এখানে সমাহিত আছেন সাদাত হাসান মান্টো। তার সাথে সমাহিত আছে গল্প লেখার শিল্পের রহস্য ও কলাকৌশল। শত শত মণ মাটির নিচে শুয়ে তিনি ভাবছেন, কে বড়ো গল্পকার—মান্টো, না খোদা?
– অনুবাদ: জাভেদ হুসেন
মৃত্যুর আগে নিজের এপিটাফের জন্য এই ছত্রগুলো রচনা করেছিলেন উর্দু তথা বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের একজন সাদাত হাসান মান্টো। দেশভাগের অনিঃশেষ যন্ত্রণা, কাতরতা, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট সাবয়ব হয়েছে তার নিরাসক্ত কলমে। উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান কথাকার জীবদ্দশায় ছিলেন উপেক্ষিত; ঔপনিবেশিক প্রভু, ‘নয়া-আজাদ’ রাষ্ট্র, মৌলবাদী কিংবা প্রগতিশীল- সকলে তাকে খারিজ করেছে। কিন্তু বহতা জীবননদীর সকল সুশ্রী-কুশ্রী বাঁক আপন পেন্সিলে ফুটিয়ে তোলা থেকে নিরস্ত করতে পারেনি কেউ। নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ চলচ্চিত্রটি ধরতে চেষ্টা করেছে এই মহান লেখকের কর্মজীবন।
‘মান্টো’ অভিনেত্রী-পরিচালক নন্দিতা দাসের দ্বিতীয় ছবি। প্রথম ছবি ‘ফিরাক’ (২০০৮)-এও গুজরাট দাঙ্গা-পরবর্তী টালমাটাল সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করেছেন নন্দিতা। ঠিক দশ বছর পর, ২০১৮’তে, ‘মান্টো’ দিয়ে পরিচালক রূপে তার প্রত্যাগমন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০- ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অব্যবহিত পূর্বের ও পরের দুই বছর মিলিয়ে এই চার বছরের ‘মান্টোইয়াত’কে পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক। ছবির কাহিনি গড়ে উঠেছে মান্টোর জীবনের দুটি ঘটনাবহুল পর্যায়কে কেন্দ্র করে- বম্বে শহরে স্বাধীনতা-পূর্ব পর্যায়, ও লাহোর শহরে স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়।
ছবির গল্প যেখান থেকে শুরু হয়েছে, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলিত জীবনে স্বস্তি না পেয়ে কাশ্মীর ঘুরে জীবিকার খোঁজে মান্টো তখন বম্বেতে। ততদিনে তিনি লিখেছেন বেশ ক’টি সাড়াজাগানো ছোটগল্প, রেডিও নাটক এবং চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য; তদানীন্তন শিল্পীসমাজে তার স্বতন্ত্র পরিচিতি হয়েছে। শুরুর দৃশ্যে দেখা যায়- স্ত্রী সাফিয়া মান্টোর ‘দশ রুপিয়া’ গল্পটি পড়ছেন, পিতার ছবি মুছতে মুছতে তা শুনছেন মান্টো- সাথে সাথে দর্শক দেখছেন কাহিনির চিত্ররূপ। এরপরেই দেখা যায় চিত্রনাট্যের টাকা আদায় করে মান্টো সমসাময়িক সাহিত্যিক ইসমত চুগতাই, কৃষণ চন্দর প্রমুখের সাথে এক ইরানি চায়ের দোকানে আড্ডা মারছেন। কিন্তু তার এই সুসময় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
চারদিকে ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, ব্রিটিশরাও ভারত ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই ভারতের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে। স্ত্রী-কন্যাকে জড়িয়ে ধরে যে মান্টো স্বপ্ন দেখতেন ‘আজাদ হিন্দুস্তানে’ জন্মাবে তার অনাগত দ্বিতীয় সন্তান, তারই সুখনীড়ে একদিন হাজির হলো ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’-এর সৈনিকেরা। তারা জানিয়ে দেয় এই দেশ মান্টোর নয়, কারণ তিনি মুসলমান। পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে উড়োচিঠি আসতে লাগল ‘ফিল্মিস্তান স্টুডিও’তে, কেন তারা মান্টোর মতো এত এত মুসলমান কর্মীকে রাখছে তাদের প্রতিষ্ঠানে! এর মধ্যে এক নিকট বন্ধুর আচরণ বিচলিত করে মান্টোকে। মান্টোর এক শিখ বন্ধু শ্যাম, তার পরিবার পাকিস্তান থেকে মুসলমানদের হাতে নির্যাতিত হয়ে চলে আসে ভারতে। তাদের যন্ত্রণার কাহিনি শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়া শ্যাম মুসলমানদের শাপ-শাপান্ত করতে থাকেন, পারলে খুন’ করবেন তিনি তাদের- এমনটা বলে বসেন।
