‘ন হন্যতে’, যার অর্থ ‘It does not die’ বা যার ‘ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই’! এটি মূলত মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। প্রাক্তন প্রেমিক মির্চা এলিয়াদের লেখা ‘Bengali Nights’ বা ‘লা নুই বেঙ্গলী’ বইয়ের প্রত্যুত্তর এ বইটি।
১৯৩০ সালে ঘটে যাওয়া একটি কাহিনীর স্মৃতিচারণ এই উপন্যাস। চল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী দেবীর প্রাক্তন বিচ্ছেদের পুনর্জাগরণ প্রকাশ পেয়েছে এই ‘ন হন্যতে’তে। যেন আগের সেই দিনগুলো এখনও তার জীবনে অম্রিয়মান, এখনও খুব স্পষ্টভাবে ভাসছে তার চোখের পাতায়, হাত বাড়ালে এখনও ছোঁয়া যাবে আগের সেই প্রিয় মানুষটিকে।
সম্পূর্ণ ভিনদেশি ছাত্র মির্চা এলিয়াদ। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়ছেন মির্চা, মৈত্রেয়ীর বাবার কাছে। মৈত্রেয়ীর পরিবার বেশ সম্ভ্রান্ত, উচ্চশিক্ষা আর জ্ঞান তপস্যায় বিশ্বাসী। বিশেষ করে মৈত্রেয়ীর বাবা। মেয়ের পড়াশোনার দিকে তাই তার ঝোঁকটাও বেশি। আগের দিনের মানুষদের মতো মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি রক্ষণশীল নন। বরং উল্টো। সাহিত্যচর্চার প্রতি মন আছে তার। মেয়েকেও সেরকমটি করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন গোড়া থেকেই। সে সময়কার সব গণ্যমান্য বিখ্যাত সাহিত্যিকদের যাতায়াত ছিল তার বাড়িতে। এমনকি কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। মৈত্রেয়ীও উপস্থিত থাকতেন তাদের মাঝে। আর রবীন্দ্রনাথ আসলে তো পড়িমরি করে ছুটে যাওয়া তার চাই-ই চাই। কবিগুরু তার সাধক ছিলেন যে!
রবিঠাকুর! যার সাহচর্য লাভের আশায় তখন অধিকাংশ লেখক-লেখিকাই হা-পিত্যেশ করে মরতেন। আর মৈত্রেয়ী কত কাছ থেকে রবিঠাকুরকে গুরু হিসেবে পেলেন! অল্প বয়স থেকেই তার সাহচর্যে থেকে সাহিত্যের ভিত তৈরি করলেন। তাকে পরম শ্রদ্ধায় নিজের ভালোবাসার ঠাকুরের আসনে বসালেন। এ ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, এ ভালোবাসায় কাউকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে দ্বিধাবোধ হয় না, পাপও হয় না।
মির্চা আর মৈত্রেয়ীর পড়াশোনা একাধারে চলতে থাকে। রক্ষণশীলতার পর্দা এ পরিবারের দোরগোড়ায় ছিল না বলে তাদের বন্ধুত্বের শুরুটি অবাধ ছিল। মির্চা মৈত্রেয়ীর কাছে ভারতীয় ভাষা আর সংস্কৃতি রপ্তে মনোযোগী ছিলেন, আর মৈত্রেয়ী ভিনদেশী ভাষা শেখায়। দিনে দিনে তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা বাড়তে থাকে। দেশীয় সংস্কৃতি আর নিয়ম-কানুনকে হার মানিয়ে মৈত্রেয়ীর জীবনে আসে প্রেম, সম্পূর্ণ এক ভিনদেশীর প্রতি। মির্চারও ঠিক তা-ই। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি দাবিয়ে রাখতে পারেনি তাকেও।
তারা জানতেন, মৈত্রেয়ীর পরিবার এ সম্পর্কটিকে সহজে মেনে নিতে চাইবেন না। মৈত্রেয়ীর মা যতই তাকে ছেলের মতো নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিক, মৈত্রেয়ীকে তার হাতে তুলে দিতে যে সবাই দশ পা পিছিয়ে যাবেন, এ তাদের দুজনেরই জানা ছিল মনে মনে। তাও ক্ষীণ আশা নিয়ে তাদের প্রেম অবাধে বেশ ভালোই চলছিল। খুনসুটি, রাগ, অভিমান, রাগ ভাঙানোর খেলা, বেড়াতে যাওয়া… এসব নিয়ে চলছিল বেশ। মির্চা মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি মৈত্রেয়ীর ভালোবাসা নিয়ে অভিমান করতেন, ঈর্ষান্বিত হতেন। তা দেখে মৈত্রেয়ী হেসে কুটিকুটি হতেন।
