কিছুদিন আগে টুইটারে ঘটে যাওয়া রীতিমতো একটি খন্ডযুদ্ধের ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। শাহরুখের বিখ্যাত সিনেমা ‘চাক দে ইন্ডিয়া’র আট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বলিউডের নির্মাতা হানসাল মেহতা টুইট করেছিলেন, “চাক দে ইন্ডিয়ার আট বছর পূর্তি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে শাহরুখ কত অসাধারণ একজন অভিনেতা। ‘অভিনেতা’ শাহরুখের উচিৎ ‘তারকা’ শাহরুখকে আরো বেশী চ্যালেঞ্জ করা।”
মেহতা যদিও শাহরুখের একজন ভক্ত হিসেবেই টুইটটি করেছিলেন, কিন্তু শাহরুখ ভক্তরা বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে নিতে পারেনি। টুইটারে হানসাল মেহতাকে তারা রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছিলেন বলা যায়। শাহরুখ নিজেও টুইট করেছিলেন এ নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, “তারকা সত্তাকে চ্যালেঞ্জ করার কী দরকার? দুটি সত্তাই আমার অংশ। তারা পাশাপাশিই থাকুক, আমি আমার এ দুটি সত্তাকেই ভালোবাসি।”
যা-ই হোক, আজকের লেখাটির উদ্দেশ্য তারকা শাহরুখ আর অভিনেতা শাহরুখের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করা নয়, বরং অসামান্য তারকাখ্যাতির আড়ালে এক প্রকার চাপা পড়ে যাওয়া তার অভিনেতা সত্তাকে একটু খুঁজে দেখা।
শাহরুখ খান নামটির সাথে সাথে সবার আগে দিলওয়ালা দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, কুছ কুছ হোতা হ্যায় বা দিল তো পাগল হ্যায়’র মতো সিনেমাগুলোর নাম চলে আসে। আর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে রাজ কিংবা রাহুল নামের অনন্য প্রেমিকের ছবি। অবশ্য শুধু প্রেমিক চরিত্রেই নয়, শাহরুখ বাজিগর, ডরের মতো সিনেমাগুলোয় এন্টি-হিরো চরিত্রে বলিউড মাতিয়েছেন। একশন ও কমেডি ঘরানার সিনেমায়ও দেখিয়েছেন নিজের ক্যারিশমা।
সন্দেহ নেই, এ সিনেমাগুলো বলিউডের অন্যতম আইকনিক সিনেমা হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকা করে নিয়েছে। রাজ, রাহুল, ডনরা ঠাঁই করে নিয়েছে বলিউডপ্রেমীদের অন্তরে। আর এ সকল কমার্শিয়াল সিনেমাই শাহরুখকে মহাতারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, এনে দিয়েছে অঢেল খ্যাতি, প্রাচুর্য আর সম্মান।
কিন্তু অভিনয়শিল্পের দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে একটা খুঁতখুঁতে ভাব থেকেই যায়। কমার্শিয়াল সিনেমায় একজন তারকার অভিনয় আর অভিনয় শিল্পের মধ্যে একটা ফারাক সবসময়ই বিদ্যমান। আর এখানেই চলে আসে ‘তারকা’ বনাম ‘অভিনেতার’ দ্বন্দ্ব। কমার্শিয়াল সিনেমায় একজন তারকার চরিত্রের গভীরে ঢুকে সেই চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায় না। অভিনয়ের চেয়ে এখানে প্রাধান্য পায় পর্দায় তারকার ক্যারিশমাটিক উপস্থিতি, স্টাইলিশ হালচাল ও ডায়ালগবাজি আর বলিউডের কথা বললে নাচের দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ।
একজন তারকার সিনেমা কেবল তার নামের উপর ভর করেই সফল হয়ে যেতে পারে। আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গভীর কোনো গল্পের বদলে এসব সিনেমায় থাকে সস্তা বিনোদনের উপকরণ। এজন্যই তুমুল খ্যাতি সম্পন্ন এমন অনেক তারকারও দেখা মেলে, অভিনয়ে দক্ষতার ক্ষেত্রে যারা পাশ মার্কও উতরাতে পারবেন না।
ব্যবসায়িক সিনেমায় তুমুল সফল হওয়া শাহরুখকে নিয়েও এই প্রশ্ন জাগে, শাহরুখ কি স্রেফ একজন ‘তারকা’? নাকি একজন ‘তারকা-অভিনেতাও’? এ প্রশ্নের জবাব শাহরুখের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের দিকেই ফিরে তাকালেই পাওয়া যায়। স্বদেশ (২০০৪), চাক দে ইন্ডিয়া (২০০৭), মাই নেম ইজ খান (২০১০) এর মতো সিনেমাগুলো শাহরুখের অসামান্য অভিনয় দক্ষতার প্রমান হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। চলুন এ অসাধারণ তিনটি সিনেমার জগত থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। দেখে আসা যাক ‘অভিনেতা’ শাহরুখ খানের ক্যারিশমা।
স্বদেশ সিনেমায় শাহরুখ খান
মোহন ভার্গব, নাসা’র একজন সফল ভারতীয় বিজ্ঞানী। শৈশবে তাকে লালন পালন করা দাইমাকে নিয়ে যেতে আসেন ভারতের একটি গ্রামে। বহু বছর পর ভারতে ফিরে এসে, মোহন নতুন করে আবিষ্কার করে নিজের মাতৃভূমিকে। মনের গহীনে অনুভব করে শেকড়ের প্রতি টান। নিজের মাতৃভূমির দুঃখ দুর্দশা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। নতুন করে ভাবায় দেশের প্রতি নিজের কর্তব্য নিয়ে। আশুতোষ গোয়ারিকরের পরিচালনায় স্বদেশ সিনেমায় এই মোহন ভার্গবের চরিত্রটিই করেন শাহরুখ খান।
স্বদেশ সিনেমায় দেখা মেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শাহরুখের। নায়কোচিত কোনো পরিচিতি নেই, তেমন কোনো রোম্যান্টিক দৃশ্য নেই, সিনেমার গল্পে টানটান উত্তেজনাও নেই। ধীরে বয়ে চলা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে একের পর এক দৃশ্য। শাহরুখের চরিত্রটি এখানে কোনো নায়ক নয়, বরং একজন সাধারণ মানুষের চরিত্র। কিন্তু এ সাধারণ চরিত্রটিতে তার অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ছাপ রেখে গেছেন সকল দর্শকের হৃদয়ে, তিন ঘণ্টা দীর্ঘ সিনেমাটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যা আবেশিত করে রাখে দর্শকদের। একজন সফল প্রবাসীর চোখে দেশের বাস্তবের জীবনধারার করুণ দৃশ্যগুলো আলোড়িত করতে থাকে মনকে।
বহু বছর পর মোহনের সাথে তার দাইমার দেখা হওয়ার সেই আবেগী দৃশ্য, গীতার সাথে মোহনের দেশের অবস্থা নিয়ে তর্ক করা, ‘নিচু জাতের’ বাচ্চাদের নিজেদের সন্তানদের সাথে একই স্কুলে পড়ার অনুমতি দেয়ার জন্য গ্রামের পঞ্চায়েতদের রাজী করানো বা পঞ্চায়েতদের সাথে মোহনের সেই তর্ক, যেখানে মোহন বলে, “আমি মানি না আমাদের এ দেশ সবথেকে মহান দেশ।” এ দৃশ্যগুলোতে এক নতুন শাহরুখকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার অভিনয় দর্শকদের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়।
পুরো সিনেমাজুড়ে এমন একের পর এক দৃশ্য যা নিত্যকার বাস্তব, সেগুলো নতুন করে সামনে এসেছে। যেমন, এক কৃষকের কাছে পাওনা আদায় করতে গিয়ে, মোহনের তাদের দুর্দশা দেখা, যা বাস্তবে দেখে আমরা তাড়িত হই না, কিন্তু সিনেমার মোহনকে সেটি স্তম্ভিত করে দেয়। আমরাও মোহনের চোখ দিয়ে নতুনভাবে দেখি সেই দৃশ্য। আর রেলষ্টেশনে একটি বাচ্চা ছেলের কাছ থেকে পানি কেনার সময় মোহনের অভিব্যক্তির সেই দৃশ্যটি তো হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে আইকনিক দৃশ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, এ সিনেমাটিতে শাহরুখ তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয়টি করেছেন। বক্স অফিসে সিনেমাটি সাড়া না জাগালেও সমালোচকদের দৃষ্টিতে এটি শুধু শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারেই নয়, বরং হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি সিনেমা, যে সিনেমাকে কোনো সময়ের গন্ডিতে বাঁধা যায় না। হিট, ফ্লপ এ শব্দগুলো এ সিনেমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন।
চাক দে! ইন্ডিয়া সিনেমায় শাহরুখ
কবির খান, একজন প্রাক্তন হকি খেলোয়াড়। যাকে অতীতের এক ক্ষত তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। ভারতীয় নারী হকি দলের কোচ হিসেবে তিনি বিশ্বকাপ এনে দিতে চান দেশকে, যে দেশ কয়েক বছর আগে তাকে গাদ্দার আখ্যা দিয়েছে, ম্যাচ পাতানোর মিথ্যা অভিযোগ এনে লাঞ্চিত করেছে। শিমিত আমিনের পরিচালনায় চাক দে! ইন্ডিয়া’র এই কবির খান চরিত্রটিই শাহরুখ করেছিলেন।
বলা যায়, স্বদেশের পর এটি দ্বিতীয় সিনেমা যা শাহরুখের ভেতর থেকে অভিনয় প্রতিভাকে নিংড়ে বের করেছে। একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোচ, কবির খানের এ চরিত্রটি শাহরুখ অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির খান দেশের লাঞ্চনার জবাবে দেশকে বিশ্বকাপ এনে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিছু খামখেয়ালী খেলোয়াড়কে শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রশিক্ষিত একটি দল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। একের পর এক বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারে স্বপ্নের দিকে।
এ সিনেমায় শেষ হওয়ার পরও শাহরুখের বেশ কিছু দৃশ্য মনে দাগ রেখে যায়। খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণে সেই কঠোর শাহরুখ, যে একরোখা সিনিয়র প্লেয়ারের চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দেয়, ‘হার টিম মে সির্ফ একই গুন্ডা হো সাকতি হ্যায়, অর ইস টিমকা গুন্ডা ম্যায় হুঁ’ বা পরাজিত শাহরুখের সেই কথাগুলো, যখন সব খেলোয়াড় স্বাক্ষর দিয়ে জানিয়ে দেয় তারা কবির খানকে কোচ হিসেবে চায় না। এ দৃশ্যগুলো ভোলার মতো নয়।
যেমন ভোলা যায় না ফাইনাল ম্যাচের আগে, কবির খানের বলা কথাগুলো “সাত্তার মিনিট, সাত্তার মিনিট হ্যায় তুমহারে পাস…”। আর সবশেষে বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত হওয়ার পর, ছলছল চোখে তেরঙ্গার দিকে তাকিয়ে কবীর খানের বসে পড়ার সেই দৃশ্য, যা দ্রবিভূত করে তোলে দর্শক-মনকে।
চাক দে! ইন্ডিয়া বলিউডের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটিই বলিউডে নির্মিত প্রথম সফল ‘স্পোর্টস ফিল্ম’। দেশপ্রেম, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাকেও গুরুত্ব দেয়ার কথা এক সুরে এসে মিলেছে এ সিনেমায়। দর্শক-সমালোচক সবার কাছে সমান আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে সিনেমাটি। আর শাহরুখ ভক্তদের জন্য এটি যে সবসময় মনে রাখার মতো একটি সিনেমা তা তো বলাই বাহুল্য।
