“সমস্যা কোথায়? এই চা দোকানকে যদি ঘর বানাতে পারো, তাহলে ওখানে তো তোমার দিব্যি কেটে যাবে! আসছে শীত, এখানে থাকলে কষ্ট করবে। সেখানে হিটিং সিস্টেম আছে, উষ্ণতার পাশাপাশি তিনবেলার খাবার নিয়েও ভাবতে হবে না। তোমার বয়স তো খুব একটা বেশি না। আর বের হলে তো মোটা অংকের টাকা পাচ্ছই। নিজে ব্যবসা করতে পারবে, চাও তো এরকম চায়ের দোকানও দিতে পারবে। তো, তুমি কী বল?”
একই রকমের কথোপকথন আমরা দেখেছিলাম সিনেমার শুরুতে। এবার বদলে গেছে স্থান-কাল। তবে বদলায়নি অংশগ্রহণকারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও পাওয়ার ডায়নামিকের ব্যবধান।
এখন পর্যন্ত নূরি বিলগে জেইলান নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৮। ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত থ্রি মাংকিজ তার ৫ম চলচ্চিত্র। কানের নয়নের মণি, সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী এই তুর্কি চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আন্তর্জাতিক সম্মান এনে দিয়েছে নিজের জন্মস্থান আনাতোলিয়ার পটভূমিতে নির্মিত সিনেমাসমূহ। তার চিন্তামগ্ন শৈল্পিকতায় ফুটে উঠেছে আনাতোলিয়া এবং সমকালীন তুর্কি জনমানুষের জীবনের দৈনন্দিন চিত্র। সুচিন্তিত, হৃদয়গ্রাহী এসকল সৃষ্টিকর্মের মূল অনুপ্রেরণা গল্পের চরিত্রদের আত্মানুসন্ধান, যা এসব সৃষ্টিকে দিয়েছে সার্বজনীনতা, জেইলানের চরিত্রদের সাথে নিজেদের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন পৃথিবীর অগণিত মানুষ।
এ বছর ৬৩-তে পা দেওয়া জেইলান সিনেমার পথে পা বাড়িয়েছেন খানিকটা বিলম্বে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর তিনি টান অনুভব করেন ফটোগ্রাফির প্রতি। পরবর্তীতে পেশা ফটোগ্রাফিই তাকে আগ্রহী করে তোলে সিনেমার প্রতি, এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে পড়তে আবার পা রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে। পাশ করার পর বানান কোজা (১৯৯৫), ২০ মিনিটের শর্টফিল্মটিতে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখি এক বয়স্ক দম্পতির সম্পর্ককে। এটিই প্রথম কোনো তুর্কি নির্মাণ, যেটি কানে গৃহীত হয়। দম্পতির চরিত্রে কোজায় দেখা গেছে জেইলানের মা-বাবাকে। পরের তিন সিনেমা দ্য স্মল টাউন (১৯৯৭), ক্লাউডস অভ মে (১৯৯৯) এবং ডিসট্যান্ট (২০০২); এগুলোকে ট্রিলজি বলে আখ্যা দেন অনেকে। এগুলোর বিষয়বস্তু তুরস্কের গ্রাম্যজীবন। এছাড়া শহর আর গ্রামের জীবনের ফারাকও ফুটে ওঠে ডিসট্যান্টে। এটি তাকে এনে দেয় কানের গ্র্যাঁ প্রিঁ, বিশ্বব্যাপী পরিচিত করিয়ে দেয় একজন অঁতর হিসেবে। কোজার মতো নিজের আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে অভিনয় করানোর ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছেন পরের চারটি মুভিতে।
২০০৬ সালের ক্লাইমেটসের আগপর্যন্ত নিজের সকল সিনেমায় সিনেম্যাটোগ্রাফির দায়িত্ব তিনি নিজেই সামলেছেন। ক্লাইমেটসে এসে এই দায়িত্ব স্থানান্তরিত হয় গোখান তিরিয়াকির উপর। তারপর থেকে সকল প্রজেক্টে তিরিয়াকিকে দেখা গেছে এ ভূমিকায়। সিনেম্যাটোগ্রাফি ছাড়লেও এখনও নিজের সকল প্রজেক্টের এডিটিং নিজেই সম্পন্ন করেন। জেইলানের মতে, যে কাজ ক্রিয়েটিভ প্রসেসের মতোই গুরুত্ববহ।
থ্রি মাংকিজ শুরু হয় মাঝরাত্তিরে, বৃষ্টিস্নাত এক গ্রাম্য রাস্তায়। ঘনীভূত আঁধারের কালো পর্দা ভেদ করে এগিয়ে চলেছে একটি গাড়ি। ক্লোজআপে দেখা যায় ড্রাইভিং হুইলের পেছনে বসা মধ্যবয়সী চালককে। ঘুমে তার চোখ ঢুলু ঢুলু, ক্লান্তিতে নেমে আসছে চোখের পাতা। চালকসহ গাড়িটি হারিয়ে যেতে থাকে আঁধারের চাদরে, ম্রিয়মান হয়ে আসে এর পেছনের লাইটের আলো। পর্দাজুড়ে নামে প্রগাঢ় অন্ধকার। কিন্তু আঁধার আর নৈঃশব্দ জেঁকে বসার পূর্বেই আমরা শুনতে পাই ব্রেক কষার কর্কশ আওয়াজ। পরের দৃশ্যে আবার দেখা যায় চালককে। গাড়ির পেছনে পড়ে আছে একটি লাশ। ঘুম উবে গেছে তার চোখ থেকে, এখন তার জায়গা দখল করেছে ভয় আর উৎকণ্ঠা।
ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানো লোকটির নাম সেভ্রেত (এরজান কেসাল), সে পেশায় একজন রাজনীতিবিদ। কিছুদিন বাদে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চলেছে সে। এমতাবস্থায় তার পথচারী হত্যার খবর চাউর হলে প্রতিপক্ষ আর মিডিয়া ধ্বংস করে দেবে এতদিনের ক্যারিয়ার। তাই সেভ্রেত শরণাপন্ন হয় নিজের ড্রাইভার আইয়ুপের (ইয়াভূজ বিনগোল)। আইয়ুপের সাথে সাক্ষাতে সে তাকে অনুরোধ করে পথচারী হত্যার দায় তার ঘাড়ে নিতে। যদি সে তাকে সহায়তা করে, তাহলে আইয়ুপের সাজা যেন কম হয়; সেদিকে সে নজর রাখবে। এখনকার মতোই মাসিক বেতন চলবে, সাজা শেষে মিলবে বড় অংকের পুরষ্কার। প্রস্তাবে রাজি হয়ে আইয়ুপ চলে যায় সাজা ভোগ করতে। পেছনে রেখে যায় নিজের স্ত্রী হাজের (হেতিজে আসলান) এবং পুত্র ইসমাঈলকে (আহমেত রিফাত)। এ ঘটনার পর চার চরিত্রের অদৃষ্টে কী লেখা আছে সেটা নিয়ে এগিয়েছে সিনেমার গল্প।
থ্রি মাংকিজের প্লট দিয়ে অনায়াসে টিভি ক্রাইম শোয়ের ৩০ মিনিটের একটি পর্ব বানিয়ে ফেলা সম্ভব। এ ধরনের প্লট নিয়ে আর্জেন্টাইন অ্যান্থোলজিক্যাল ফিল্ম ওয়াইল্ড টেলসে একটি গল্প রয়েছে। এর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক হলো চরিত্রসমূহ এবং মেলোড্রামা। প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব যুদ্ধ, টানাটানি আছে। তাদের এ ব্যক্তিগত জীবন হয়তো বাকি সবার দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেত। এ সকল বিষয় সামনে নিয়ে আসতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে গ্রাম্য রাস্তায় ঘটা সেই দুর্ঘটনা। মেলোড্রামাকে জেইলান বিবেচনা করেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে। তার ফিল্মে ঘুরে-ফিরে উপস্থাপিত হয়েছে এই থিম। এখানে সেটি স্থাপিত হয়েছে সিনেমার প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ এবং অনবদ্য নির্মাণকৌশলের মাধ্যমে।
বেশিরভাগ দৃশ্য গৃহীত হয়েছে আইয়ুপের ঘিঞ্জি, আঁটসাঁট ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে দেখা যায় বসফরাসের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেট না বানিয়ে বাস্তবে এমন একটি ফ্ল্যাট খুঁজে বের করেছেন জেইলান, যেটির এক্সটেরিয়র আর ইন্টেরিয়রের সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি আর তার ক্রু। এক্ষেত্রে সহধর্মিণী এব্রুর আর্ট ডিজাইন আর তিরিয়াকির বুদ্ধিদীপ্ত সিনেম্যাটোগ্রাফির রয়েছে বিশাল অবদান। পর্দায় দেখা গেছে মন খারাপ করে দেওয়া ফিকে হতে থাকা সবুজাভ বর্ণ, দুদিক থেকে চেপে আসা দেয়াল আর ছায়ার আধিক্য। যা দর্শকের মনে সৃষ্টি করেছে বন্দীত্বের আবহ। আইয়ুপ জেলে গিয়ে যেমন, তার পরিবারও এখানে থেকে ঠিক তেমনভাবেই বন্দী। বন্দীত্বের পেছনে রয়েছে নানা কারণ। যেমন: আর্থিক দৈন্য, শ্রেণিভেদ, কাজের অভাব, মানবজাতির প্রতিশোধ স্পৃহা, সমাজে টিকে থাকা এবং মানসিক সুস্থতা ধরে রাখার সংগ্রাম। মোট কথা, সমাজ ব্যবস্থাই তাদের আবদ্ধ করে রেখেছে শেকলে। তবে মাঝেমধ্যে বসফরাসের তাজা বাতাস আসে জানালা দিয়ে। এতসব যন্ত্রণার মাঝে দেয় একটু শ্বাস নেওয়ার ফুসরত।
জেইলানকে সিনেমায় গান খুব একটা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। তবে এ চলচ্চিত্রে মিজোঁ অন সিনকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ব্যবহার করেছেন সাউন্ডট্র্যাক। হাজেরের মোবাইলের রিংটোন হিসেবে ব্যবহৃত না পাওয়া ভালোবাসা বিষয়ক চটুল পপ গান এখানকার চরিত্রগুলোর অপ্রাপ্তির প্রতিনিধি। এছাড়া আগত ভয়াবহ পরিস্থিতির পূর্বাভাস দিতে গর্জনশীল ট্রেনের আওয়াজও ব্যবহার করেছেন তিনি। এসবের সাথে ছিল নিজের ট্রেডমার্ক এক্সটেন্ডেড ল্যান্ডস্কেপ শট, চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া এবং জীবনের দ্ব্যর্থতা বোঝাতে চরিত্রগুলোর পেছন দিক থেকে ধারণ করা দৃশ্যাবলী, প্রাকৃতিক শব্দ, এবং দর্শকের কাছ অনেক সময় পর্যন্ত গল্পে কী হচ্ছে সেই তথ্য প্রকাশ না করা। ক্ষণে ক্ষণে পর্দায় নেমে আসা অন্ধকার এখানকার চরিত্রগুলোর অসৎ, শোষণকামী মনোবৃত্তির পরিচায়ক।
ছবির নামের ক্ষেত্রে পরিচালক সাহায্য নিয়েছেন চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসের। তার পাপ সম্পর্কিত থ্রি মাংকিজ বিষয়ক উপদেশকে পুরোপুরি উল্টোভাবে প্রদর্শন করেছেন। এখানে তিন জ্ঞানী বাঁদরের খারাপ কিছু না দেখা, বলা বা করার ব্যাপারটি কোনো নৈতিক ধারণা নয়। বরং চরিত্ররা চায় এই ধারণাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে। আর স্বার্থান্বেষী সিস্টেম বা চরিত্রদের জন্য সুখকর কোনো বার্তাও তিনি দেননি। কারণ, ঘটনাপ্রবাহের সূত্রে আমরা আবারও দেখি শুরুতে দেখা মিটিংয়ের পুনরাবৃত্তি। আরো একজন মানুষের সামনে টোপ ফেলে তার নৈতিকতা দূষিত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়, করা হয় মনুষ্যত্বের অপমানের সকল আয়োজন। এটি কানে জেইলানকে এনে দিয়েছিল শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরষ্কার।