একদিন বাঁধ সাধলো তাদের প্রেমে। মৈত্রেয়ীর অবুঝ ছোট বোনের ধারণা জন্মালো, মির্চা শুধু তার দিদিকেই ভালোবাসে। আদর করে। তাকে একেবারেই করে না। তার খেয়াল রাখে না। এ অভিমানের কথা সে জানালো তার মাকে। আর মায়ের কল্যাণে একে একে সবাই জেনে গেল তাদের কথা। মির্চা অনেক করে বোঝালেন মৈত্রেয়ীর বাবাকে। ভাগ্য সহায় ছিল না তাদের। এক কাপড়ে মৈত্রেয়ীর বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হলো মির্চাকে। দো’তলা থেকে এসব দেখে মৈত্রেয়ী মূর্ছা গেলেন। পরে দিদির শরীরের এমন বিপদাপন্ন অবস্থা দেখে মৈত্রেয়ীর ছোটবোন অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো। আগে থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল সে। শেষে এ অপরাধবোধ তাকে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তারপর রেহাই দেয়। মৈত্রেয়ীর পরিবারে নেমে আসে আরেক বিপর্যয়।
তারপরও মৈত্রেয়ী কারও না কারও হাতেপায়ে ধরে তাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেন মির্চার সাথে। তবে মির্চার কথা দেওয়া ছিল মৈত্রেয়ীর বাবার কাছে, কোনোভাবেই যোগাযোগ রাখবেন না তারা। শিক্ষাগুরুর কথা রাখতে নিজের সাধটিকে মাটি চাপা দিয়েছিলেন মির্চা। তাও মৈত্রেয়ী অনেকদিন যাবৎ তার চেষ্টা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন, প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন মির্চার সাথে যোগাযোগের। হয়নি। ভারতীয় জাত-সংস্কৃতিরই জয় হয় শেষ পর্যন্ত। মৈত্রেয়ীও মনে অভিমান জমিয়ে পুনরায় যোগাযোগের চেষ্টা করেননি মির্চার সাথে। ফলাফল- বিচ্ছেদ।
চল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী দেবী কাছের মানুষটির ভারতে ফেরার খবর পেয়ে স্মৃতিচারণ করেন তার পুরনো দিনগুলোর কথা। এত বছর সফল সাংসারিক জীবন অতিবাহিত করার পরও সেই মানুষটির প্রতি অনুভব করেন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। ছুটে যান শিকাগোতে, তার খোঁজে। সমস্ত অভিমান তুলে রেখে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন তার স্বপ্নের মির্চাকে। কিন্তু পুরো গল্পের ট্র্যাজেডি এই- মির্চা ফিরে তাকাননি তার দিকে। চোখগুলো পাথর হয়ে গিয়েছিলো তার।
মির্চার প্রতি মৈত্রেয়ীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার নিদর্শন এই ‘ন হন্যতে’, যা আমৃত্যু, যা হন্যমানে শরীরে।
বইটির শব্দচয়ন অসাধারণ। লেখিকার গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায় উপন্যাসটি পড়ে। চঞ্চল, জেদী, অকুণ্ঠ, তরুণী মৈত্রেয়ী কী করে হতাশায় ডুবে ভালোবাসার মানুষটির অভাবে ধীরে ধীরে ধৈর্যশীল, শান্ত আর পরিণত হয়ে উঠেন তারই প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
বইয়ের নাম: ন হন্যতে || লেখক: মৈত্রেয়ী দেবী
প্রকাশক: জয় প্রকাশন || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম