ইন্টারনেট টেলিভিশনের এই সময়ে নেটফ্লিক্স এমন এক পরিবর্তনের নাম যা আমাদের টেলিভিশন দেখবার সনাতনী অভ্যাসকে দিন দিন বদলে দিচ্ছে। সময়ের সাথে কেবল টিভির জায়গাটি ক্রমশ ইন্টারনেট টিভিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। সপ্তাহ শেষের নির্দিষ্ট সময়ে প্রচারিত হওয়া পছন্দের সিরিজের একটা এপিসোডের জন্য অপেক্ষার বদলে সুবিধামত অবসর সময়ে সোফার গদিটিতে বসে হাতের স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপে পছন্দের কোনো শো দেখাই মানুষের এখন বেশি পছন্দ। নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারীদের ঠিক এমন সুবিধা দিয়ে থাকে বলে দিনকে দিন স্ট্রিমিং পরিসেবার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছেই। নেটফ্লিক্স এখন হালের এক ক্রেজ, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
নেটফ্লিক্স পরিসেবাটি মূলত বিভিন্ন ভাষার নানা ধারার হাজারো টেলিভিশন শো এবং সিনেমা নিয়ে সাজানো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইন এই ভিডিও স্ট্রিমিং পরিসেবার বেশ কিছু টেলিভিশন শো দর্শকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আজকের লেখাটি নেটফ্লিক্সের আসন্ন কিছু সিরিজ এবং সিনেমা দিয়ে সাজানো হয়েছে। উল্লেখ্য, নেটফ্লিক্সে আসছে নতুন সিনেমা এবং সিরিজগুলোর মধ্য থেকে দর্শক আগ্রহের উপর ভিত্তি করে লেখাটি সাজানো হয়েছে।
এক্সট্রেমলি উইকেড, শকিংলি ইভিল অ্যান্ড ভাইল (Extremely Wicked, Shockingly Evil and Vile)
বাস্তব জীবনে সত্যিকারের সিরিয়াল কিলার টেড বান্ডির ভয়ঙ্কর জীবনগাঁথা নিয়ে চলতি বছরেই নেটফ্লিক্সের পর্দায় ‘এক্সট্রেমলি উইকেড, শকিংলি ইভিল অ্যান্ড ভাইল’ সিনেমাটি আসতে চলেছে। টেড বান্ডি এমন একজন ঘৃণিত সিরিয়াল কিলার যে কি না তার জীবদ্দশায় প্রায় ৩০ জন মহিলাকে ধর্ষণ এবং হত্যা করে। ঘৃণিত এই অপরাধের শিকার হওয়া সবার বয়স ত্রিশ থেকে সত্তরের মধ্যে ছিল। টেডের চরিত্রে অনবদ্য অভিনেতা জ্যাক এফ্রন অভিনয় করছেন। সিনেমাটিতে পরিচালক জো বারলিংগার সিরিয়াল কিলার টেডের জীবনের মনস্তাত্ত্বিক কিছু বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। একজন ঘৃণ্য সিরিয়াল কিলার হওয়ার যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও টেড কিভাবে তার বান্ধবি লিলির চোখে ভাল মানুষের রূপটি বজায় রাখে, এটি নিয়েই মূলত সিনেমাটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে।
‘এক্সট্রেমলি উইকেড, শকিংলি ইভিল অ্যান্ড ভাইল’ সিনেমাটি বর্তমানে নেটফিক্সে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
ঘোস্ট ইন দ্য শেল (Ghost in the Shell)
বিখ্যাত জাপানি অ্যানিম বা অ্যানিমেশন সিনেমা অ্যাপলসিড (Appleseed) এর পরিচালক শিনজি আরামাকি এবং ঘোস্ট ইন দ্য শেল: স্ট্যান্ড আলন কমপ্লেক্স (Ghost in the Shell: Stand Alone Complex) সিনেমার পরিচালক কেঞ্জি কামিয়ামা এবার নেটফ্লিক্সের জন্য নতুন একটি অ্যানিম সিরিজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। অ্যানিমপ্রেমীদের জন্য অবশ্যই এটা আনন্দের এক সংবাদ। ‘ঘোস্ট ইন দ্য শেল: এসএসি-২০৪৫’ (Ghost in the Shell: SAC_2045) নামের নতুন এই নেটফ্লিক্স অরিজিনাল অ্যানিমেটেড সিরিজটি সম্পর্কে খুব একটা তথ্য উন্মোচিত হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, অ্যানিম ধরানার নতুন এই সিরিজে জনপ্রিয় মোটোকো কুসানাগি চরিত্রটি নতুন করে রূপায়িত হতে চলেছে।
