মাঝে মাঝে আমার খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে। তখন কাগজ কলম নিয়ে বসি এবং খুব আয়োজন করে কবিতার একটা নাম ঠিক করি। ব্যাস এই পর্যন্তই! কবিতার শিরোনাম লেখা হয় কিন্তু কবিতা আর লেখা হয় না। বুদ্ধিমান পাঠক আশা করি এর মধ্যেই ধরে ফেলেছেন যে ‘তেতুল বনে জোছনা’ আসলে আমার একটা কবিতার নাম। যে কবিতা লেখা হয়নি এবং কখনো লেখা হবে না। কেউ যদি প্রশ্ন করেন –“এই নামের অর্থ কি? তেতুল বনে জোছনা কি আলাদা কিছু?” তাহলে আমি বিপদে পড়ে যাব। আসলেইতো এর কোনো অর্থ কি আছে? প্রশ্নটাকে এখন আরেকটু ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে – চাঁদের আলোর অর্থ কি? বর্ষার মেঘমালার অর্থ কি? যে অনন্ত নক্ষত্রবীথি আমাদের ঘিরে রেখেছে তার অর্থ কি? আচ্ছা আমরা কি অর্থহীন একটা জগতে বাস করে জীবনে অর্থ অনুসন্ধান করছি না? কেন করছি?
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার জনপ্রিয় উপন্যাস ‘তেতুল বনে জোছনা’র নামকরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ কথাগুলো বলেছিলেন। ব্যাখ্যাটি একদম যথার্থ ছিল কারণ উপন্যাসের কোনো পর্যায়েই তেতুল বনে জোছনা পোহানোর কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না, বরং শ্মশানঘাটে জোছনা পোহাতে দেখা গেছে।
২০০১ সালে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিরাটনগর গ্রাম, সেখানকার চেয়ারম্যান জহির খাঁ তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখতে বদ্ধ পরিকর। তাই নব্যধনী আজিজ মিয়ার উত্থানও তাকে ভাবিয়ে তোলে। এমনই এক সময়ে গ্রামের ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আসে, নিজের প্রতিপত্তি জাহির করতে গিয়ে সবকিছু ঠিকভাবে না বিবেচনা করেই কঠোর শাস্তি দিয়ে বসেন জহির খাঁ। এই শাস্তিকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি অনেক বেশি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
ওই গ্রামেরই কম্যুনিটি হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার আনিস, নিজের সুমিষ্ট ব্যবহার ও সুনিপুণ চিকিৎসার কারণে খুব অল্প সময়েই সে গ্রামের সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জহির খাঁ নিজেও আনিসকে পছন্দ করতেন আর সেকারণে নিজের বিভিন্ন সমস্যার কথা আনিসকে বলতেন। তবে আনিস নিজেই একটি জটিল সমস্যায় আটকে ছিল। তার স্ত্রী ধনাড্য পরিবারের মেয়ে নবনী, ভার্সিটিতে পড়ুয়া ২২ বছর বয়সের এই তরুণী বিয়ের পরেও বাবার বাড়িতেই থাকে।
আকস্মিক এক ঘটনার মাধ্যমে তাদের দুজনের বিয়ে, বিয়ের আগে কেউ কাউকে সেভাবে চিনতোও না। বিয়ের পরেও দুজন দু’প্রান্তে থাকায় সম্পর্কের রসায়ন সেভাবে গড়ে উঠছিল না। একসময়ে নবনী আবিষ্কার করে যে এই বিয়ের কারণে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, প্রতিরাতে অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখছে। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সে আনিসের সাথে দেখা করতে বিরাটনগর আসে। সব কথা শুনে স্বল্পভাষী আনিস নবনীকে আরেকটু ভাবতে বলে। কিন্তু নবনী এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। কী সেই কঠিন সিদ্ধান্ত? সত্যিই কি আনিস আর নবনীর মাঝে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে? নাকি শেষ মুহূর্তে নাটকীয় কিছু ঘটবে?
আনিস-নবনীর মধ্যকার এই সম্পর্কের টানাপোড়েন সাথে বিরাটনগরের ভিলেজ পলিটিক্স – এই নিয়ে পুরো উপন্যাসের গল্প এগিয়ে গেছে। ১৩৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে ছোট-বড় অনেকগুলো চরিত্রের আগমন ঘটেছে, তবে গল্পের মূল চাকা ঘুরেছে মূলত চারটি চরিত্রের মাধ্যমে।
আনিস
আনিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার মা বলেছিলেন, “পৃথিবী উত্তর-দক্ষিণে চাপা। আর আমার ছেলেটা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই চাপা।” প্রচণ্ড অন্তর্মূখী একজন মানুষ আনিস যে তার অনুভূতির পুরোটা নিজের কাছেই আবদ্ধ রাখে। নিজের ভালোবাসা কিংবা খারাপ লাগা – কোনোটাই সে অন্যের সামনে প্রকাশ করে না। নবনীর সাথে তার সম্পর্কে যে জটিলতা তৈরি হয়, তার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তার এই অন্তর্মুখিতা।
স্বভাবে চুপচাপ এই মানুষটি কর্তব্যের বেলায় সদা সচেতন ছিল, আর এ কারণেই জ্বরে কাহিল নবনীকে ফেলে সে অসুস্থ জহির খাঁকে দেখতে গিয়েছিল। ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারলেও মানুষকে সবটুকু উজাড় করে ভালোবেসে গেছে সে, আর তাই তো নবনীর কঠিন আচরণের পরেও স্ত্রীর বিদায়বেলায় তার দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেছিল। কোনো ধরনের ঝামেলায় না জড়িয়ে কঠিন সব সমস্যাও সে বেশ দক্ষতার সাথে সমাধান করে গেছে।
নবনী
উপন্যাসের নায়িকা নবনীকে শুরু থেকেই কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হয়েছে। অঢেল ঐশ্বর্যের মাঝে মানুষ এই মেয়েটি তার আরামপ্রিয় জীবন থেকে বের হতে পারেনি। তবে সবকিছুর মাঝে থেকেও সে যেন বড্ড নিঃসঙ্গ। ১৫ বছর বয়সে তার মা মারা যায়, বাবা তার ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত। তাই বাবার বিশাল প্রাসাদে সবকিছু থাকলেও ভালোবাসার বড্ড অভাব ছিল। সেই অভাব মেটাতেই হয়তো আনিসের সাথে অদ্ভুতভাবে আলাপ হওয়ার ঘটনাটি নবনী সাজিয়েছিল, আনিসের হাত ধরেই নিঃসঙ্গ জীবন থেকে বের হতে চেয়েছিল।
কিন্তু আনিসের সবকিছু চেপে রাখার স্বভাব তাকে উল্টো বিভ্রান্ত করেছে, ফলে বিবাহিত জীবনের ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা তাকে ভাবতে হয়েছিল। সত্যি বলতে নবনীর এসব কর্মকাণ্ডই ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাপারে তার গভীর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। আনিস তাকে সত্যিই ভালোবাসে কি না – এই একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় সে বারবার আনিসকে বিচ্ছেদের কথা বলেছে। উপন্যাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান চরিত্র ছিল নবনী, বিশেষ করে রাতে গ্রামবাসীর ভূতের ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা সে যেভাবে সমাধান করে তা সত্যিই অসাধারণ।
জহির খাঁ
বিরাটনগর গ্রামের চেয়ারম্যান জহির খাঁ প্রায় পুরো উপন্যাসজুড়েই নিজেকে দুষ্টু লোক বলে জাহির করেছেন। তবে অতি বেশি দুষ্টু লোক বলে তাকে মনে হয়নি। ইমাম সাহেবের প্রতি তিনি যে বিচার করেছিলেন তা অবশ্যই অন্যায় ছিল, তবে সেই অন্যায়টিকে অনিচ্ছাকৃত বলেই মনে হয়েছিল। আজিজ মিয়া অতি দ্রুত ধনী হওয়ায় তিনি বিচলিত হলেও আজিজ মিয়ার অনিষ্ট করার জন্যেও তাকে সেভাবে কিছু করতে দেখা যায়নি। ছোটবড় যেকোনো দুর্ঘটনায় ঘাবড়ে যাওয়াটা তার মনের দুর্বলতাকেই প্রতীয়মান করেছে।
মতি মিয়া
উপন্যাসের সবচেয়ে বিচিত্র চরিত্র ছিল এই মতি মিয়া, ৩০ বছর বয়সী এই যুবক কোনো স্থায়ী পেশায় থিতু ছিল না। কখনো সে কুলির কাজ করেছে, কখনো ঘরামীর কাজ আবার কখনো মুড়ি লাড্ডু বানিয়ে ট্রেনে বিক্রি করেছে। ছিঁচকে চোর হিসেবেও তাকে দেখা গেছে, চুরির অধিকাংশ টাকা সে নিশিকন্যাদের পেছনেই ব্যয় করতো। শিক্ষাগত যোগ্যতা ফাইভ পাশ হলেও তাকে কিছুটা ভাবুক চরিত্রে দেখা গেছে, তাই নিজের চুরি করার ব্যাপারেও অদ্ভুত কিছু যুক্তি সে সবসময় দাঁড় করাতো। ভবঘুরে এই মানুষটিও জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখে, বিয়ে করে ছোট্ট একটা সংসার গড়ার জন্য নানা ধরনের চিন্তা তার মাথায় আসে। বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে উপন্যাসের পুরোটা সময়ে মতি মিয়া হাসির উপলক্ষ্য তৈরি করে গেছে।
এছাড়াও আরো কিছু ছোট চরিত্র এই উপন্যাসে রয়েছে। এদের মধ্যে ইমাম সাহেব, আনিসের বাবা, আনিসের মা, নবনীর বাবা, সখিনা, আজিজ মিয়া, সুজাত উল্লেখযোগ্য। মূল কাহিনীতে তেমন ভূমিকা না থাকলেও এদের জীবনকথা উপন্যাসকে গতিশীল করতে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে।
হুমায়ূন আহমেদ যত প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন, সেগুলোর মধ্যে ‘তেতুল বনে জোছনা’ বেশ ওপরের দিকেই থাকবে। কিছু পাঠকের মতে এটি লেখকের শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাস। আনিস ও নবনীর মধ্যে বিয়ের পরে যে সমস্যা দেখা গেছে, তা পারিবারিক বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক দম্পতির জীবনেই দেখা যায়। যার দরুণ উপন্যাসটির কাহিনী অনেক বেশি বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। কাছের মানুষের প্রতি থাকা ভালোবাসা প্রকাশ না করে সবকিছু নিজের কাছে চেপে রাখলে ঠিক কেমন সমস্যা তৈরি হতে পারে – তা লেখক বেশ ভালোভাবে তুলে ধরেছেন।
তাছাড়া অধিকাংশ গতানুগতিক প্রেমের উপন্যাসে শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকার জীবনকেই বর্ণনা করা হয়ে, এক্ষেত্রেও উপন্যাসটি ব্যতিক্রম। বিরাটনগরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে গ্রামের রাজনীতি ও মানুষের বিভিন্ন বিশ্বাসকে দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই সবমিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকা করা হলে ‘তেতুল বনে জোছনা’ উপন্যাসটি সেই তালিকায় একটি স্থানের দাবি জানাতেই পারে।
বইটি অনলাইনে কিনতে ক্লিক করুন এখানে- https://rb.gy/ytqjpq