১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ মার্চের সেই ভাষণ বাঙালিদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এরপর ২৫ মার্চ এর স্বাধীনতার ঘোষণা, যার কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিল ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক, চিকিৎসক সহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। কে ছিল না এই দলে? দলে দলে যুদ্ধে নেমেছিল এই দেশের মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে একটি ছিল গেরিলা দল। তুখোড় একদল মানুষ, যারা মুহূর্তেই শত্রুকে উড়িয়ে দিয়েছিল।
সেই গেরিলা দলের একজন হলেন শহীদ আজাদ। সেই সময়ের শিক্ষিত, সুদর্শন, মেধাবী এক যুবক। বন্ধু মহলে ‘এলভিস প্রিসলি’ নামে পরিচিত। তবে এ গল্প ঠিক তাঁর না, তাঁর মা সাফিয়া বেগমের। তিন সন্তানের জননী সাফিয়া বেগম। ভাগ্যের ফেরে আঁতুড় ঘরে হারান দু’সন্তানকে। শহীদ আজাদ ছিল তাঁর চোখের মনি। এটি কেবল এক গল্প কিংবা নয়। সত্য ঘটনাগুলোকে একে একে সাজানো হয়েছে আনিসুল হক এর লেখা ‘মা’ উপন্যাসটিতে।
সাফিয়া বেগমের স্বামী ইউনুস চৌধুরী তখনকার দিনের সবচেয়ে বিত্তশালী মানুষ। সাফিয়া বেগমকে বিয়ের পর বোধহয় তাঁর ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। বিয়ের পর থেকে স্বামীকে নানাভাবে সাহায্য করে এসেছিলেন। ইউনুস চৌধুরীও মনে রেখেছিলেন সেকথা। স্ত্রীর নামে সম্পত্তি, বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন। প্রথমে করাচী, এরপরে ফরাশগঞ্জ, এরপরে ইস্কাটনের বাড়ির একচ্ছত্র রানী সাফিয়া বেগম। ইস্কাটনের সেই বাড়ি, আর তাদের গাড়ি সেই আমলে ছিল সবথেকে দামী আর সুন্দর। প্রাসাদের মতো সেই বাড়িতে ছিল হরিণ, কুকুর। নানা ফুলে-ফলে ভরা সেই বাড়ি তখনকার দিনের ছায়াছবিতে ব্যবহার করা হত। বইটিতে উল্লেখ আছে “ডাকে পাখি, খোল আঁখি” গানটির শুরুর দৃশ্য এখানে চিত্রায়িত করা হয়েছিল।
সাফিয়া বেগমের নেশা ছিল মানুষকে খাওয়ানো। তাঁর বাড়িতে রোজ ৫০ এর বেশি মানুষের জন্য রান্না হতো। তাদের বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল অনেক মানুষের। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে শহীদ আজাদের মা হিসেবে তাঁর কথা এসেছে। এই “মা” বইয়েও অনেকবার এসেছে জাহানারা ইমামের কথা। দুজনই মা, দুজন মা-ই হারিয়েছিলেন তাঁদের সন্তানদের।
সাফিয়া বেগম এত ঐশ্বর্যে থাকার পরও কোনো এক অজানা শঙ্কা তাঁর মনে বারবার কড়া নাড়ত। তাঁর মনে হত কিছু একটা ঘটবেই। তাঁর আশঙ্কা আর ভয়কে সত্যি করে দিয়ে তাঁর স্বামী এনেছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী। স্বামীকে বেশ আগেই শহীদ আজাদের মা বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনি আর কখনোই তার মুখ দেখতে পারবেন না। তিনি কথা রেখেছিলেন, স্ত্রীর মৃত মুখও দেখতে পারেননি ইউনুস চৌধুরী।
পুরো বই জুড়ে মোট তিনটি চরিত্র বারবার নানাভাবে আমাদের সবকিছু জানিয়ে গেছে। শহীদ আজাদ, তাঁর মা আর আজাদের খালাতো ভাই জায়েদ। এই জায়েদও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি আজাদের মাকে ডাকতেন আম্মা ডাকতেন। শেষ ১৪ বছরে, এই জায়েদ ছিলেন তাঁর আম্মার কাছে। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই নারী মারা যান ৩০ আগস্ট ১৯৮৫ সালে, শহীদ আজাদকে হারাবার ঠিক ১৪ বছর পর। এই ১৪ বছরের যাত্রা ছিল তাঁর একার।
স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর পিতৃপ্রদত্ত গহনা আর আজাদকে সাথে নিয়ে এক কাপড়ে উঠেছিলেন ফেলে যাওয়া ফরাশগঞ্জের বাড়িতে। সময়ের ফেরে সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘুরে থিতু হন মালিবাগে। আজাদ টাকা পেত তার বাবার কাছ থেকে, কিন্তু সেই টাকা থেকে এক আনাও কখনও নেননি আজাদের মা। যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন সেদিনের পর থকে ছুঁয়ে দেখেননি আমিষ।
প্রায় বখে যাওয়া ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাস করাবার পরে, একে একে উচ্চ মাধ্যমিক, বি এ আর এম এ। একা হাতে বড় করেছেন আজাদকে, উচ্চ শিক্ষিত করে তুলেছেন ছেলেকে। শুদ্ধভাষী এই নারীর প্রচণ্ড জেদ আর ভালবাসা দিয়ে গড়া শহীদ আজাদের জীবন। দেশের পড়া শেষ করে আজাদ করাচিতে পড়তে যায়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সও শুরু করে দেন। কিন্তু দেশ-মা-মাটির টানে বোধহয় ফিরে এসেছিলেন আজাদ।
সময়টা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১। দশ আর দেশের কাজে আজাদ নিজেকে ভালোভাবেই সঁপে দিয়েছিল। করাচির বন্ধু বাশার এসে আশ্রয় নেয় আজাদদের ছোট্ট নীড়ে। মালিবাগের সেই বাসা একসময় হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল।
নানা উত্থান-পতন আর ঘটনার পরে আজাদ, রুমী, বাচ্চু, জুয়েলসহ কত তরুণ নেমেছিল যুদ্ধে, সেই যে ৭ মার্চ এর রক্তে আগুন ধরানো ভাষণ, সেই ডাক। কে উপেক্ষা করবে?
সময় থেমে থাকে না। চলে আসে সেই ভয়াবহ দিন। আজাদসহ আরো অনেক গেরিলা যোদ্ধা ধরা পড়ে যায়। প্রচণ্ড প্রহারে মুখ খোলেনা আজাদ। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার মা বললে কি তুমি বলবে?
যে মা কোনোদিন একটা কড়া কথা বলেনি একমাত্র চোখের মণিকে, সেই মা ছেলেকে বলেছিলেন, “কারো নাম বলোনি তো। বোলো না। যখন মারবে, শক্ত হয়ে থেকে সহ্য কোরো।” এভাবেই ছেলেকে নিয়তির হাতে তুলে দিয়েছিলেন মা।
আজাদ মায়ের কাছে এক মুঠো ভাত চেয়েছিলেন। এরপরে ভাত নিয়ে ফিরে গিয়ে আজদের দেখা তিনি আর পাননি। এরপরে ১৪ বছর, ১৪ বছর তিনি মুখে ভাত দেননি। সেদিনের পরে ১৪ বছর তিনি বিছানায় শোননি, কারণ তাঁর আজাদকে শুতে হতো কারাগারের শক্ত মেঝেতে।
এই বই নিয়ে কিছু লিখতে গেলে মনে হয় বই এর চাইতেও অনেক বেশি পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। লোম শিউরে ওঠার মতো কাহিনী। আজাদের কিছু কিছু কাজে হেসেছি, কিছু কোথায় চোখে জল। মায়ের সাথে কী সুন্দর-সহজ সম্পর্ক। সেদিনের আজাদ, রুমী, বদি, বাচ্চু এসব মানুষের আত্মত্যাগের ফসল এই দেশ। সেদিনের সেই মানুষের মতো আমাদের সহ্য শক্তি বা দেশের প্রতি ভালবাসা আছে কি না জানি না, তবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ের এই লাল-সবুজের পতাকার মান যেন সমুন্নত রাখতে পারি আমি, আমরা, আমরা সবাই।