সিরিজটি ২০২০ সালে নেটফ্লিক্সের পর্দায় আসতে চলেছে।
কাউবয় বিবপ (Cowboy Bebop)
১৯৯৮ সালের ‘কাউবয় বিবপ’ অ্যানিম সিরিজের স্পাইক স্পিগেল এবং তার দলবল এবার নেটফ্লিক্সের পর্দায় আবারো ফিরে আসতে চলেছে। অ্যাকশন ঘরানার এই সিরিজটি নিয়ে এখনই খুব বেশি কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে মূল সিরিজের পেছনের কারিগর শিনিচিরো ওয়াটানাবি নতুন এই সিরিজে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। মূল সিরিজটির কাহিনী গড়ে উঠেছিল বেখাপ্পা একদল বাউন্টি হান্টারের লোমহর্ষক অ্যাকশনধর্মী কাহিনী নিয়ে। স্বকীয়তা, নয়নোভিরাম অ্যাকশন দৃশ্য এবং পছন্দের বেশ কিছু চরিত্রের জন্য সিরিজটি তখন তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এখন দেখার বিষয়, নেটফ্লিক্সের নতুন এই সিরিজ কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে। তবে যথেষ্ট আশাবাদী হওয়াই যায়। কেননা, প্রজেক্টটিতে লেখক হিসেবে থর র্যাগনারক সিনেমাখ্যাত ক্রিসটোফার এল. ইওস্ট যুক্ত রয়েছেন। জস অ্যাপেলব্যাম, আন্দ্রে নামে, জেফ পিঙ্কনার এবং স্কট রজেনবারগ সিরিজটি লেখার কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
সিরিজটির মুক্তির তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল: এজ অব রেজিস্ট্যান্স (The Dark Crystal: Age of Resistance)
জিম হেনসনের ক্লাসিক ফ্যামিলি সিনেমা ‘দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল’ নামটি অনেকেরই ভোলার কথা নয়। নেটফ্লিক্সের পর্দায় এবার ডার্ক ক্রিস্টাল নতুন করে ফিরে আসছে। তবে ঠিক মুভি নয়, ‘দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল: এজ অব রেজিস্ট্যান্স‘ নামের সিরিজ হয়ে নেটফ্লিক্সের পর্দায় এটি ফিরে আসছে। প্রজেক্টিতে মূল সিনেমায় ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত সিজিআই পরিহার করে হেনসনের মূল পরিকল্পনানুসারে পাপেটের দিকটি বেশি প্রাধান্য পাবে।
নেটফ্লিক্স অরিজিনাল সিরিজটির টিজার সম্প্রতি প্রকাশিত হলেও ঠিক কবে নেটফ্লিক্সের পর্দায় এটি দেখতে পাওয়া যাবে, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেই।
য়ু অ্যাসাসিন্স (Wu Assassins)
