প্রত্যাশা পরিত্যাগ করাই সুখী হওয়ার একমাত্র উপায়। – মশিউল আলম
২০৫০ সাল। দেশে জনসংখ্যা হ্রাসের নীতি অত্যন্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০৩৫ সালে প্রণীত হয়েছে মানব প্রজনন নিয়ন্ত্রণ আইন, যার মূলকথা- একটি মৃত্যুর বিনিময়ে একটি জন্ম। কোনো পরিবারে কারো মৃত্যু না হলে কোনো সন্তানের জন্ম দেওয়া যাবে না। এ আইন অমান্য করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কারো মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে ঐ ব্যক্তির পরিবার একটি সন্তানের জন্ম না নিলে ঐ মৃত্যু মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে।
বৃদ্ধ পিতা বা মাতার মৃত্যু হলে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ পুত্র বা কন্যা সন্তান জন্মদানের অনুমতি লাভ করে। ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ নয়, এমন কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর বিনিময়ে সন্তান জন্ম দেওয়া যাবে না। গর্ভধারণের ছয় সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করার জন্য সরকার উৎসাহিত করে। এই মেয়াদ পেরিয়ে গেলে গর্ভপাত আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত গরীব বয়স্ক নারীপুরুষকে উচ্চমূল্যে কিনতে পাওয়া যায়।
উপরোক্ত অংশটুকু বইয়ের প্রচ্ছদপট থেকে লেখা। ভাবছেন, এ-ও কি সম্ভব? অনাগত ভবিষ্যতে হয়তো সম্ভব। এমনই একটি ডিস্টোপিয়ান সাই-ফাই কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে মশিউল আলমের ‘প্রিসিলা’। মাওলা ব্রাদার্স থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। তবে কেন যেন বইটি এক যুগ পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আড়ালেই রয়ে গেছে।
নাম চরিত্র প্রিসিলা এক যুবতী নারী, যে কি না ভালোবেসে বিয়ে করেছে রাসেলকে। রাসেলের বাবা নেই। মা আর ছোট ভাই আছে। যদিও ছোট ভাই আর তার বউয়ের সাথে রাসেলের মা বসবাস করেন। সালটা ২০৫০। ইতোমধ্যেই ২০৩৫ সালে প্রণীত হওয়া মানব প্রজনন নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর হয়েছে। তাই এই শহরে ভালোবাসা এখনো টিকে থাকলেও মা কিংবা বাবা হওয়ার শখ-আহ্লাদটা মোটামুটি মিটে গেছে বলেই সবার ধারণা। তবুও, প্রিসিলা স্বপ্ন দেখে, সে মা হবে। ছোট্ট একটা সন্তানও উপহার দেবে রাসেলকে ভালোবাসার প্রতিদানস্বরূপ। কিন্তু কীভাবে? রাসেলের তো বাবা নেই, আর অচিরেই মায়ের মৃত্যুরও তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
আর তাছাড়া, রাসেলের মা থাকে তার ছোট ভাইয়ের সাথে। তারাও বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক। আবার অন্যদিকে, স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে গর্ভধারণ করলে রাষ্ট্র স্বামীকে ফাঁসিতে চড়াবে। কিন্তু রাসেলকে ভালোবাসে প্রিসিলা। অবশ্য আরেকটা উপায় আছে, ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত গরীব বয়স্ক মানুষকে উচ্চমূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের সেই সামর্থ্য নেই। দুজনের বেতন মিলে কোনভাবে সংসার চলে। সঞ্চয়ের জন্য অবশিষ্ট আর কিছুই থাকে না। প্রিসিলা এক মহা সংকটে পড়েছে।
দুটি মানুষের মধ্যে একবার যখন পারস্পরিক সন্দেহ দেখা দেয়, তখন সবকিছুই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
প্রিসিলার মতোই ২০৫০ সালে বসবাস করা নাগরিকদের মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের স্বাদ নেওয়া হয় না। অথচ ক্ষমতাসীন দলের লোকেদের লাইসেন্স আছে সন্তান জন্মদানের। তাই, সকলে মিলে সম্মিলিত হয় সরকারের এই আইন ভেঙে দেবে। কিন্তু সরকার যেন মুখিয়ে থাকে প্রতিদিন মানুষ মারার জন্য। সরকারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনসংখ্যা; তাতে অগণিত গুলি খরচ করে হলেও কয়েকটা মানুষ মারা চাই-ই চাই। আর তা যদি প্রতিদিনই ঘটে, তাহলে সরকারের চাইতে খুশি আর কে-ই বা হবে? এই ভয়ে আর কেউ পা-ও বাড়ায় না সে পথে।
স্বামী-স্ত্রীরা এক অদ্ভুত নিত্যদিনের অভিনয় নিয়ে সংসার করে। সম্পর্কের টানাপোড়েন বীজ বুনতে শুরু করে। পুত্রবধুরা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির মৃত্যুদিনের প্রহর গোনে বসে বসে। সন্তানের আশায় তারা বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়। রাত্রিবেলা তারা এই প্রার্থনা করে, যেন সকালে উঠেই বাসার বয়োজ্যেষ্ঠদের একজন মারা যায়। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠরাও চান, আরো খানিকটা সময় এই পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু মনের মধ্যে দানা পাকিয়ে উঠে এক আতঙ্ক। এই বুঝি ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাকে খুন করে জন্মদানের লাইসেন্স নেবে তারই সন্তান।
প্রিসিলা উত্তর খোঁজে, কিন্তু প্রশ্ন ব্যতীত প্রিসিলার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাসেলের মা মনে করে, প্রিসিলা হয়তো তার মৃত্যু কামনা করে। তাই সে রাসেলের ছোট ভাইয়ের বাসাতেই শান্তি খুঁজে। প্রিসিলা চায়, রাসেল যেন আরো ভালো একটা চাকরি যোগাড় করে যাতে একজন বৃদ্ধ মানুষ কিনতে পারে তারা। কিন্তু রাসেলের জ্বলজ্বলে চোখটা কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। প্রিসিলা উপায় খোঁজে। রাসেলকে ফাঁকি দেওয়া ছাড়া প্রিসিলার আর কোনো উপায় নেইম কিন্তু প্রিসিলা যে রাসেলকে ভালোবাসে। কী করবে সে?
লেখক মশিউল আলম সাংবাদিকতায় পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পাশাপাশি লেখালেখিটাও চালিয়ে যাচ্ছেন সেই আশি-নব্বইয়ের দশক থেকেই। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে ‘রুপালি রুই ও অন্যান্য গল্প’ শিরোনামে। আর তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘আমি শুধু মেয়েটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম’ শিরোনামে।
একবিংশ শতাব্দীতে বসে ৫০ বছর পরের ভবিষ্যত নিয়ে লেখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিছুদিন পর পর নাটকীয় পরিবর্তনের যুগে ভবিষ্যতের কথা কে জানে? দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারীই পারে নিজের চিন্তায় জন্ম নেওয়া ভবিষ্যতকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে। আর দেখাতে পারে ভবিষ্যতের ভুল সিদ্ধান্তের ফল কী হতে পারে। প্রিসিলায় মশিউল আলমও এই কাজ করেছেন।
বইয়ের নাম: প্রিসিলা || লেখক: মশিউল আলম
প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম