মিনহাজ সিরাজকে নিয়ে রচিত প্রথম পর্বে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি তাঁর লেখনীর ভঙ্গিমার ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়েছে। এই পর্বে তাঁর তেইশ খণ্ডে রচিত সুদীর্ঘ গ্রন্থ তাবাকাত ই নাসিরি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
রজেন্থাল তাবাকাত ই নাসিরিকে বংশভিত্তিক ইতিহাসচর্চার (Dynastic historiography) গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এখানে একেকটি বংশ ভিন্ন ভিন্ন সেকশন অধ্যায়ে (tabaqa) আলোচিত। অধ্যায় শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট বংশের ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে এবং শেষ হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে এ বংশের বিদায় নেয়ার মধ্য দিয়ে। অধ্যায়ের রয়েছে অনেকগুলো উপ-অধ্যায়। এ উপ-অধ্যায়গুলো শুরু হয়েছে শাসকের ক্ষমতারোহণ আর শেষ হয় তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে।
তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থটি তেইশটি অধ্যায়ে (তাবাকাত) বিন্যস্ত।
- প্রথম অধ্যায়ে পূর্ববর্তী নবী, রাসূল ও বিভিন্ন গোত্র, সমাজপতি, ইসা (আ.), ইসমাইল (আ.) এবং মুহম্মদ (সা) এর পূর্ব-পুরুষ ও তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত নবী-জীবনীর উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
- দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত বিষয়বস্তু হলো খুলাফা-ই-রাশিদুন, আলীর (রা) বংশধর এবং আশারাই মুবাশশিরা (দশ সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি)।
- বনু উমাইয়া বিষয়ক আলোচনা রয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে।
- ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসি বংশ উৎখাত পর্যন্ত আব্বাসি বংশের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে।
- পঞ্চম অধ্যায়ে পারস্যের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এখানে রয়েছে পেশদাদিয়ান, কাইনিয়, আশকানিয়, সাসানীয় এবং সম্রাট নওশিরওয়ান থেকে ইয়াজদিজার্দ পর্যন্ত কাশিরাদের ইতিহাস।
- ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে হারিসুর রইস থেকে বাদান পর্যন্ত যারা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন সেসকল ইয়ামেনি রাজাদের ইতিহাস।
- তাহিরজুল ইয়ামনাইন থেকে মুহম্মদ বিন তাহির পর্যন্ত তাহিরিদের ইতিহাস রয়েছে সপ্তম অধ্যায়ে। উল্লেখ্য, ৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ইয়াকুব লাইস তাহিরিদের পরাজিত করেন।
- ইয়াকুব লাইস প্রতিষ্ঠিত সাফফারিদের ইতিহাস লিখিত হয়েছে অষ্টম অধ্যায়ে। ৯০১ খ্রিস্টাব্দে আমির উল লাইস এর মৃত্যু পর্যন্ত ইতিহাস এ অধ্যায় বিবৃত হয়েছে।
- সামানিদের উৎপত্তি থেকে ৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ আবদুল মালিক বিন নুহকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে উযজন্দে প্রেরণ পর্যন্ত আলোচনা রয়েছে নবম অধ্যায়ে।
- উৎপত্তি থেকে শুরু করে আবুল ফাওয়ারিস শরফউদ্দৌলা পর্যন্ত বুওয়াহিদদের ইতিহাস রয়েছে দশম অধ্যায়ে।
- একাদশ অধ্যায়ে রয়েছে সবুক্তিগীন থেকে ১২০১ খ্রিস্টাব্দে খসরু মালিকের মৃত্যু পর্যন্ত গজনিদের ইতিহাস।
- দ্বাদশ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় হলো উৎপত্তি থেকে ৫৫২ হি./১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সঞ্জরের মৃত্যু পর্যন্ত পারস্যের সেলজুকদের ইতিহাস। এখানে অন্যান্যের মধ্যে রয়েছে রুকনুদ্দিন খলজি আরসালান শাসন পর্যন্ত ইরাকের সেলজুকদের ইতিহাস, তুঘরিল বিন তুঘরিলের বিবরণ, খাওরিজম সম্রাট তাকাশ কর্তৃক ইরাক জয় প্রভৃতি।
- ত্রয়োদশ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় সাঞ্জারিয়া রাজণ্যবর্গের ইতিহাস অর্থাৎ আতাবাক আলপ্তগীন থেকে আতাবাক আবু বকর বিন মুহম্মদ পর্যন্ত ইরাক ও আজারবাইজানের আতাবাক, ফারসের আতাবাক, এবং খাওয়ারিজমশাহ তাকাশ কর্তৃক সঞ্জর শাহ বিন তুঘান শাহ এর পরাস্ত পর্যন্ত নিশাপুরের রাজাদের ইতিহাস।
