গত শতকের আটের দশকে, বলা যায় আশির একেবারে শুরুতে, অর্থাৎ ১৯৮১ সালে সারা পৃথিবী জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা ঘটনাটি হলো, ‘আয়ারল্যান্ডের অনশন ধর্মঘট’। ১৯৭৬ সাল হতে ধীরে ধীরে গর্জে উঠতে থাকা এই বিপ্লবের সর্বোচ্চ সীমার ফলই একাশি’র সেই অনশন ধর্মঘট। ‘৭৬-এ এই প্রতিরোধ সর্বপ্রথম ‘ব্ল্যাঙ্কেট প্রোটেস্ট’ হিসেবে আরম্ভ হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের রাজবন্দীদের, সাধারণ অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্তে প্রতিবাদস্বরূপ উত্তর আয়ারল্যান্ডের মেইজ জেলে আইরিশ রিপাবলিকান কারাবন্দীরা বিদ্রোহের সূচনা করে।
‘৭৮ সালে এই বিদ্রোহ আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। বন্দীরা সেল হতে বেরোনো এবং নিজেদের পরিষ্কার করার ব্যাপারে সরাসরি জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং তাদের সেলের দেয়ালগুলো মল দিয়ে ঢেকে দেন। প্রথম অনশন ধর্মঘট হয় ১৯৮০ সালে, যার ব্যাপ্তি ছিল ৫৩ দিন এবং ৭ জন বন্দী এতে অংশ নেন। তবে ‘হাঙ্গার’ সিনেমার গল্প মূলত দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘটকে ঘিরে। তরুণ বিপ্লবী ববি স্যান্ডস ‘৮১ সালের এই দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং কারাবন্দীদের মধ্যে চরম পরীক্ষা ছিল এই অনশন ধর্মঘট।
টানা ৬৬ দিন অনশনে থেকে প্রয়াণ ঘটে ববি স্যান্ডসের এবং মারা যান আরো ৯ জন। ববি স্যান্ডস সহ ১০ জনের এই মৃত্যু সারা বিশ্বে এক নজির স্থাপন করে এবং দ্বিতীয় এই অনশন ধর্মঘটকে ১৯৮১ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা করে তোলে। ধর্মঘটের সেই সময়টাকে কেন্দ্রে রেখেই নির্মিত হয় সিনেমাটি।
‘হাঙ্গার’ বিপ্লবকে ধারণ করে, তবে প্রথাগত ধারায় নয়। হাঙ্গারের বিপ্লব সুচিন্তিত, সংঘাতপূর্ণ, নীরব এবং খুবই বস্তুনিষ্ঠ। ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর সিনেমার পরিচিত গঠনশৈলী ‘হাঙ্গার’-এ নজরে লাগে না। অথচ তেমন গঠনশৈলীতে না আটকেই এটি বৈপ্লবিক চেতনা, অবদমনকে সম্মুখে আনে। ‘হাঙ্গার’ গল্পসর্বস্ব সিনেমাও নয়। ঠিক প্রচলিত গল্প, এমনকি প্রচলিত ধারায় গল্পের বয়ানকেও এই সিনেমা গ্রহণ করেনি। সিনেমার শুরুর দিকটায় ভয়েসওভারে মার্গারেট থ্যাচারকে বলতে শোনা যায়,
“রাজনৈতিক সহিংসতা, রাজনৈতিক হত্যা, রাজনৈতিক বোমা হামলা বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব আছে, তো অপরাধী হত্যা, অপরাধী বোমা হামলা এবং অপরাধী সহিংসতার আছে।”
পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইন থ্যাচারের এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা কিংবা অযৌক্তিকতা নির্ণয় করতে যাননি। এই বক্তব্যের কোনো পক্ষে অবস্থানও নেননি। তিনি বরং কারাগারের অমানবিক অবস্থা, আই.আর.এ. (আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি) সদস্যদের ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ়তা এবং পাথুরে মেঝে আর দেয়ালে আবদ্ধ এই জগতটাকেই দর্শকের হৃদয়ে অনুনাদী করে তুলতে চেয়েছেন।
আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস কিংবা রাজনীতি নিয়ে কোনো বর্ণনা করতে যায়নি ‘হাঙ্গার’। নির্দিষ্ট কোন কারণটির জন্য এতসব বন্দী এই কারাগারে অবস্থান করছে, তা কখনো বলতে যায়নি ‘হাঙ্গার’। গল্প বর্ণনা নয়, বরং প্রক্রিয়া বর্ণনাতে অটল থেকেছে এই সিনেমা। সিনেমার প্রথাগত ন্যারেটিভ হতে বেরিয়ে একটি কালচক্র ধরে এগিয়ে গেছে কিংবা কিছু রুটিন ধরে, যার কেন্দ্রে অভিঘাতী হয়ে জড়িয়ে রয়েছে ‘নির্দয় বাস্তবতা’। এই রুটিনগুলোর একটি সম্পর্কিত একজন কারারক্ষীর সাথে। বন্দীদের উপর নির্যাতন চালাতে পাশবিক আনন্দ পাওয়ার ব্যক্তি ইনি নন।
সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যেই দেখা যায়, হাত থেকে বিয়ের আংটি খুলে রেখে বেসিনে জমিয়ে রাখা পানিতে ক্ষতমাখা হাত দুটিকে ভিজিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। এই ক্ষত শুধু শরীরে নয়, ছড়িয়েছে তার মনে। বিষাদময় ভাবটা তার চেহারায় আছে। আর বিচ্ছিন্নতার প্রমাণ মেলে ওয়াইড শটে বরফের মাঝে দাঁড়িয়ে নীরবে সিগারেট ফুঁকতে থাকার দৃশ্যে। সিনেমার আরেকটি রুটিনে, কয়েদখানার সাধারণ অপরাধীদের পোশাক পড়তে অসম্মতি জানানো দুই বন্দীকে দেখা যায়। এবং শেষটায়, অনশন ধর্মঘটের ইতিবৃত্ত, যা ববি স্যান্ডসকে ঘিরেই একমাত্র।
‘হাঙ্গার’, আই.আর.এ.-এর দৃষ্টিভঙ্গি ধরে এগোচ্ছে মনে হলেও ভাবনাহীন চিত্তে অন্ধের ন্যায় সে পক্ষ নেয়নি। বন্দী বা রক্ষী কেউই পিছু হটার নয়, ‘হাঙ্গার’ তাই স্বাধীনতার পক্ষ নিয়েছে। এই ক্ষুধা, স্বাধীনতার ক্ষুধা। ‘হাঙ্গার’, তার দৈর্ঘ্যের শতকরা ৮০ ভাগ সময়ই সংলাপমুক্ত থেকেছে। প্রায় বিশ মিনিট দীর্ঘ একটি লং টেক শটেই সিনেমার শতকরা ৮৫ ভাগ সংলাপ ছিল। স্যান্ডস এবং পাদ্রীর মধ্যকার আলাপচারিতার এই দৃশ্যে অনশন কার্যক্রমে স্যান্ডসের দৃঢ়বিশ্বাস, পাদ্রীর ‘যদি’র মাঝে আটকে স্যান্ডসকে দমানোর চেষ্টার পাশাপাশি ব্যক্তি স্যান্ডসের রাজনৈতিক চেতনা, ধর্মবিশ্বাসের জায়গাটি কেমন- তাও উঠে আসে।
পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইনের এই অভিষেক সিনেমা খুব গূঢ়ভাবে চিন্তাশীল এবং নিরীক্ষাধর্মী। পরিচালক নিরীক্ষাধর্মী এবং সামাজিক বাস্তবতা নির্ভর সিনেমা নির্মাণে আলাদা ঝোঁক রাখেন, যা তার পরবর্তী ‘শেইম’ (২০১১), ‘টুয়েলভস ইয়ার্স আ স্লেইভ’ (২০১৩)- সিনেমাগুলোয় দেখা গিয়েছে। একজন দৃশ্যশিল্পী হওয়ার সুবাদে সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যেই শৈল্পিকতার ছোঁয়া রেখে দৃশ্যগুলো সাজিয়েছেন তিনি।