মার্শাল আর্ট নির্ভর ইন্দোনেশিয়া ভিত্তিক ‘দ্য রেইড’ সিনেমা সিরিজটির ভক্ত কে কে আছেন? বর্তমান সময়ের অ্যাকশন সিনেমার অন্যতম তারকা ইকো উয়াইসের কথা বলছি। অত্যন্ত জনপ্রিয় রেইড সিনেমা সিরিজটিতে অভিনয়ের পরে ইকো হলিউডের স্বনামধন্য অভিনেতা মার্ক ওয়ালবার্গের সাথে ‘মাইল ২২’ সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন। সম্প্রতি ইকো নেটফ্লিক্সের সাথে ‘য়ু আসাসিন্স‘ নামের একটি অ্যাকশনধর্মী সিরিজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। দশ পর্বের সিরিজটিতে ইকোকে একজন ছদ্মবেশী অ্যাসাসিন হিসেবে দেখতে পাওয়া যাবে। সান ফ্রান্সিস্কোর চায়না টাউনের অপরাধ জগত নিয়ে সিরিজটির কাহিনী বেড়ে হয়েছে। মজার বিষয়টি হচ্ছে, অভিনয়ের পাশাপাশি ইকো এই সিরিজে প্রধান ফাইট কোরিওগ্রাফার এবং স্টান্ট কোঅর্ডিনেটর হিসেবেও কাজ করছেন। কাজেই নেটফ্লিক্স সিরিজটিতে ইকোর স্বভাবসুলভ দারুন সব একশন দৃশ্যের ছড়াছড়ি থাকছে- এমন আশা করাই যায়। ইকোর পাশাপাশি সিরিজটিতে নেটফ্লিক্সের আরেক সিরিজ ‘অল্টার্ড কার্বন’ খ্যাত অভিনেতা বাইরন ম্যান অভিনয় করছেন।
সিরিজটি মুক্তির তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
দ্য আইরিশম্যান (The Irishman)
হলিউডের পরিচালক মার্টিন স্করসিস তার ক্লাসিক গ্যাংস্টার ঘরানার সিনেমাগুলোর জন্য সুবিদিত। তিনি এবার নেটফ্লিক্সের সাথে একত্রিত হয়ে ‘দ্য আইরিশম্যান‘ নামের একটি গ্যাংস্টার সিনেমা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। রবার্ট ডি নিরো, জোপেসি, হারভি কেইটেল এবং আল প্যাচিনোর মতো গুণী অভিনেতারা সিনেমাটিতে অভিনয় করছেন। কালজয়ী অভিনেতা আল পাচিনোর সাথে স্করসিসের এটাই প্রথম প্রজেক্ট। চার্লস ব্রান্ডটের একটি বেস্ট সেলিং বইয়ের কাহিনী নিয়ে সিনেমার চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে। জিমি হোফা নামক এক ব্যক্তির খুন এবং ফলশ্রুতিতে আইরিশম্যানের এক অপরাধী দলের গ্যাংস্টারের পিছু নেওয়া নিয়ে বইটির কাহিনী গড়ে উঠেছে। আশা করা যায়, স্বনামধন্য অভিনেতাদের অভিনীত এই ক্লাসিক গ্যাংস্টার সিনেমাটি ভক্তদের জন্য দারুন একটি মনের খোরাক হতে চলেছে।
‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমাটি ২০১৯ সালেই নেটফ্লিক্সের পর্দায় আসতে চলেছে।
নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা
নেটফ্লিক্স এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ইন্টারনেট টেলিভিশন’ পরিসেবা। ২০১১ সালে এই পরিসেবার ব্যবহারকারী ছিল ২৩ মিলিয়ন। দ্রুততম সময়ে ২০১৮ সালের শেষে এই পরিসেবার ব্যবহারকারী ১৩০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়েছে। এক সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যানুসারে, পৃথিবীর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রায় ৩৭ শতাংশ আজ নেটফ্লিক্স ব্যবহার করে থাকেন। একসময় বছরান্তে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ ঘরে তোলা প্রতিষ্ঠানটির আজকের বার্ষিক লাভের পরিমাণ অন্ততপক্ষে ১১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই ধরনের অন্যান্য পরিসেবা থেকে যে জায়গাটিতে নেটফ্লিক্স সবার থেকে এগিয়ে আছে তা হচ্ছে, নেটফ্লিক্সে সিনেমা এবং সিরিজের বৈচিত্র্য। ২০১৭ সালেই পরিসেবাটি অন্ততপক্ষে ৩০০টি অরিজিনাল কন্টেন্ট দর্শকদের সামনে নিয়ে এসেছে এবং স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে ২৩তম অ্যামি অ্যাওয়ার্ডে ‘প্রাইমটাইম’ পুরস্কারটি নিজেদের করে নিয়েছে।