মাই নেম ইজ খান
কেউ যদি স্বদেশের মোহন কিংবা চাক দে’র কবির খানকে দেখে বলে দেয়, এটিই শাহরুখের ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স, তবে মাই নেম ইজ খান তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। ৯/১১ তে অ্যামেরিকায় সেই ভয়াবহ হামলার রেশ ধরে এলোমেলো হয়ে যায় রিজওয়ান খান এবং মন্দিরার সাজানো সংসার। সেই হামলার ফলে সামাজিক বিদ্ধেষের শিকার হতে হয় আমেরিকার মুসলিম বাসিন্দাদের। এই অসহিষ্ণুতার জের ধরেই সহপাঠীদের হাতে খুন হয় মন্দিরার ছেলেটি।
অ্যাসপারগাস সিনড্রোমে আক্রান্ত রিজওয়ান খান, যিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীতে কেবল মাত্র দুই ধরনের মানুষ আছে, ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ। দেশজুড়ে এই চরম অসহিষ্ণুতার ফুঁসে ওঠা রিজওয়ান খানকে তাড়িয়ে বেড়ায়, যার নতুন জায়গা, নতুন মানুষের প্রতি আজন্ম ভয় কাজ করে হৃদয়ের ক্ষত তাকে টেনে নিয়ে যায় প্রদেশ থেকে প্রদেশে। কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে রিজওয়ান বেরিয়ে পড়েন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের খোঁজে ।
আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে তিনি কেবল বিশ্ববাসীর কাছে একটি কথাই পৌঁছে দিতে চান, “মাই নেম ইজ খান এন্ড আই অ্যাম নট অ্যা টেররিস্ট”। এ সিনেমাটি দেখে আপনার হয়তো বিশ্বাসই হবে না যে, ছবিটির পরিচালকের নাম, করন জোহর। এ সিনেমাটি করন জোহরকে যেমন নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তেমনি রিজওয়ান খান চরিত্রটি সামনে এনেছে শাহরুখ খানের অভিনয় ক্ষমতাকেও।
দেশে-বিদেশে সিনেমাটি ব্যপক আলোড়ন তুলেছিলো সেসময়। মুসলিমদের প্রতি ঢালাওভাবে জঙ্গি আখ্যার বিরুদ্ধে এটি হয়ে উঠেছিলো অনন্য প্রতিবাদ। এ সিনেমাটি সাধারণ অনেক দর্শকদের পাশাপাশি মুগ্ধ করেছে অনেক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিকেও। আলকেমিস্ট খ্যাত তুমল জনপ্রিয় লেখক পাওলো কোয়েলহো তো বলেছিলেন এমন অভিনয়ের জন্য শাহরুখের অস্কার পাওয়া উচিৎ।
এ তিনটি ছাড়াও ক্যারিয়ারজুড়ে আরো অনেক সিনেমায় শাহরুখ তার অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষ্যর রেখেছেন। খুব সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ফ্যান’ সিনেমটি তার অভিনয় ক্ষমতার আরেকটি উজ্বল দৃষ্টান্ত। তবে দুঃখ কিংবা হতাশার কথা হলো, সেই স্বদেশ, চাকদে কিংবা মাই নেম ইজ খানের শাহরুখের দেখা অনেকদিন ধরেই দর্শকরা পাচ্ছেন না। তার ইদানীংকালের করা সিনেমার গল্পগুলোর সেই সামর্থ্য কই, যে তার ভিতর থেকে সেই অভিনেতা শাহরুখকে বের করে আনবে!
আজ ২ নভেম্বর ২০১৭, এই বিখ্যাত তারকা-অভিনেতার বায়ান্নতম জন্মদিন। জন্মদিনে অনেক শুভকামনার পাশাপাশি তিনি আরো এমন অসাধারণ সব সিনেমা দিয়ে তার দর্শক-ভক্তদের আলোড়িত করবেন সেই প্রত্যাশা রইলো।
ফিচার ইমেজঃ imdb.com