পৃথিবীতে আসার জন্য প্রতিটি মানুষের জীবনেই একটি উদ্দেশ্য থাকে। সে উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারাটাই কি জীবনের সার্থকতা, না কি জীবনের আছে আরো বড় কোনো মানে? এ নিয়েই একের পরে এক কাহিনী সাজানো হয়েছে সোল (Soul) নামের অ্যানিমেশন সিনেমায়। সিনেমাটি যদিও তৈরি হয়েছে মার্কিন ঘরোনায় এবং তাদের সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে, কিন্তু এর বিভিন্ন পর্যায় জীবন নিয়ে যে ভুল ধারণাগুলো দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে, এর সবগুলোই হয়তো আপনি নিজের জীবনেই আবিষ্কার করতে পারবেন এবং সিনেমার একদম শেষে জীবন নিয়ে ধারণায় কিছুটা হলেও বদল আসবে। নিজেকে মনে হবে আরো অনেক বেশি খুশি মানুষ।
গল্পটা শুরু হয় এক পিয়ানিস্ট, জো গার্ডনারের জীবন নিয়ে। সারা জীবন জ্যাজ সঙ্গীতের প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করা জো গার্ডনার সবসময় চেয়েছে, ডর্থি উইলিয়ামসের সাথে তার জ্যাজ ক্লাবে কাজ করার। কিন্তু এখানেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার থেকে তার প্রতি প্রত্যাশার বিষয়টি। তার মা সব সময় চাইতেন, জো এমন একটা চাকরি করুক, যেখানে চাকরির নিরাপত্তা, মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স কিংবা পেনশনের মতো নিশ্চয়তাগুলো থাকবে। জো’র নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে গেলে ভালো ক্যারিয়ার পাওয়া যাবে না বলে ভাবতেন তার মা। সিনেমার এই জায়গাটি আমাদের অনেকের জীবনেই কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব ভালো বেতনের চাকরি বা সম্মানজনক অবস্থান ছাড়া চিন্তা করাটাই যেন এখন অন্যায়ের কাজ। তা-ও কেউ যদি নিজের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে একটা চাকরির কথা ভাবে, সেখানেও আসে সরকারি চাকরির মতো কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে অস্বাস্থ্যকর এক প্রতিযোগিতা। কেউ যদি লেখক কিংবা পর্যটক হতে চায়, আমাদের পরিবার বা সমাজে তার ইচ্ছের তেমন কোনো মূল্য নেই।
এমনটাই ঘটতে যায় জো-র জীবনেও। তবে মায়ের অনিচ্ছাসত্ত্বেও জো যখন ডোর্থির সাথে পারফর্ম করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই আসে গল্পের আসল মোড়।
মানুষ মৃত্যুর পরে কোথায় যায়? এ নিয়ে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকলেও এই মুভিতে দেখানো হয় এক ভিন্ন জগতের বর্ণনা। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় জো গার্ডনারের মৃত্যু হলে তাকে পাঠানো হয় মৃত্যুর পরের জীবন ‘দ্য গ্রেট বিয়ন্ড’-এ, কিন্তু জো তার পৃথিবীর জীবনে ফিরে যেতে চায়। কারণ, সে ভাবতে থাকে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ডোর্থির সাথে একই মঞ্চে পারফর্ম করা বাকি রেখে সে চলে যেতে পারে না। এরই ঘটনাক্রমে সে চলে আসে ‘দ্য গ্রেট আফটার লাইফ’ বা ইউসেমিনার নামক এক স্থানে। ‘ইউসেমিনার’ এমন এক জায়গা, যেখানে জন্মের আগে সকল আত্মাকে আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্বের শিক্ষা দেয়া হয় এবং পৃথিবী থেকে গত হওয়া সফল ব্যক্তির আত্মাকে এই নতুন আত্মাদের মেন্টর হিসেবে যুক্ত করা হয়। বলে রাখা ভালো, জো নিজের জীবনে খুব একটা সফল না হলেও ভুলক্রমে সে ইউসেমিনারে চলে আসে এবং সবাই তাকে মেন্টর মনে করতে থাকে।
ইউসেমিনারে জো-র উপর দায়িত্ব পড়ে, ‘সোল ২২’ নামক একটি আত্মাকে মেন্টরিং করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য উপযোগী করে তোলার। জোকে মূলত ‘সোল ২২’-এর জীবনের স্পার্ক খুঁজে বের করতে হবে। স্পার্ক হচ্ছে কোন কাজ একজন মানুষ খুব ভালো পারবে বা কোন কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে উন্নতি করতে পারবে, সেই বিষয়। ঠিক যেমন জো-র জন্য পিয়ানো বাজানোকে স্পার্ক বলা যেতে পারে, কিন্তু এটাই কিন্তু তার জীবনের উদ্দেশ্য নয়।
“স্পার্ক কোনো আত্মার উদ্দেশ্য নয়।”
মুভির এ পর্যায়ে দেখা যায়, প্রত্যেকের জীবনে একজন ভালো মেন্টর থাকার প্রয়োজনীয়তা কত বেশি। ‘সোল ২২’-এর জন্য আগে আব্রাহাম লিংকন, মাদার তেরেসা কিংবা মোঃ আলীর মতো বিরাট ব্যক্তিদের মেন্টর হিসেবে নিয়োগ করা হলেও তার জীবনের স্পার্ক খুঁজে পেতে তারা সাহায্য করতে পারেননি, যা কিনা জো গার্ডনার পেরেছে। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। কোনো ব্যক্তি তার নিজের জীবনে খুব সফল মানেই এই নয় যে, তিনি আমার জন্য অনুকরণীয় হবেন বা আমার জন্য ‘পারফেক্ট মেন্টর’ হবেন। আর, আমাদের প্রত্যেকের উচিত, নিজের জন্য এমন কাউকে মেন্টর হিসেবে গ্রহণ করা, যার চিন্তাধারার সাথে আমাদের নিজেদের জীবনের লক্ষ্যের সামঞ্জস্য রয়েছে।
‘সোল ২২’-এর জীবনের স্পার্ক খুঁজে পেতে একসময় জো এসে পৌঁছে এমন এক জগতে, যা ‘স্পেস বিটুইন ফিজিকাল অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল’ হিসেবে পরিচিত। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে যখন কেউ তার জীবনের কোনো একটি কাজে একনিষ্ঠভাবে নিমজ্জিত হলে, তবেই আসতে পারে। একে বলা হয়েছে ‘ইন দ্য জোন’। যখন একজন অভিনেতা তার অভিনয়ের ভেতরে হারিয়ে যায় কিংবা একজন গায়ক তার গানের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়, তখন তারা এমন জায়গায় পৌঁছে। আরেক ধরনের মানুষও এখানে পৌঁছাতে পারে, মুভিতে তাদের বলা হয়েছে ‘লস্ট সোল’ বা হারিয়ে যাওয়া আত্মা।
“হারিয়ে যাওয়া আত্মারা এ স্থানের অন্য আত্মাদের থেকে খুব একটা আলাদা নয়। এই স্থান উপভোগ্য, তবে এই আনন্দ বা উপভোগ্যতা যখন আচ্ছন্নতায় রূপ নেয়, তখন তা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।”
মুভির এ সংলাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, কখনোই নিজের দুশ্চিন্তাগুলোকে বড় হতে দেওয়া যাবে না। কিছু নিয়ে খুব বেশি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে তা আমাদের জীবন থেকেই একসময় বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। বর্তমান প্রজন্মের জন্য এই ভাবনা খুবই জরুরি। কেননা, আমরা অনেকক্ষেত্রেই খুব ছোটখাট বিষয়কে এত বড় করে দেখি যে নিজেদেরকে জীবনের ছন্দ উপভোগ করতে না দিয়ে নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলি, যা কখনোই উচিত নয়।
একটা সময় জো আর ‘সোল ২২’, দুজনই পৃথিবীতে চলে আসে আর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। জো তার পরিচিত একজন নাপিতকে নতুন রূপে দেখে, যার জীবনের লক্ষ্যই ছিল ভেটেরান হওয়ার, কিন্তু তারপরেও বর্তমানের কাজ নিয়েও সে যথেষ্টই খুশি। এবং এমনকি ডোর্থি উইলিয়ামের সাথে পারফর্ম করার পরেও জো-র মনে হতে থাকে, তার জীবনের এটাই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তারপরও তার কেন মনে হচ্ছে- কী যেন নেই? আর পৃথিবীতে আসার আগে পুরোপুরি একঘেয়ে লাগা পৃথিবীকেই ‘সোল ২২’-এর ভালো লাগতে শুরু করে। এখানেই রয়েছে মুভির আসল বার্তাটি। মানুষের জীবনের স্পার্ক যা-ই হোক না কেন, তার জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে যেকোনো কিছু। ‘সোল ২২’ এর ভাষায়,
“হয়তো আকাশ দেখা বা হেঁটে বেড়ানো আমার স্পার্ক হতে পারে। আমি খুব ভালো হাঁটতে পারি!”
সত্যিই কত সুন্দর ভাবনা। হাকুনা মাতাতা, যার মানে দাঁড়ায়, জীবনকে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করাই হোক আমাদের মূল উদ্দেশ্য। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়েই তো জীবন। জীবনে যখন একটা কিছু না পাওয়া হয়, তার মানে এই নয় যে, এখানেই সব শেষ। বরং এর মানে হচ্ছে, আরো বড় সুযোগ অপেক্ষা করছে, যা জীবনকে করে তুলবে আরো পরিপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর। তাইতো মুভির শেষে জো গার্ডনার বলেছিল,
“আমি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচব।”
২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া সোল মুভিটির আইএমডিবি রেটিং ৮.১। পারিবারিক কমেডি ঘরানার এই মুভিটির পুরো ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট জুড়েই রয়েছে জীবন নিয়ে বহু সুন্দর ভাবনার সমাহার। পিট ডক্টর এবং কেম্প পাওয়ার্সের পরিচালনায় নির্মিত অ্যানিমেশনটি মুক্তির এক বছরের মধ্যেই ছিনিয়ে নিয়েছে দুটি অস্কারসহ আরো বেশ কিছু সম্মাননা।