হুমায়ুন আজাদের বয়ানে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংকট

প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। সাহিত্যের সাথে সংযুক্ত থেকে ১৩টি উপন্যাস ও ১০টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অ্যাকাডেমিক দক্ষতা চিহ্নস্বরূপ ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক রচনাও তিনি লিখেছিলেন। এসব ফিকশন ও গবেষণামূলক রচনা সাধারণ পাঠক এবং ভাষাবিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত মানুষজনের কাছে তাকে নিয়ে গেছে প্রবাদপ্রতীম উচ্চতায়।

কিন্তু তার লেখা নতুন মাত্রা পেয়েছে তার প্রবন্ধগুলোতে, সেটি তার কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ হওয়া বই নারীই হোক, কিংবা সিমন দ্য বুভোয়া’র দ্য সেকেন্ড সেক্স এর অনুবাদ হিসাবে দ্বিতীয় লিঙ্গ প্রসঙ্গেই হোক বা সমসাময়িক বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা তার ২২টি বিশ্লেষণধর্মী বইয়ের ক্ষেত্রেই হোক, সমানভাবে প্রযোজ্য।

হুমায়ুন আজাদ মারা যান ২০০৪ সালে। ফেব্রুয়ারি মাসে মহান একুশে বইমেলা থেকে বের হবার পরপরই তিনি রক্তাক্ত হয়েছিলেন মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের চাপাতির আঘাতে। জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসাও তাকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়, কারণ সেখানে তিনি আবারও সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক আক্রমণের শিকার হন।

হুমায়ুন আজাদ; Image Source: banglanews24

এ দেশের বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা অর্থনৈতিক অসঙ্গতি তার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছিল, এবং সেসব ইস্যু নিয়ে চিরাচরিত প্রধাবিরোধী ঢঙে তিনি তার ভাবনা ক্রমাগত লিখে প্রকাশ করে গেছেন। সেরকমই একটি বিষয় হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম।

রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি নিয়ে গঠিত, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ স্থান সম্বলিত এই অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধারে তিনি মাত্র একবারই গিয়েছেন (এই বই লেখার আগে)। সেটি ছিল রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে, ১৯৯৭ সালের জুন মাসে। সেই অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ নিয়েই এই বই।

বই আকারে প্রকাশের আগে এটি বাংলাবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ৪ সংখ্যায় বের হয়, জুলাই ১৯৯৭ তে। তবে এসবের প্রায় আট বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে ‘সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’ পত্রিকায় তার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রথম কোনো লেখা ছাপা হয় ‘রক্তাক্ত বিপন্ন পাহাড়’ শিরোনামে। এই লেখাটিও সংকলিত হয়েছে এখানে। যদিও সেই লেখাটি ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘নিবিড় নীলিমা’ গ্রন্থে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ঠাঁই পেয়েছে এখানেও।

এই দুটো রচনা ছাড়াও এই বইতে সংযুক্ত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একনজরে জানার জন্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: তথ্য’ শিরোনামে একটি অধ্যায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বিবর্তন জানার জন্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: কালপঞ্জি’ নামক একটি ক্রনোলজি। হুমায়ুন আজাদ এক দশকের ব্যবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট বিষয়ে স্পষ্টভাবে তার মতো পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন এই বইয়ের ভেতরে।

মূল প্রচ্ছদ; Image Source: Wikimedia Commons

বইয়ের শুরুতে, ভূমিকার বদলে ‘অসুস্থ আহত সুন্দর’ শিরোনামের উপক্রমনিকাতে তিনি লিখছেন,

“বাংলাদেশের এক রূপময় খণ্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম, তিন দশক ধ’রে অসুস্থ আহত। কী হচ্ছে সেখানে বাঙালি তা ভাল ক’রে জানে না, তাদের জানারও আগ্রহ কম; এবং সরকারগুলোও, এক সময়, পালন করতো সন্দেহজনক নীরবতা। অস্পষ্টভাবে জানতাম আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা চান স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন; এবং তারা বিদ্রোহ করেছেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অধিকাংশ বাঙালির মতো আমিও জানতাম সামান্যই; তবে এক দশক আগে তাদের পক্ষে লিখেছিলাম একটি আবেগকাতর রচনা; এবং অনেক অনামা পাহাড়ি পত্রলেখক আমাকে তাদের স্বপ্নের জুম্মল্যান্ডের নাগরিকত্বও দিয়েছিলেন।”

লেখক বলছেন, সরেজমিনে ঘুরে এসে এবং দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এবং সেই নতুন মতই তিনি বিশ্লেষণ করেছেন পুরো বই জুড়ে।

ক্ষীণ কলেবরের এই বইটির গুরুত্বের বিশালতা প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে। বাংলাদেশের সবথেকে প্রথাবিরোধী লেখকের, দেশের সবথেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সংগ্রামের বিষয়ে লেখা পুস্তিকা নিঃসন্দেহে আরো মনোযোগ দাবি করে।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস টেনেছেন বারবার। ১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, এটি পাহাড়িদের খুব প্রিয়। সেই সাথে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমারা তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনী মারফত যেসব দাবি বঙ্গবন্ধু বা পরবর্তী শাসকদের কাছে উত্থাপন করে আলোচনা করেছেন, তার মূল সুর এই ম্যানুয়েল।

হুমায়ুন আজাদ এখন বলছেন, এসব দাবি পূরণ হবার নয়, জুম্মল্যান্ডের দাবি আসলে অবাস্তব।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির সেই ঐতিহাসিক দিনটি; Image Source: The Daily Ittefaq

প্রীতিকুমার চাকমা, পাহাড়ি  ছাত্র পরিষদ, হিল উইম্যানস ফেডারেশন, জিয়াউর রহমান, এরশাদ এবং বিশেষভাবে সেনাবাহিনী এবং ভারতের ভূমিকা বারংবার বর্ণিত হয়েছে। রাজনীতি, সেনাবাহিনী, শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহ এবং সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে তিনি বলছেন,

“এ জাতীয় বিদ্রোহে সেনাবাহিনী হয় খলনায়ক, শক্তিমান মাত্রই খলনায়ক; আর বিদ্রোহীরা পায় সহানুভূতি, যদিও নৃশংসতায় তারাও অতুলনীয়। শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতেছে সেনাবাহিনী এবং হেরেছে প্রচারে।”

তাহলে সমাধান কী? সমাধানও বাতলেছেন তিনি। তার মতে,

“বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সমগ্র জনগণের মতোই পাহাড়ি জনগণকে আধুনিক গণতান্ত্রিক অধিকারসম্পন্ন স্বচ্ছল শিক্ষিত মানুষে পরিণত করা; এবং তাদের দ্রুত সার্বিক উন্নতি সাধন। তাদের আদিম সামন্ত সমাজ কাঠামোর মধ্যে সাধারণ মানুষের কোনো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেই; তাই ঐ সামন্ত সমাজকাঠামো ভাঙা দরকার।”

মনে রাখা দরকার, এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদনের আগে। এই রচনার পরে শান্তিচুক্তি হয়েছে, শান্তিবাহিনী অস্ত্র জমা দিয়েছে, কিন্তু পাহাড়িরা এখনো নিয়মিত দাবী করে যাচ্ছে যে, শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি।

যদিও আমরা এমনকি সাদা চোখেই দেখতে পাচ্ছি অবকাঠামোগত উন্নয়নের মহাযজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছে এই তিন পার্বত্য জেলায়, তবুও পরিপূর্ণ শান্তি আসছে না কেন? এর উত্তর হুমায়ুন আজাদ দিয়েছেন এই বইয়ের উৎসর্গপত্রে। তিনি লিখেছেন,

উৎসর্গ: পাহাড়ি মানুষদের-উপজাতীয় ও বাঙালির হাতে, যারা শুধু হৃদয়ের চুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারে শান্তি, যা পারবে না রাজনীতিকেরা, সেনাপতিরা, বিদ্রোহীরা।

বইয়ের নাম: পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা  ||  লেখক: হুমায়ুন আজাদ

প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী  ||  অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম

Related Articles

Exit mobile version