কদাকার কিছুর মাঝেও একটা শৈল্পিক রেখা তিনি এঁকে দিতে পারেন। তাইতো কারাগারের প্রতিটি কক্ষের দেয়ালকে বিষ্ঠা দিয়ে লেপে রাখার মাঝে কারাগারের প্রচন্ড ‘র’, অসুস্থ, নারকীয় পরিবেশটা উঠে আসার পাশাপাশি মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচায়কও হয়ে ওঠে, যে কারণে সেই কদাকার গা গুলিয়ে আসা ভাবটা পুরোপুরি জাগায় না।
এবং প্রতিটি কক্ষের বন্দীদের নিজেদের খাবার চূর্ণ করে, ভর্তা করে বাঁধ বানিয়ে তাতে মূত্র ঢেলে কারাগারের করিডর মূত্রে ভাসিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি তাদের বিদ্রোহী মনোভাব রূপকের মাঝ দিয়ে প্রকাশ করার পাশাপাশি মানুষের দুর্দশার চিত্রও বর্ণনা করে। এই পরিচালকের ‘শেইম সিনেমায় একজন যৌনাসক্তের গল্পে এবং ‘টুয়েলভস ইয়ার্স আ স্লেইভ’ সিনেমায় দাসত্বের গল্পেও মানব দুর্দশার এই বিষয়টি উঠে এসেছে, ভিন্ন গল্পে ভিন্ন পরিস্থিতিতে। এই বিষয়টি হয়ে উঠেছে তার সিনেমার অন্যতম প্রধান একটি বিষয়।
স্টিভ ম্যাককুইন ঐতিহাসিক ও বিপ্লবী গল্পের এই সিনেমাকে ভিন্ন এবং বিলক্ষণ করে তুলেছেন নতুন এক কোণ ও বয়ানভঙ্গী যুক্ত করে। আর এই রূপ আরো অমোঘ বা অব্যর্থ হয়ে উঠেছে শব্দ এবং ইমেজারির কুশলী ব্যবহারে। আর দারুণ সম্পাদনা এই দুয়ের মাঝে চূড়ান্ত এক সমন্বয় এনে দিয়েছে। ম্যাককুইন তার ক্যামেরাকে স্ট্যাটিক রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মনে হয়, ক্যামেরা নাড়াচাড়া করার ঝক্কি তিনি পোহাতে চান না। কিন্তু না, তিনি চান সবটুকু ধারণ করতে। বিশুদ্ধ আবহ সৃষ্টি করতেই সামগ্রিকতা ধারণ করতে চান তিনি। আর তাই লং টেকের সব শট নিতে ভালোবাসেন। লং টেকের শটকে তিনি মানব দুর্দশা তুলে ধরার পাশাপাশি উত্তেজনা বৃদ্ধি করার উপায় হিসেবেও ব্যবহার করেন। এই সিনেমার প্রায় ২২ মিনিট দীর্ঘ সেই দৃশ্যে ম্যাককুইন, মিড অ্যাঙ্গেল শটে প্রথম সাড়ে ১৭ মিনিট ক্যামেরা বিন্দুমাত্র নড়চড়হীন রেখে; তারপর একটি ইনসার্ট শট থেকে ৫ মিনিট দীর্ঘ ক্লোজআপ শটে চলে যাওয়ার দৃশ্যে আইরিশদের রসবোধের সূক্ষ্ম পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি সামনে আসতে চলা অনশন ধর্মঘট নিয়ে উত্তেজনা জাগিয়ে গেছেন দর্শকমনে।