- নিমরুজ ও সিজিস্তানের রাজাদের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে চতুর্দশ অধ্যায়ে। এখানে তাহির বিন মুহম্মদ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের হাতে নিহত তাজউদ্দিন নিয়ালতিগিন খাওয়ারিজমি পর্যন্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
- পঞ্চদশ অধ্যায়ে রয়েছে কুর্দি সুলতানদের ইতিহাস। এখানে সিরিয়ার আতাবাক, নূরউদ্দিন জঙ্গি ও মালিক উস সালিহ এবং আয়ুব থেকে শুরু করে বিন মালিকুল কামিলের মৃত্যু পর্যন্ত মিশরীয় আইয়ুবীদের ইতিহাস সন্নিবেশিত।
- উৎপত্তি থেকে ৬২৯ হিজরি/১২৩১ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দিন মানকবরনির মৃত্যু পর্যন্ত খাওয়ারিজমদের ইতিহাস রয়েছে ষোড়শ অধ্যায়ে।
- শানসাবানীয় ঘুর সুলতানদের ইতিহাস বিবৃত সপ্তদশ অধ্যায়ে। এ শাসক পরিবারের উৎস থেকে এ বংশের বাইশতম ও সর্বশেষ শাসক আলাউদ্দিন মুহম্মদ বিন আবু আলী যিনি ৬১২ হি./১২১৫ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ খাওয়ারিজম শাহর কাছে ফিরুজকোহ শহর সমর্পণ করেছিলেন, সে পর্যন্ত ইতিহাস আলোচিত হয়েছে এ অধ্যায়ে।
- বামিয়ান ও তুখারিস্তানের শানসাবানিয়া শাসকদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে অষ্টাদশ অধ্যায়ে। এ ধারার প্রথম শাসক ফখরুদ্দিন মাসুদ থেকে শুরু করে তায় ভাইপো জালালুদ্দিন আলীর হাতে নিহত শাসক আলাউদ্দিন মাসুদ পর্যন্ত ইতিহাস এ অধ্যায়ের বর্ণিত বিষয়।
- উনবিংশ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় হলো গজনির শানসাবানীয় সুলতানদের ইতিহাস। ৩০৩ হি./১২০৬ খ্রিস্টাব্দে গজনি থেকে তাজউদ্দিন ইয়ালদোজকে বহিষ্কারকারী কুতুব উদ্দিন আইবাক পর্যন্ত ইতিহাস এখানে বিবৃত হয়েছে।
- ভারতীয় মুইজিয়া সুলতানদের ইতিহাস উপস্থাপিত হয়েছে গ্রন্থটির বিংশ অধ্যায়ে। এখানে রাজধানী দিল্লির কুতুব উদ্দিন আইবাক ও তাঁর পুত্র আরামশাহ, নাসির উদ্দিন কুবাচা আল মুইজি ও বাহাউদ্দিন তুঘরিল আল মুইজি এবং লক্ষ্মণাবতী বা গৌড়ের চারজন খলজি শাসকের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটেছে ৬৩৪ হি./১২২৬ খ্রিস্টাব্দে বিহারের শাসক নাসির উদ্দিন মাহমুদ বিন শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের হাতে পরাজিত ও নিহত মালিক হুশামউদ্দিন এর ইতিহাস পরিবেশনার মাধ্যমে।
- দিল্লির শামসি সুলতানদের ইতিহাস বর্ণনা হলো একবিংশ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়। এখানে ৬০৭ হি./১২১০ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ কর্তৃক আরামশাহর সিংহাসনচ্যুতির ঘটনা থেকে ৬৫৮ হি./১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে এ বংশের সপ্তম সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকাল পর্যন্ত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে।
- দ্বাবিংশ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ৬২৫ হি./১২২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে গ্রন্থকারের সময়কাল পর্যন্ত শামসি বংশের সবচেয়ে বিশিষ্ট অভিজাত ও শাসকদের পরিচয় প্রদান। সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর তাঁর উজির বাহাউদ্দিন উলুঘ খান বলবনের সিংহাসনারোহন ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে এ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
- সর্বশেষের ত্রিবিংশ অধ্যায়ে রয়েছে মোঙ্গল অনুপ্রবেশের ইতিহাস। কারাখিতা গোত্রগুলোর সাথে সুলতান সনজর সলজুকির যুদ্ধবিগ্রহ, মুহম্মদ খাওয়ারিজম শাহর তুর্কিস্তান জয়, ৬০৭ হি./১২১০ খ্রিস্টাব্দে কারাখিতার ঘুরখানের পরাজয় ও মৃত্যু, চেঙ্গিস খান ও তার বংশধর জুজি খান, উগতাই খান, চাগতাই খান, কুদিক খান, বাটু খান, মঙ্গু খান, হালাকু খান ও বারাকাহ খান পর্যন্ত এ অধ্যায়ের আলোচিত বিষয়। এখানে মূলত ৬৫৮ হি./১২৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তথ্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ইতিবৃত্তটির পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে।