মান্টো বলেন, তিনিও তো মুসলমান। শ্যাম কি তাকেও খুন করতেন? শ্যাম বলেন, হয়তো তাই-ই করতেন তিনি। বন্ধুর এই কথা মান্টোকে ভীষণ তাড়িত করে, চিরচেনা বম্বে ছেড়ে তিনি মনস্থির করেন পাকিস্তান চলে যাবেন! মান্টোর লাহোর-জীবন মোটেও সুখের ছিল না। ভাগ্নের বাসায় থাকতে হতো তাকে, তার মেধার যথোপযুক্ত সম্মানী দেওয়ার মতো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বা পত্রিকা গড়ে ওঠেনি তখনও। নতুন দেশে, নতুন শহরে দিশেহারা মান্টোর পানাসক্তি বেড়ে যায়, ধার-দেনা করে চলতে হয় তাকে। পাকিস্তানে যে ক’বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, সেই বছরগুলোতে লেখক হিসেবে তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া না হলেও তিনি সেসময় যেসব গল্প লিখেছেন, সেগুলোকেই তার সেরা সাহিত্যকৃতি হিসেবে ধরা হয়। সেসময় তার ধারালো কলমের খোঁচায় বেরোতে থাকে ‘ঠান্ডা গোশত’-এর মতো গল্প, যা তাকে টেনে নিয়ে যায় আইন আদালতের প্রাঙ্গণে। দেশভাগের পূর্বেই গল্পে অশ্লীলতা ছড়াবার দায়ে তিনবার তাকে অভিযুক্ত করা হয়। তিনি যখন পাকিস্তানে চলে যান, তখন তাকে একই অভিযোগে আরো তিনবার অভিযুক্ত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।
‘ঠাণ্ডা গোশত’ প্রকাশের পর লাহোর আদালতে মামলা দায়ের হয় মান্টোর বিরুদ্ধে- মান্টোর লেখা নাকি অশ্লীল! ওদিকে প্রগতিশীলেরা অভিযোগ তোলে- মান্টোর সাহিত্য নৈরাজ্যকামী, হতাশাবাদী। আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলছেন, ‘ঠাণ্ডা গোশত’ অশ্লীল নয়, তবে সাহিত্যের মানদন্ডে তাকে তলানিতেই রাখতে হয়! প্রত্যুত্তরে মান্টো সব পক্ষকেই বলছেন,
একজন লেখক তখনই কলম ধরেন, যখন তার সংবেদনশীলতা বা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। … লেখক একটা আয়নার মতো, যাতে সমকাল আর জীবন প্রতিফলিত হচ্ছে। যদি তা কুৎসিত হয়, তবে বুঝতে হবে ওই সময়টাই কুৎসিত।
‘ঠাণ্ডা গোশত’কে ঘিরে এই ‘কোর্টরুম ড্রামা’ সিনেমার অন্যতম আগ্রহোদ্দীপক অংশ!
পাকিস্তানে আসার পর অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে মান্টো অভ্যস্ত হয়ে পড়েন নিম্নমানের সুরাপানে। সুরা, সিগারেটের পাশাপাশি বাউন্ডুলে-বেপরোয়া জীবন তাকে উপহার দেয় লিভার-সিরোসিস। মাদকাসক্তি থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় মান্টোকে তৎকালীন ‘লাহোর মেন্টাল অ্যাসাইলাম’-এ নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দিয়ে শেষ হয় তার বায়োপিক।
মান্টোর সারাজীবনের সাহিত্যচর্চা ছিল বাস্তববাদী। তার সময়ের তথাকথিত প্রগতিশীল লেখক সংঘের ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতার সাহিত্যে তিনি আটকে থাকেননি। মান্টো যে গল্প লিখেছেন, তাতে কোনো তত্ত্ব-বিশ্লেষণ নেই, নেই কোনো উঁচু-ভারী দর্শনের বোঝা। দেশভাগের দাঙ্গায় যা ঘটেছে, কেবল তারই এক নিস্পৃহ ‘ফটোগ্রাফ’ যেন তার গল্প! মান্টোর এই স্পষ্টবাদিতা এবং স্পষ্টবাদিতাজাত স্বভাবসুলভ নির্দয় স্বভাব তাকে সারাজীবন প্রায় নিঃসঙ্গ রেখেছে। মান্টোর এই নিঃসঙ্গতা, তার উদভ্রান্তি, অনিশ্চয়তা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, এবং সূক্ষ্মতর অনুভূতিরাশি সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে দক্ষ অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির অভিনয়ে। বন্ধু শ্যামের রূঢ়ভাষণের পর মান্টোর গভীর শূন্যতা, আদালতে দাঁড়িয়ে ঋজু মেরুদণ্ডে আত্মপক্ষ সমর্থন, ফয়েজ আহমদের হীন সমালোচনায় মানসিকভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া, কিংবা লাহোর-জীবনে নিজেকে ব্যর্থ পিতা ও ব্যর্থ স্বামীর ভূমিকায় আবিষ্কার করার নিঃসীম যন্ত্রণা- এই সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে নওয়াজের চলন, বলন তথা সামগ্রিক অভিব্যক্তি চোখে লেগে থাকার মতো। ছবি দেখে মনে হয়, মান্টো চরিত্রে বোধহয় আর কাউকে মানাতো না!
প্রেমময়ী স্ত্রী, উৎসাহদাত্রী পাঠিকা, এবং দায়িত্বশীল মাতা হিসেবে তাকে উপযুক্ত সঙ্গত করেছেন ‘সাফিয়া’ চরিত্রে রসিকা দুগ্গল। পুরো ছবিতে সাফিয়া শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মান্টোর পাশে। এছাড়া মান্টোর ‘দোস্ত এবং দুশমন’ ইসমত চুগতাই-এর চরিত্রে রাজশ্রী দেশপাণ্ডে, সাহিত্যিক আহমদ নাদিম কসমির ভূমিকায় চন্দন রায় সান্যালসহ জাভেদ আখতার, দিব্যা দত্ত, রণবীর শোরের অভিনয় যথোপযুক্ত।
পৌনে দুই ঘণ্টায় মান্টোর জীবনের ঝঞ্ঝামুখর চার বছরকে ধরতে চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে নন্দিতা দাসের সাহসী এক কাজ। ‘ফ্যাক্ট ও ফিকশনে’র মিশেলে ছবির গল্প বলায় তাতে অভিনবত্বেরও পরিচয় মেলে। মান্টোর জীবনগাথার পরতে পরতে ‘দশ রুপিয়া, ‘টোবাটেক সিং’, ‘ঠাণ্ডা গোশত’, ‘খোল দো’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের চিত্রায়ণে তার ব্যক্তিজীবন আর গল্পের জীবন কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়; সাথে সাথে দর্শকের ‘ভিজুয়াল মনোটনি’ ভাঙতে সাহায্য করে, এবং মান্টোর সাহিত্যে নিমগ্ন হওয়ারও প্রণোদনা যোগায়। পরিচালকের দক্ষতার পাশাপাশি তারিফযোগ্য কার্তিক বিজয়-এর চিত্রগ্রহণ এবং রীতা ঘোষের প্রোডাকশন ডিজাইন। স্বাধীনতার ‘মেকি’ উদযাপন, দুই দেশের দাঙ্গা-পরবর্তী অবস্থা, পরদেশে যাত্রা, শরণার্থী শিবির, স্বজন-হারানো মানুষের হাহাকার, সর্বোপরি স্বাধীনতার আগে ও পরের প্রেক্ষাপট তারা ফুটিয়ে তুলেছেন মুনশিয়ানার সঙ্গে।
সবমিলিয়ে, নন্দিতা দাস পরিচালিত ‘মান্টো’ এক ‘চির উন্নত শির’ সাহিত্যিকের নির্ভীক সত্যদর্শনের চরিত্র ফুটিয়ে তোলে। ছবি শেষ করবার পর দর্শকের মনে হতেই পারে- অমন উন্নত-জটিল মননের আরও খানিক ঝলক যদি পাওয়া যেত…! কিন্তু সেই ‘যদি’র ইচ্ছাপূরণ হয় না। তারপরেও এই ছবি মনে দাগ কাটে, মনে করিয়ে দেয় মান্টোর লেখা প্রবন্ধ ‘কাফনের গলা’য় ব্যবহার করা মির্জা গালিবের লাইন,
ভেবো না আমি নিভে গেছি,
ভোরের সূর্যের মতো
প্রেমের দাগ আমার কাফনের গলায় অলংকার হয়ে আছে।