাসরি ফিরে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। কী অদ্ভুত কমনীয়তায় ভরা তার কথাগুলো। রাজ্যের সকল অস্থিরতা, অশান্তি থেকে নির্মেঘ দূরত্ব বজায় রেখে খুবই শান্ত স্বরে, হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। কথা বলছেন তার প্রতিবেশীকূলের নতুন এক প্রতিবেশীকে নিয়ে। ক্যামেরার দিকে সরাসরি চেয়ে যেভাবে কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি সাক্ষাতকার দিচ্ছেন কোনো এক ডকুমেন্টারিতে। আদতে তেমনটি নয়। এই পুরো সেটআপই তার বিখ্যাত সেই শো-এর আদলে করা। তিনি কিংবদন্তী টিভি ব্যক্তিত্ব ফ্রেড রজার্স।
বিখ্যাত টিভি শো “ফ্রেড রজার্স’স নেভারহুড” যে তারই সৃষ্টি। সুদীর্ঘ ৩৩টি বছর ধরে সচল রেখেছেন তিনি এই শো। কত অজস্র শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশের পথ তিনি তৈরি করে দিয়েছেন তার এই শো দিয়ে তা কল্পনার বাইরে। এতটুকু পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে, এই সিনেমা তবে ফ্রেড রজার্সের বায়োপিক। বায়োপিকের প্রচলিত অর্থে বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমা এটি নয়। এমনকি ফ্রেড রজার্স এই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রও নন। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র ধরতে হয় সাংবাদিক লয়েড ভোগেলকে। ১৯৯৮ সালে ‘এস্কয়ার’ ম্যাগাজিনে কিংবদন্তী ফ্রেড রজার্সকে নিয়ে সাংবাদিক টম জুনোদের লেখা আর্টিকেলের উপর ভিত্তি করেই এই সিনেমা। সিনেমায় সাংবাদিকের নাম পরিবর্তনসহ সাংবাদিক চরিত্রটিতে বেশ কিছু ফিকশনাল বিষয় যোগ করা হয়েছে।
বদমেজাজি সাংবাদিক লয়েড ভোগালকে তার ম্যাগাজিন সম্পাদক, ফ্রেড রজার্সের উপর ৪০০ শব্দের একটি আর্টিকেল লেখার দায়িত্ব দেন, তাদের ম্যাগাজিনের ‘হিরো’ এই বিষয়ের উপর। ভোগেল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়। মেজাজের জন্য ইতিমধ্যেই নামের আগে বেশ কুখ্যাতি জড়িয়েছে ভোগেল। তাই বলেই তো সচরাচর কেউ তাকে সাক্ষাতকার দিতেও চায় না। নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতেই এবার মেজাজটাকে ধীর করে এই কাজটা তাকে করতেই হবে।
ভোগেলের এই তিরিক্ষি মেজাজের একটা অতীত ইতিহাস অবশ্য আছে। ছেলেবেলায় মা মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় বাবাকে সে সংসার ছেড়ে অন্য নারী নিয়ে হেসে-খেলে বেড়াতে দেখেছে। মায়ের মৃত্যুর পর তারা বাবাকে পাশে পায়নি। দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবার প্রতি জমে থাকা ক্ষোভ তাকে ক্রোধে অস্থিরচিত্তের করে তুলেছে। বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং ক্রোধ তার মানবিক গুণাবলীতে আঘাত হেনেছে। সেখান থেকে জন্ম নেওয়া মেজাজই সে বয়ে বেড়াচ্ছে এতকাল ধরে।
নিজের আবেগটাকে সামলানো শেখেনি ভোগেল। একমাত্র বোনের বিয়েতে বাবার সাথে তো মল্লযুদ্ধেই জড়িয়ে গিয়েছিল। নাক ফাটিয়ে, চোখের নিচে কালো দাগ বানিয়ে ভোগেল পিটসবার্গে হাজির হলো রজার্সের সাক্ষাতকার নেবে বলে। রজার্সের সাথে ক্ষণিক কথোপকথনেই সে বুঝে নিল, তাকে দিয়ে এই নিবন্ধ লেখা সম্ভব না। কিন্তু রজার্স দেখেছে ভিন্ন কিছু। রজার্স এই বদমেজাজি ব্যক্তিত্বের পেছনে বিদীর্ণ হৃদয়ের একজন মানুষকে দেখেছে। কাছে টেনে একটুখানি উষ্ণতা দেবে- এমন আশা করা ভালোবাসার এক কাঙালকে দেখেছে। কিন্তু আলতো করে হাতটা ঘাড়ের উপর রেখে কাছে টেনে উষ্ণতা দিতে পারার মতো কমনীয়তা ভোগেল ধারণ করে না। ক্ষমাশীলতা নেই তার মাঝে। মেনে নেওয়াটা দুঃসাধ্য ঠেকে তার কাছে। ধীরে ধীরে রজার্সের সাক্ষাতকার নেওয়ার এই গল্প উল্টে দাঁড়ায় ভোগেলের আত্মশুদ্ধির গল্পে।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছিল, প্রচলিত ঘরানার বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমা এটি নয়। ফ্রেড রজার্সকে ঘিরে কিংবা তার ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাবলীর আখ্যান ‘অ্যা বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড‘ নয়, বরং যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছিল তাদের উপর রজার্স কতখানি প্রভাব রেখেছে, সেই গল্প বয়ান করে এই সিনেমা। ভোগেলের লেখা নিবন্ধের মতোই ঠিক যেন বায়োগ্রাফিক্যাল নিবন্ধ’ এই সিনেমা। মনের অন্ধকার দিকটিতে আলো ফেলা, ক্ষমাশীলতার সুদূরপ্রসারী প্রভাব, দুঃখকে মেনে নিতে শেখা, বন্ধুত্বের মাহাত্ম্য আলোচনা করা হৃদয়াঙ্গমকারী আখ্যান ‘অ্যা বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড‘।
সিনেমার ফিকশনাল অংশুকে ‘পিওর ম্যানুপুলেশন’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। (তবে সেটা খারাপ অর্থে নয়।) বদরাগী সাংবাদিকের চরিত্রটি ক্লিশেই। অনেকটা ‘এমনই হওয়ার ছিল’ এ ধরনের ক্লিশে। কিন্তু সেই ক্লিশে, ক্লিশে হয়ে ধরা দেয়নি। বরঞ্চ বেশ কাজের হয়ে ধরা দিয়েছে। যে বার্তা এই সিনেমা বহন করছে, সেজন্য হলেও এই ক্লিশে প্রয়োজনীয় ছিল। ছেলেবেলার নৈতিকতার যে শিক্ষা পরিণত বয়সের উষ্ণ রক্তের দাপটে হারিয়ে যায় বা যেতে বসে, সেই শিক্ষাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই সিনেমা। লয়েড চরিত্রটির চেনা বৃত্তের প্রয়োজনীয়তাও তাই সৃষ্টি হয় এখানটায়। লয়েড, চেনা বৃত্তের ছক কেটে তৈরি চরিত্র হলেও ‘বাহুল্যবর্জিত’ আকারে চরিত্রটি লেখা হয়েছে এবং অভিনয়ে নির্ভুলতার সাথে রূপায়িত হয়েছে। ম্যাথিউ রাইস এই চরিত্রটির জন্য যথোপযুক্ত। বিষণ্ণ, বদরাগী আবার মরিয়া স্বভাবের পরিচয়ও পাওয়া যায় এই চরিত্রে। নিজের মেজাজটা সম্পর্কে সে বোঝে, মেজাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভেতরে ভেতরে যে প্রচণ্ড রকমের মরিয়া সে হয়ে উঠেছে তা উপলব্ধি করতে পারে সে রজার্সের সংস্পর্শে এসে। এবং ম্যাথিউ রাইসের অভিনয়ই বলে দেয় চরিত্রটি কতটা গভীরভাবে বুঝেছেন তিনি। অনুভব করেছেন। ভোগেল চরিত্রের সেই দ্বান্দ্বিকতা নিজের মাঝে ধারণ করেছেন।
ওদিকে রজার্স চরিত্রটি দর্শক দেখতে পায় ভোগেলের চোখ দিয়ে। সময়ে সময়ে রজার্সকে মনে হয় খুবই সাদামাটা, অনাড়ম্বর। হ্যাঁ, ফ্রেড রজার্সকে লোকজন সেভাবেই ভাবত এবং দেখত। তাই চরিত্রের গাঁথুনিও রাখা হয়েছে সেভাবে। তার পর্দার ব্যক্তিত্বকেই বাস্তব জীবনের ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। এবং এই চরিত্রটি রূপায়নে কিংবদন্তি অভিনেতা টম হ্যাংকস একেবারে নিখুঁত কাস্টিং। ফ্রেড রজার্স চরিত্রটির স্বভাব-বৈশিষ্ট্যকে এতটা প্রগাঢ়ভাবে তিনি নিজের মাঝে ধারণ করেছেন যে, চরিত্র আর অভিনেতা কাউকেই আলাদা করা যাচ্ছিল না। হ্যাংকস শুধুমাত্র রজার্সের কমনীয়তাকেই নিজের মাঝে বহন করে চলেননি, বরং ব্যক্তি ফ্রেড রজার্সকেও যথাযথভাবে চিত্রিত করেছেন। রজার্সের শান্ত, ধীর, সম্মোহনী ক্ষমতাযুক্ত সেই সুরকে পুরোপুরি রপ্ত করেছেন তিনি।
ভোগেল এবং রজার্স- দুটি চরিত্রই বিপরীত মেরুর। বিচ্ছিন্ন, বিষাদগ্রস্ত ভোগেল যখন রজার্সের সংস্পর্শে আসে, তখন তার চেহারায় আলোর দ্যুতি দেখতে পাওয়া যায়। খুব ভদ্রোচিত স্বরেই রজার্স দাবী করে, ভোগেল যেন তার ভেতরের অন্ধকারকে মেলে ধরে রজার্সের সামনে। বদরাগী ভোগেলও তখন নরম হয়ে পড়ে। আর দুজনের এই নিবিড় মুহূর্তগুলোকে বর্ণনা করতে চিত্রনাট্য যথোপযুক্ত সাহায্যই করেছে। একসাথে নব্বইয়ের দশকে প্রিন্ট মিডিয়ার সেই সুসময়টাকে যত্নের সাথে তুলে এনেছে চিত্রনাট্য। এবং এই ধাপটি সাক্ষাত নস্টালজিয়া দ্বারা চালিত হয়েছে, যা চিত্রনাট্যকার নোয়া হার্পস্টার এবং ফিজারম্যান ব্লুর লেখনীতে সুস্পষ্ট।
তাদের লেখনী মনোরম এবং একই সময়ে সংলাপে একটা নম্রতাবোধও জড়িয়ে আছে। আর চিত্রনাট্যের এই মনোহর বিষয়টির সবটুকু নির্যাস তার পরিচালনায় ব্যবহার করেছেন ম্যারিয়েল হেলার, যিনি মাত্র তিনটি সিনেমা দিয়েই হলিউডের বর্তমান নারী পরিচালকদের মাঝে শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছেন। দৃঢ়তা এবং নিজস্বতা আছে তার কাজে। তার পূর্বের দুটি সিনেমা ‘দ্য ডায়েরি অফ অ্যা টিনেজ গার্ল’ (২০১৫) এবং ‘ক্যান ইউ এভার ফরগিভ মি(?)’ (২০১৮) দেখার পর এই সিনেমা দেখতে বসলেই নিজস্বতা এবং ধারাবাহিকতার দিকটি চোখে পড়বে। এই তিনটি সিনেমা পাশাপাশি রেখে দেখতে গেলে শুরুতেই চোখে পড়বে যে, তিনটিই প্রচলিত ঘরানার বাইরের বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমা।
শিল্পী ফিবি গ্লোয়েকনারের সেমি-অটোবায়োগ্রাফিক্যাল ‘দ্য ডায়েরি অফ অ্যা টিনেজ গার্ল’-এ দেখা যায় একজন উঠতি বয়সের তরুণীর যৌনবাসনা আর চপলতার গল্প। ‘ক্যান ইউ এভার ফরগিভ মি’-তে দেখা যায়, লেখিকা লি ইসরায়েল এবং তার বৃদ্ধ বয়সের অদ্ভুতুড়ে অপরাধ জীবনের সমব্যথী গল্প। আর এই সিনেমায় কিংবদন্তী ফ্রেড রজার্সকে দর্শক আবিষ্কার করে একদম ভিন্ন এক কোণ থেকে। এবং কাছ থেকে লক্ষ্য করলে হেলারের তিনটি সিনেমাতে আরো দেখা যায়, ভুল-ত্রুটি আর জটিলতায় আচ্ছন্ন চরিত্রগুলোকে তিনি পর্দায় চিত্রায়িত করতে ভালোবাসেন।
চরিত্রগুলো দেখে মনে হয়, আশপাশে হেঁটে বেড়ানো মানুষই এরা। একদম বাস্তব। মানসিক সমস্যায় জরাগ্রস্ত, কিছু বলতে গিয়েও ইতস্তত বোধ করা মানুষগুলোর গল্প বলতেই যেন উন্মুখ হয়ে থাকেন হেলার, ঠিক এই সিনেমার লয়েড ভোগেল চরিত্রটির মতো। এবং এই গল্পগুলোতে রসবোধের পরত যোগ করায় ভালোই পারদর্শী হেলার। সেটিও ছাপিয়ে ওঠে ভুল-ত্রুটিতে ভরা এই মানুষগুলোর প্রতি তার সহমর্মিতা এবং বক্তব্যের সূক্ষ্মতা।
কয়েকটি দৃশ্যেই সেই পরিচয় মেলে। রেস্টুরেন্টে পিনপতন নীরবতার সেই দৃশ্যটি কিংবা সাবওয়ে ট্রেনে শিশুদের ও সহযাত্রীদের সমস্বরে “মিস্টার রজার্স’স নেভারহুড” টিভি শোয়ের থিম সং গেয়ে ওঠার সেই দৃশ্যটির কথাই যদি বলা হয়, এই দৃশ্যগুলোতে চরিত্রগুলোর প্রতি হেলারের সহমর্মিতা, ভালোবাসা চোখে পড়ে। এই দৃশ্যগুলোতে যে আবেগ জড়িয়ে আছে, অপরিপক্ব হাতে হয়তো তেমনটি হতো না। এই দৃশ্যগুলো রীতিমতো প্রাণ এনে দিয়েছে সিনেমায়। সেই সাথে টিভি শো’র আদলে গড়া ‘লিট’ সেট এবং ‘নেইট হেলার’-এর আবহসঙ্গীত (যা টিভি শোয়ের থিম সংয়ের কথা বারবার মনে করায়) পূর্ণতা এনে দিয়েছে।
বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলোর প্রতি হেলারের নিবিড় বোঝাপড়াই সিনেমার অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে সফল করে তুলেছে। হেলার শুধুমাত্র রজার্স-ভোগেলকে সুখী হওয়ার মন্ত্র দেননি, বরং জীবনে চলার পথে কিছু কিছু সময় বিমর্ষতাকে কীভাবে মেনে নিতে হয়, সেই উপায় শেখাচ্ছেন। এবং এই দিকটিই ‘অ্যা বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড‘-কে বিষয়বস্তুর প্রতি সৎ এবং নৈপুণ্যতায় ভরা এক হোমেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে