ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটানোর সময় হুমায়ূন আহমেদ হারুকি মুরাকামির বই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষদিকে লেখা তার আত্মজৈবনিক বই “নিউইয়র্কের নীল অাকাশে ঝকঝকে রোদ” এ সেই আগ্রহের নমুনা ও প্রশংসা স্পষ্ট। কারণ তিনি নিজেই লিখে গেছেন। মুরাকামির কাজের সাথে তার কাজের যে বড্ড মিল। এমনকি তিনি মুরাকামির গল্পের প্লট ব্যবহার করে নিজের মতো একটি গল্পও বলে গেছেন।
মুরাকামিকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের এমন সোজাসাপ্টা প্রশংসা কিছুটা অবাক করা। কারণ একজন লেখকের প্রতি এমন আগ্রহ এতটা খোলাখুলিভাবে আগে কখনও তিনি প্রকাশ করেননি। কিন্তু কে এই হারুকি মুরাকামি?
হারুকি মুরাকামি একজন জাপানি লেখক, যার জন্ম জাপানের কিয়টো শহরে। যদিও তার বেড়ে ওঠা কোবে শহরে। ষাটের দশকের শেষদিকে টোকিওতে ছাত্রজীবন কাটানোর ফলে তার মধ্যে আধুনিক সাহিত্যের প্রতি ভাল লাগা তৈরি হয়। তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন এবং প্রথম উপন্যাস প্রকাশের আগপর্যন্ত স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর টোকিতে একটি ক্যাফে চালান। তার ক্লাবে একদিন তিনি কাজ করছিলেন ও বেসবল খেলা দেখছিলেন। এসবের মাঝেই তার মাথায় একটি গল্প চলে আসে। বাসায় গিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন ‘নরওয়েজিয়ান উড’। এই বই তাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। জাপানে নাকি এমন কেউ নেই যে এই বই পড়েনি।
প্রত্যেক লেখকের গল্প বলার নিজস্ব ঢং থাকে। তারা সচরাচর সেই বৃত্তের বাইরে যাননা। হারুকি মুরাকামির সকল লেখাই সমকালীন সাহিত্য, জীবনমুখী ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। তার উপন্যসের চরিত্রগুলো সবসময় থাকে বিষাদময়। আর সেই বিষাদময় চরিত্রকে মুরাকামি তার লেখনীর মাধ্যমে চোখের সামনে যেন সিনেমার পর্দায় তুলে ধরেন। সাধারণ কোনো ঘটনাকে অসাধারণভাবে বলার দক্ষতা সবার থাকে না। যাদের থাকে তাদের এ ক্ষমতা একদম ঈশ্বর প্রদত্ত। মুরাকামির লেখা এমনই। একটা ঘটনা খুব বিস্তারিতভাবে বলতে পছন্দ করেন। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি খুব আগ্রহের সাথে বলেন। যেন মনে হয়, লেখক ঘটনাকে নিজের চোখে দেখে লিখছেন ও পাঠক পড়ার পাশাপাশি লেখকের চোখের সাহায্যেই ঘটনাকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছে।
নরওয়েজিয়ান উড এ ফিরে আসা যাক। এ উপন্যাসের পটভূমি ষাটের দশকের শেষের দিকের টোকিও। ষাটের দশকের শেষের দিকে মুরাকামি তার ছাত্রজীবন পার করেছিলেন। তিনি বলেননি এ উপন্যাসের সাথে তিনি বা তার পরিচিত কেউ জড়িত কি না। তবে এসব বলার দরকার হয়নি। কারণ মুরাকামি তার বর্ণনা দক্ষতার মাধ্যমে গল্পকে বইয়ের পাতাতেই জীবন্ত করে দিয়েছেন।
নরওয়েজিয়ান উড উপন্যাসের নায়ক তরু ওয়াতানাবে। সাদাসিধে এক ছেলে। প্রিয় বন্ধু কিজুকির মুত্যুতে তার জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। সবকিছু ভুলে গিয়ে, সব স্মৃতিকে পেছনে ফেলে ওয়াতানাবে পাড়ি জমায় দূরের এক শহরে পড়াশোনা করতে। হোস্টেলের ডর্মে নতুন জীবনের সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করে সে। কিন্তু ওয়াতানাবে একাকী জীবনে হাজির হয় নাওকো নামের এক মেয়ে, যে কি না তার মৃত বন্ধুর প্রেমিকা। অদ্ভুত এক সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তারা, ব্যাখ্যাতীত একটি সম্পর্ক।
এর মাঝে তরুর জীবনে হাজির হয় আরও এক নতুন মেয়ে। মিদোরি, তার সহপাঠী। স্বাধীনচেতা ও খোলামেলা স্বভাবের মেয়ে মিদোরি তরুর জীবনে ভিন্নতা নিয়ে আসে। তাকে আকঁড়ে ধরে তরু জীবনের নতুন স্বাদ খুঁজে পায়। কিন্তু সে স্থির হতে পারে না। মানসিকভাবে অসুস্থ নাওকো, নাকি স্বাধীনচেতা মেয়ে মিদোরি। কাকে বেছে নেবে সে?
নরওয়েজিয়ান উড বইয়ের তিনটি চরিত্রই বাস্তব জীবনের গল্প বলে। তিনটি চরিত্রই বিষাদময়, সমস্যায় জর্জরিত। হারুকি মুরাকামি গল্প শুরু করেছেন তার স্বভাবচরিত্র বর্ণনা দিয়েই। তরুর জীবনকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। পৃষ্ঠা উল্টানোর পাশাপাশি আপনার মনে হতেই পারে, এ তরু আপনার খুব কাছের, খুবই পরিচিত। এমনকি তার হোস্টেল, তার রুমও আপনার খুব পরিচিত। নাওকোর সাথে আপনি সময় কাটিয়ে এসেছে, মিদোরির সাথেও আপনার পরিচয় আছে। উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘোর লাগার পাশাপাশি অসীম মুগ্ধতায় যদি আপনার এমনটা মনে হতে থাকে, তবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
হুমায়ূন আহমেদের প্রায় বইগুলোতে আবেগের একটা ব্যাপার থাকে। তার কোনো না কোনো চরিত্র ফুটে ওঠে আবেগের মিশ্রণে। গল্প এগোয় খুবই স্পষ্ট ও সাবলীলভাবে, বর্ণনার সাথে। আর গল্পের শেষাংশে একধরনের হাহাকার অনুভূত হয়। মুরাকামির সাথে কেন হুমায়ূন আহমেদ নিজের মিল পেয়েছিলেন তা এখানে পরিষ্কার।
হারুকি মুরাকামির প্রত্যেক উপন্যাসে আছে বিষাদের ছোঁয়া। তার চরিত্রগুলো সবসময় থাকে বিষাদগ্রস্থ। সেসব চরিত্রকে সাথে নিয়ে তিনি খুবই ধীরে ধীরে গল্পে প্রবেশ করেন। চরিত্র, পটভূমি সবকিছু ব্যাখা করে যখন তিনি সমাপ্তি টানেন, ঘোর লাগা একধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেন ঘটনার বাস্তববাদী জীবনের নমুনা নিজের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
মুরাকামির আরও একটি অদ্ভুত সুন্দর উপন্যাসের নাম আফটার ডার্ক। ২৪ ঘন্টার অন্যতম রহস্যময় সময়কে নিয়ে গল্প বলেছেন তিনি। আফটার ডার্কের গল্প রাতের। যেখানে বাস্তব ও পরাবাস্তব দুই আবহ উপস্থিত। আফটার ডার্কের গল্প শুরু হয় মারি নামক এক তরুণীর সাথে। রাতের একটি রেস্টুরেন্টে সে উদাসভাবে একটি বই নিয়ে বসে আছে। হুট করে তাকাহাশি নামক একটি ছেলে চলে আসে তার কাছে। কথাবার্তা হয় সামান্য। সমস্ত কথোপকথন হয় তার বোনকে নিয়ে।
মারি থেকে গল্প চলে যায় হোটেল অ্যালফাভিলে। যেখানে গোপন আনন্দ খুঁজতে আসে নানা ধরনের মানুষ। এখানেই কাওরু নামক এক তরুণীকে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। তার সাহায্য লাগবে মারির। কাওরু থেকে এরি আসাই তারপর শিরাকাওয়া গল্পের লাটাই সবার কাছেই ঘুরে ঘুরে যায়। ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন সব গল্প, কিন্তু একই সুতায় গাঁথা। রাতের নিকষ কালো আঁধারে ঘটা এসব ঘটনা দেখে চলছে ‘আমরা’ পরিচয়ে অদ্ভুত এক সত্ত্বা। যাকে শুধু ঘটনাকে দুই চোখ দিয়ে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, ঘটনার ভেতর ঢুকে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তার।
আফটার ডার্কে প্রত্যেক চরিত্র তাদের নিজদের গল্প বলে। যেসব গল্প জীবন্ত হয় রাত শুরুর পর। তাদের কেউ বিষাদময় জীবন পার করছে, কেউ লড়ছে তার মনের সাথে, কেউ হয়তো সুখী হয়েও সুখী হতে পারছে না। মানবিক জীবনের এ সকল গল্পে মুরাকামি একটি দিকেই নিয়ে গেছেন, তা হলো ভালোবাসা।
কেমন হয় একজন পুরুষের নারীবিহীন জীবন? অনেকেই তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেন। তারপর চাইলেই কি তাকে ভুলে থাকা সম্ভব হয়?একজন একাকী ছেলে, নিজের জীবন নিয়ে ডুবে থাকে, সে কি পারে না প্রেমে পড়তে? অথবা নারীদের আজীবন ঘৃণা করে চলা পুরুষটি যদি হুট করে কোনো নারীর প্রেমে পড়ে যায়?
এ প্রশ্নগুলো হারুকি মুরাকামি তুলে ধরেছেন তার মেন উইদআউট উইমেন বইতে ৭টি ছোট গল্পের ভেতর দিয়ে। মুরাকামির ছোট গল্পগুলো তার উপন্যাসের মতো হয় না। তিনি কখনই তার ছোট গল্পের সোজাসাপ্টা সমাপ্তি করেননি। সবসময় পাঠকদের সমাপ্তি ভেবে নেবার সুযোগ করে দেন। যেন গল্পটি তার, কিন্তু পাঠক গল্পটি তার নিজের মতো করে গ্রহণ করবে। ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐ কথার মতকই “শেষ হয়েও হইলো না শেষ।”
কাফকা অন দ্য শোর মুরাকামির বাস্তব ও অবাস্তব দুনিয়ার মাঝে লেখা আরও একটি বই। মুরাকামির লেখার সকল ভঙ্গিমা এখানে উপস্থিত। তিনি এখানে প্যারালাল জগতের কথা বলেছেন, তার মতো দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন, পাঠকদের উপর গল্পের সমাপ্তি ছেড়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ এই বইয়ের বিষয়বস্তু বেশ জটিল। কোনো পাঠক যদি একটি মাত্র বই দিয়ে মুরাকামিকে বিচার করতে চান, এটি সেই বই।
গল্পের প্রধান চরিত্র ৪টি। কাফকা, যার ঘাড়ে আছে অবাস্তব এক অভিশাপ। সে অভিশাপ বাস্তবেও ঘটতে পারে আবার স্বপ্নেও। বাস্তবে হয়তো কাফকা ঘুরে দাঁড়াবে, কিন্তু স্বপ্নে? তবে সে কি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবে? নাকাতা, যিনি কিছু পড়তে পারেন না, তবে বিড়ালের সাথে কথা বলতে পারেন। আরও একটি চরিত্র ওশিমা। তার শরীর নারীর মতো, কিন্তু দেখতে একজন ছেলের আর মন একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের। এবং প্রত্যেকটা চরিত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের নিজেদের দোষে, নিজেদের ভাগ্যকে বরণ করে নিতে।
হারুকি মুরাকামি সামান্য ছোটগল্পকেও বৃহৎ পরিসরে লিখে থাকেন। আর কাফকা অন দ্য শো’র পরিসরই বৃহৎ, যা মুরাকামির লেখনীতে হয়ে উঠেছে অকল্পনীয় এক সৃষ্টি। জটিলভাবে গল্প না বললেও গল্পের বিষয়বস্তু জটিল হবার কারণে এই বই বিশ্লেষণ করা অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার।
একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, নীরবতা, ভালোবাসা, মানুষের বাস্তবিক জীবনের গল্পের কথা মুরাকামির লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে। এসব বিষয়কে পাশে রেখে মুরাকামি বাস্তব ও কল্পনাকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। তিনি এমন এক জঁনরা নিয়ে লেখালিখি করেন যে জঁনরার লেখক বর্তমানে হাতে গোনা। মানুষের জীবনের গল্প বা একটি মানুষের বেঁচে থাকা জীবনকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটা বইতে তা মুগ্ধতাকেও ছাড়িয়ে যায়।
হিয়ার দ্য উইন্ডো বইতে মুরাকামি একটি কথা বলেছিলেন, “যখনই আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই, সবসময় তখন আমার কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন আমি কারও সাথে কথা বলি, তখন আমার ইচ্ছা করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি এরকমই অদ্ভুত একজন মানুষ।” বাস্তব ও পরাবাস্তব নিয়ে প্যাঁচ লাগানো নিয়মতান্ত্রিক লেখকের জীবন কি আসলেই এমন অদ্ভুত?
ফিচার ইমেজ: Successstory.com