১৯৭১। বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের জন্য এক অগ্নিগর্ভ বছর। বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ন’মাসের মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য।
এরপর মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু সাহিত্যকর্ম। বহু সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই উত্তাল সময়—মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তেজনার বারুদ, সাধারণ জনতার দিশেহারা-সন্ত্রস্ত দিন, পাক-হানাদারদের নির্মমতা।
এই সাহিত্যিকদের মধ্যেও একজন বিশিষ্ট হয়েছেন তার সাহিত্যগুণে। তার রচিত বিশাল সাহিত্যভাণ্ডারের এক মহিমান্বিত অংশ দখল করে আছে মুক্তিযুদ্ধ। তা হবে না-ইবা কেন? নিজের বাবাকে যিনি শহীদ হতে দেখেছেন মিলিটারির হাতে, যুদ্ধের পুরো নয়মাস প্রাণ হাতে করে ভাই-বোন আর মাকে সাথে করে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে যিনি ছুটে বেড়িয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবেই বা ভুলবেন তিনি!
তাই তার হাতেই আমরা পেয়েছি নির্বাসন, অনীল বাগচীর একদিন, শ্রাবণ মেঘের দিন-এর মতো উপন্যাস। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাসাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক।
শ্যামল ছায়া উপন্যাসটিও হুমায়ূন আহমেদ রচিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত একটি উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালের মার্চে, হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রকাশক অন্যপ্রকাশ-এর মলাটে। এখানে লেখক সরাসরি যুদ্ধের ঘটনার কথা বলেননি; বলেছেন, যুদ্ধের বীর সেনানী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প; ফুটিয়ে তুলেছেন, তাদের অন্তরের কথা।
দেশে তখন ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থা। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। হানাদাররা আক্রমণ চালাচ্ছে ঘরে ঘরে। এদেশেরই এক দল মানুষ, রাজাকার-আলবদর নামে সহায়তা করছে তাদের। আর তারই সাথে সাহসী তেজী তরুণেরা দেশমাতৃকাকে রক্ষায় হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। তেমনই কয়েকজনের গল্প শ্যামল ছায়া।
ক্লান্তরাত্রিতে নৌকার পাটাতনে জেগে আছে চার জোড়া চোখ—হুমায়ূন, জাফর, আনিস আর মজিদ, সঙ্গে পথপ্রদর্শক মাঝি হাসান আলি। চরিত্র হিসেবে তিনি যে নামগুলো ব্যবহার করেছেন, সেগুলো তার সমসাময়িক সাহিত্যিক কিংবা তার বন্ধুস্থানীয়দের, এমনকি ব্যবহার করেছেন তার নিজের নামও।
যা-ই হোক, গল্পের এই চরিত্রগুলোর মিশন ছিল একটাই। কব্জা করতে হবে মেথিকান্দা ক্যাম্প, সেই অভেদ্য চক্রব্যূহ, যা দখল করতে ইতোপূর্বে ব্যর্থ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার দল, প্রাণ হারিয়েছে বহু বীর যোদ্ধা।
এসব কারণে ক্যাম্পটি পরিচিতি পেয়েছে হানাদার বাহিনীর দুর্গ, আর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুকূপ হিসেবে। তাদের নিজেদের বয়ানেই ঔপন্যাসিক শুনিয়েছেন যুদ্ধে যাওয়ার কাহিনী, আর সবশেষ চার পৃষ্ঠায় স্পষ্ট করেছেন এ দলটির চূড়ান্ত আক্রমণের শুরুর ইঙ্গিতটিকে।
উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র তাদের কথা বলছে। তাদের যুদ্ধে আসার কাহিনী, তাদের একত্রে অপারেশনের অভিজ্ঞতা আর আসন্ন অভিযানের কথা। একেকজনের বয়ানে ফুটে উঠেছে যুদ্ধকালের একেকটা বিশেষ দিক।
কীভাবে বহু মানুষ প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়েছে প্রাণ ভয়ে, পথেই মৃত্যু হয়ে সমাধিস্থ হয়েছে কত স্বপ্ন, কীভাবে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে তরুণ-যুবার সহজ স্বাভাবিক জীবন রূপ নিয়েছে দুর্ধর্ষ গেরিলার জীবনে, এসব ঘটনার হৃদয়গ্রাহী ভাষ্য পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে।
হাসান আলির কথা বিশেষভাবে বলার দাবি রাখে। তার আশ্রয়দাতার প্ররোচনায় দু’মুঠো ভাতের স্বপ্নে সে যোগ দিয়েছিল রাজাকার বাহিনীতে। সে দেখেছে, ন্যূনতম দয়া-মায়ার সিঞ্চন কারোর মধ্যে থাকলে সে রাজাকার হতে পারে না। অথচ বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত রাজাকার হিসেবে তাকেও থাকতে হয়েছে নরপিশাচদের দলে, দেখতে হয়েছে বহু লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর অমানবিক কর্মকাণ্ড।
যখনই সে দেখেছে এরকম অনাচার, যখনই দেখেছে পাকবাহিনীর হাতে তারই পরিচিতজনদের মৃতমুখ, তখনিই বিবেকের দংশনে নীল হয়েছে সে। আত্মগ্লানির নরক-অনলে দগ্ধ হয়ে সে ফিরেছে ন্যায়ের পথে, দেশের পথে। জীবনজিজ্ঞাসায় উত্তীর্ণ হয়ে তার মনে জেগেছে দেশপ্রেম আর মানবিকতার বোধ। এ প্রসঙ্গে লেখকের কুশলী বর্ণনা প্রণিধানযোগ্য-
চেয়ারম্যান সাব কইলেন, হাসান আলি রাজাকার হইয়া পড়। সত্তর টাকা মাইনা, তার উপর খোরাকী আর কাপড়।…তার কথা ফেলতে পারি না। রাজাকার হইলাম।… কামডা বোধ হয় ভুল হইল।… যখনই হিন্দুদের ঘরে আগুন দেয়া শুরু হলো, কেরামত ভাই কইলেন, এইটা কী কাণ্ড, কোনো দোষ নাই, কিচ্ছু নাই, ঘরে কেন আগুন দিমু?… ও তো হিন্দু হ্যায়, গাদ্দার হ্যায়। কেরামত বুক ফুলাইয়া কইলো, আগুন নেহি দেঙ্গা। তার লাশ নদীতে ভাইস্যা উঠল।… মিলিটারি যা কয় তাই করি। নিজের হাতে আগুন লাগাইলাম সতীশ পালের বাড়ি, কানু চক্রবর্তীর বাড়ি।… ইস্ মনে উঠলে কইলজাডা পুড়ায়। আমি একটা কুত্তার বাচ্চা।… সে রাতেই গেলাম মসজিদে। পাক কোরান হাতে নিয়া কিরা কাটলাম, এর শোধ তোলবাম। এর শোধ না তুললে আমার নাম হাসান আলি না। আমি বেজন্মা।
রাতের আঁধারের পর প্রত্যুষের মতোই ঠিক যেন মানবচরিত্রেরও সমান্তরাল দুই দিক— আলো আর অন্ধকার; সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করেই হাসান আলির আলোর পথে যাত্রা। হাসান আলি চরিত্রের ভেতর দিয়ে মানবিকতার এ অসাধারণ আখ্যানকাব্য বোধকরি হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই রচনা করা সম্ভব।
উপন্যাসটির আরেকটি তাৎপর্যমণ্ডিত দিক হলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবিশ্লেষণ। দেশের বহু তরুণ, হাতের কলম ফেলে দিয়ে যারা দেশের মাটি উদ্ধারের দীক্ষা নিয়েছিল, তাদের মনোপ্রবৃত্তি দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করেছেন ঔপন্যাসিক। রাজাকারদের শাস্তি দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনেও জেগেছে মায়া, আবার একই সাথে তারা প্রকাশ করেছে হৃদয়ের ঘৃণা— যে ঘৃণা ঐ রাজাকারদের প্রাপ্য বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, নিজের ভাতৃহত্যার জন্য।
মুক্তিযোদ্ধারা বহু কষ্ট সহ্য করে চলেছে তাদের অপারেশনে, কিন্তু তারা উপলব্ধি করেছে, জীবন থাকতে এ দেশমাতাকে শত্রুসেনার হাতে লাঞ্ছিত হতে দেবে না তারা।
দেশপ্রেমের এই মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনাই তো হুমায়ূন, জাফর আর মজিদদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে সম্মুখসমরে অংশ নিতে, হুমায়ূন আহমেদ যা ফুটিয়ে তুলেছেন অসামান্য দক্ষতায়। তারা যেন শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত কবিতারই বাস্তব রূপায়ণ-
….রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজি তরুণ, যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে—
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে,হে স্বাধীনতা।
(তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)
স্বাধীনতা আর মুক্তির জন্য এদেশের সাধারণ মানুষের উদ্বেলতার কথাও এসেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের যোদ্ধারা তাদের যাত্রাপথে যখনই দেখা পেয়েছেন সাধারণ বাঙালিদের, তখনই পেয়েছেন তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা। আনিস যখন পথ চলতে চলতে অসুস্থ হয়েছে, সাধারণ বাঙালিরাই আশ্রয় দিয়েছে তাকে, সেবা-শুশ্রূষা করেছে পরম আন্তরিকতায়।
বিচিত্র সব বিষয়ে অক্লান্তভাবে লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ, সাজিয়েছেন সৃজনশীলতার পসরা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরম যত্ন ও শ্রদ্ধার সাথে উঠে এসেছে তার সৃষ্টিকর্মে।
তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি গণমাধ্যমের গতানুগতিক ধারা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধকে সাহিত্যের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন একদমই সহজ-সরল, কৃত্রিমতাবর্জিত, সাদামাটা অথচ হৃদয়গ্রাহী আঙ্গিকে। শ্যামল ছায়া উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মাত্র ৪৮ পাতার এক উপন্যাসে এত বিচিত্র দিককে তুলে ধরার কঠিন কাজটি তিনি করেছেন অসাধারণ মুনশিয়ানায়। চিরায়ত ঢঙে এখানেও চরিত্রের মুখে সংলাপের নান্দনিক প্রয়োগ, ছোট ছোট বাক্য, সহজ ভাষা আর সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়েছে তার গল্পের কাহিনী।
উপন্যাসের চরিত্রগুলো কখনো কখনো হয়ত রসের উদ্রেক করেছে। তারপরেও মূর্ত হয়েছে একাত্তরের সংগ্রামী চেতনা- দুঃসহ দিনে যে চেতনা ঘৃণা আর প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সেই অন্ধকার দিনে অসংখ্য ছেলেকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল, যাদের না ছিল যুদ্ধের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা, না ছিল কোনো সহায়-সম্বল; কিন্তু ভালোবাসা ছিলো নিখাদ— দেশমাতার শ্যামল ছায়ার জন্য। সেজন্যই তো তাদের অপেক্ষা—
সেই মুহূর্তটির জন্য, যখন মনে হবে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাইফেলের ওপর ঝুঁকে থাকা একেকটি শরীর আবেগ ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকবে থরথর করে!
অনলাইনে কিনুন- শ্যামল ছায়া