প্রত্যেক উপ-অধ্যায়ের শেষে মিনহাজ শাসকের নিজস্ব মূল্যায়ন করেছেন। তবে এসব মন্তব্য ভাসা-ভাসা (perfumetory) এবং সেসব সাধারণত ব্যক্তিগত গুণপনা সম্বন্ধীয়। সকল সুলতানের জন্যই তিনি সৌজন্যমূলক শব্দমালা ব্যবহার করেছেন। এটি শাসক বা ব্যক্তি মূল্যায়নের যথাযথ রীতি নয়। ইতিবৃত্তকার মূলত ইসলাম ধর্মীয় ও মুসলিম শাসক সংক্রান্ত আলোচনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। সমসাময়িক অন্যান্য বিষয়াবলি তাঁর লেখায় সবিশেষ গুরুত্ব পায়নি। তাই আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের মাপকাঠিতে গ্রন্থটিতে একপার্শ্বিক ইতিহাস-দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। সর্বাত্মক ইতিহাস লেখার বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি রয়েছে।
এসব বিবেচনায় গ্রন্থটি কখনো কখনো শুধুমাত্র মুসলিম ইতিহাসের তথ্যবহুল সংক্ষিপ্ত বিবরণী (compendium of Muslim history) হিসেবে গণ্য। ইতিবৃত্তটি ভারতে তুলনামূলক কম পরিচিত। প্রথমে লক্ষ্ণৌতে এর দুয়েকটি কপির সন্ধান মেলে। তবে ইউরোপে এটি দুষ্প্রাপ্য নয়। মেজর লিজের তত্ত্বাবধানে বিবলিওথিকা ইন্ডিকা গ্রন্থটির ৪৫০ পৃষ্ঠার ভারতীয় অংশ প্রথম ছাপায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে। এতে রয়েছে ইতিবৃত্তটির ১১ তম এবং ১৭-২২ তম তাবাকাত। এ অংশগুলো প্রাথমিক মুসলিমদের বিষয়ে ইতিহাস-তথ্য সরবরাহ করে। মস্কোর সেন্ট পিটার্সবার্গ ইম্পেরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি এবং লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে এ মূল্যবান গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত।
র্যাভার্টি কর্তৃক এ গ্রন্থটির দু’খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদ ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। আব্দুল হাই হাবিবের সম্পাদনায় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুল থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মূল ফারসি সংস্করণ আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিসহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যায়। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ আ. ক. ম. যাকারিয়া কর্তৃক গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
ভারত ও ইউরোপে তাবাকাত-ই-নাসিরির গুরুত্ব অসাধারণ। ফিরিস্তা ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ এ ইতিবৃত্তটিকে উচ্চ প্রামাণিকতার অসাধারণ গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেন। আঙ্কুয়েতিল দ্যু পেরন একে একটি মূল্যবান গ্রন্থ এবং মাউন্ট স্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন ‘সর্বোচ্চ খ্যাতিসম্পন্ন (highest celebrity) গ্রন্থ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। চার্লস স্টুয়ার্ট এ ইতিবৃত্তকে ‘খুব মূল্যবান বই (very valuable book)’ হিসেবে গণ্য করে তার History of Bengal (১৮১৩ খ্রি.) গ্রন্থে এর যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন।
সবদিক বিবেচনায় ভারতের মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস রচনায় তাবাকাত-ই-নাসিরি ইতিবৃত্তটি একটি আকড় গ্রন্থ। এর সাথে সম্পূরক হিসেবে হাসান নিজামির তাজুল মাসির এবং সমসাময়িক কতিপয় মুদ্রায় উৎকীর্ণ তথ্যাদির আলোকে দিল্লি ও বাংলার লক্ষ্মণাবতীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন সম্ভব। রাজনৈতিক ঘটনাক্রম বর্ণনার মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে সমসাময়িক সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতির পরিচয়ও এ গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসই নয়, সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ইতিহাস বিনির্মাণেও তাবাকাত-ই-নাসিরির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।