স্টিভ ম্যাককুইন, ক্যামেরার ওয়াইড ফ্রেমকে বিস্তীর্ণ স্থান তুলে ধরতে ব্যবহার করেননি, বরং জেলখানার আবদ্ধ পরিবেশের ভীতিতেই ভারি তার ওয়াইড ফ্রেমগুলো। অনেকটা ক্লস্ট্রোফোবিক অনুভূতি জাগায়। এই সংকীর্ণ পরিবেশের প্রতিটি কোণের সাথে দর্শককে তার নিজের হাতের রেখার মতো চিনিয়ে দিতেই ফ্রেমগুলোকে ওয়াইড রেখেছেন ম্যাককুইন। তবে প্রকৃত শিল্পী সত্ত্বাকে প্রতিটি ফ্রেমে প্রকাশ হতে দেওয়ার পাশাপাশি সমান্তরালে ফিল্মমেকিংয়ের ফ্ল্যাশি টেকনিকের ব্যবহারটাও তিনি করে দেখিয়েছেন তার এই অভিষেক সিনেমায়। পোশাক পড়তে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রতিটি সেলে বন্দীদের ভাঙচুরের সেই দৃশ্যটির কথাই ধরা যাক।
প্রতিটি শটে অ্যাবরাপ্ট কাট করে সম্পাদনায় জোড়া লাগিয়ে গতি আরো দ্রুততর করে বন্দীদের বিদ্রোহী চেতনাকে আরো জোরালো করে তুলেছেন তিনি। আবার শেষদিকে হাসপাতালের একটি দৃশ্যে, ববি স্যান্ডসের ভেতরের মুক্তিচেতনা শেষ নিঃশ্বাস অব্দি দৃঢ়- তা বোঝাতে কম্পিউটার গ্রাফিক এবং সম্পাদনায় ডিসলভ প্রক্রিয়ার অপরূপ ব্যবহার ম্যাককুইন করেছেন। বিষণ্ণ নীল আর অসুস্থ হলুদাভ কালারে দৃশ্যগুলোকে সাজিয়েছেন তিনি।
সিনেমার শেষ অঙ্ক একইসাথে কাব্যিক এবং মর্মভেদী। পর্দায় কঙ্কালসার ববি স্যান্ডসকে দেখে সাক্ষাত ভীত হয়ে পড়তে হয়। রীতিমতো অসহনীয় এই অঙ্কের একেকটি দৃশ্য। স্যান্ডসের শরীরের এই ক্ষয়িত অবস্থা ভেতরে প্রচণ্ডরকম হাঁসফাঁস জাগায়। একইসাথে অবচেতনে প্রশ্ন জাগায়, এতটা কষ্ট নিজেকে কী করে কেউ দিতে পারে? মুক্তি কী তবে এতই স্বার্থপর? এত কষ্টের বিনিময়ে হলেও তাকে পেতে কী হবেই? স্যান্ডসের পাঁজরের হাড্ডি আর সারা গায়ে জন্মানো কুৎসিত ফোঁড়াগুলো দেখে শিউরে উঠতে হয়।
স্বাভাবিকতার মাত্রা বলতে তখন কিছু থাকে না এবং সে মুহূর্তে পর্দায় যাকে ববি স্যান্ডস হিসেবে দেখা যায়, তিনি আর এতক্ষণের ববি স্যান্ডস নন, পুনরায় মাইকেল ফাসবেন্ডার হয়ে ওঠেন দর্শকের চোখে। চরিত্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন অভিনেতাকে দেখতে পাওয়া যায় পর্দায়। এবং পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইন কেন তার অভিনেতাদের ভেতর থেকে খাঁটি, সহজাত অভিনয়টা বের করে আনতে তটস্থ থাকেন, সে কারণটাও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সহজাত অভিনয় বের করে বাস্তব এবং পর্দার চরিত্রের মাঝে এই বিভ্রম জাগানোর দিকটি পরিচালক ম্যাককুইনের শৈল্পিক সত্ত্বার সাথেসাথে প্রভোকেশনের দিকটিকে আরো একবার সামনে আনে। এবং ‘হাঙ্গার’ যতখানি মর্মভেদী সিনেমা, তা হয়তো বেশ কিছুটা অধরা থেকে যেত ফাসবেন্ডারের এমন অভিনয় না থাকলে।
পরিশেষে, ‘হাঙ্গার’ উন্মত্ত সিনেমা। স্বাধীনতার ক্ষুধাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধারণ করা সিনেমা। ক্ষুধাকে জয়ের এই উন্মত্ততা সবসময়ই ছিল, আছে, থাকবে। তেমন করে ‘হাঙ্গার’ (২০০৮) ও থাকবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে।