রাজনীতিবিদগণ যে মিথ্যা কথা বলে থাকেন, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে থাকেন বা কথার মারপ্যাঁচে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে থাকেন- এ কথা প্রায় সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা বলা ও ভাষার সুকৌশল ব্যবহারজনিত ধোঁকা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে, হয়েছে অসংখ্য কৌতুক।
সাধারণত রাজনীতিবিদেরা প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় সুকৌশলে এমনভাবে উত্তর দেন যাতে তার বা তার দলের স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করলে দেখা যায়, তাদের এমন আচরণ বা জনগণের সাথে প্রায় সময়ই মিথ্যা বলা অনেকটাই যৌক্তিক। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন হয় যে, সত্য প্রকাশ করলে হয়তো সেই রাজনীতিবিদের ভরাডুবি হবে নির্বাচনে এবং এর সুযোগ নিয়ে এগিয়ে যাবে তার প্রতিপক্ষ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কি নেতারা পরস্পরের সাথে মিথ্যা বলে থাকেন? এক দেশের নেতা কি অন্য দেশের নেতাকে মিথ্যা বলে ধোঁকা দিয়ে থাকেন? এ ধরনের মিথ্যা তারা বলে থাকলে এদের প্রকৃতি কীরূপ? বা তারা এসব মিথ্যা কি দেশের স্বার্থে বলেন নাকি নিজেদের স্বার্থে? আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতো জায়গায়, যেখানে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে প্রায় সবই স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখানে একজন রাষ্ট্রনেতা তার দেশের স্বার্থে অন্য দেশের নেতাদের সাথে মিথ্যা বললে আমরা সেই মিথ্যাকে কিভাবে বিবেচনা করবো?
এই প্রশ্নগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যাদের ভূ-রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আগ্রহ আছে তাদের জন্য তো জানা অবশ্য দরকারি। এসব প্রশ্ন করেছেন এবং তাদের নিয়ে লিখেছেন পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট জন জে. মার্শহেইমার তার বই হোয়াই লিডার’স লাই’তে। তিনি রাষ্ট্রনেতাদের মিথ্যা বলা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখতে পান যে, এ ব্যাপারে একাডেমিক কাজ খুবই কম। মার্শহেইমারের মতে, তার বইটি হলো এই বিষয়ে বিশদ গবেষণার শুরুমাত্র।
বইয়ে সাধারণত মিথ্যা বলতে কী বোঝায় ও মিথ্যার সাধারণ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছ। অনেক ধরনের মিথ্যাই আছে, বিশেষত ধোঁকা দেয়ার জন্য। ধোঁকা দেয়ার জন্য এমন কোনো কথা বলা যা আসলে সঠিক নয়, বা সত্যের কোনো অংশ প্রকাশ এবং অন্য অংশ গোপন করে ধোঁকা দেয়া ইত্যাদি সহ নানা প্রকারের মিথ্যা আছে। মিথ্যা কী তা দার্শনিকভাবে অবশ্য আরো একটু জটিল। মার্শহেইমার সেদিকে যান নি। কারণ তার লক্ষ্য ছিল মিথ্যার প্রাথমিক আলোচনা শেষে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মিথ্যার ধরন নিয়ে একটা আলোচনা উপস্থাপন করা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোটামুটি পাঁচ প্রকারের মিথ্যা রাষ্ট্রনেতারা বলে থাকেন বলে চিহ্নিত করেছেন মার্শহেইমার। এগুলো তারা নিজেদের স্বার্থে, নিজের দেশের জনগণের সাথে ও বাইরের দেশের নেতাদের সাথে বা আন্তর্জাতিক মহলে বলে থাকেন।
১. দুই দেশের মধ্যকার মিথ্যা
কোনো কৌশলগত সুবিধা পাবার জন্য কোনো দেশের রাষ্ট্রনেতা অন্য দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সাথে মিথ্যা বলে থাকেন। এ ধরনের মিথ্যা হয় সরাসরি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অথবা অন্য দেশের জনগণকে উদ্দেশ্য করেও এই মিথ্যা বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের মিথ্যায় নিজেদের সামরিক শক্তি বেশি আছে, এ ধরনের কথা বলা হয় সাধারণত। যেমন উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রনেতা কিম জং উন তার দেশের সামরিক শক্তি নিয়ে এ ধরনের মিথ্যা অহরহই বলে থাকেন। ইসরায়েল ১৯৬০ সালে এই ধরনের মিথ্যা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তারা গোপনে পারমাণবিক প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল যুক্তরাষ্ট্র জানলে তা বন্ধ করার জন্য চাপ দিবে। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিল এ ধরনের কোনো প্রোগ্রাম তারা চালাচ্ছে না। এ মিথ্যার মাধ্যমে সফলভাবেই তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছে।
এ ধরনের মিথ্যার আরো উদাহরণ রয়েছে। যেমন আমেরিকা-রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিকিতা ক্রুশ্চেভ রাশিয়ান আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলের আধিক্য ও ক্ষমতা নিয়ে মিথ্যা বলতেন, যাতে এই ভয়ে আমেরিকা প্রথমেই আক্রমণ না করে। আবার গ্রীস তার বাজেট ঘাটতি নিয়ে মিথ্যা বলেছিল, যাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকতে পারে।
মার্শহেইমারের মতে, এ ধরনের মিথ্যা খুবই কম হয়। কারণ রাষ্ট্রনেতারা পরস্পরের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাধারণত মিথ্যা বলেন না। আবার মিথ্যা বললেই যে লোকে বিশ্বাস করবে এমনও নয়।
২. ভীতি তৈরি করা
ফিয়ারমঙ্গারিং এর অর্থ হলো ভীতি তৈরী করা। যখন কোনো রাষ্ট্রনেতা তার দেশের জনগণকে বাইরের কোনো হুমকি বোঝাতে না পারেন, তখন তিনি ভীতি তৈরী করে তাদেরকে সেই হুমকি বোঝানোর চেষ্টা করেন। মার্শহেইমারের মতে, এ ধরনের মিথ্যা খুবই কার্যকরী। এর মাধ্যমে জনগণকে ভয় দেখিয়ে বাইরের কোনো রাষ্ট্রে আগ্রাসন বা অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে প্রশাসন। ভয় পাওয়া জনগণ তখন এতে সায় দেয়। তার মতে, জনগণের ভালোর জন্যই অনেক সময় রাষ্ট্রনেতা এমন কাজ করতে পারেন। তবে বাস্তবিকভাবে এর অনেক অপব্যবহার হয়ে থাকে।
মার্শহেইমার কৌশলগত কারণে আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। বুশ প্রশাসন ইরাকে মানব বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, আল-কায়েদার সাথে সাদ্দাম হোসেনের যোগসাজশ আছে বা নাইন ইলেভেন হামলায় ইরাকের হাত আছে ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে আমেরিকার জনগণের মধ্যে ভীতি তৈরী করেছিল ইরাক আগ্রাসনে সমর্থন তৈরীর জন্য।
৩. স্ট্র্যাটেজিক কভার আপ
এ ধরনের মিথ্যাকে মার্শহেইমার বলেন নোবল লাই বা মহান মিথ্যা! কারণ তার মতে দুই দেশের বিপদজনক বিরোধ কমাতে এ মিথ্যা পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। সাধারণত কোনো গৃহীত নীতি বা পদ্ধতি যখন ব্যর্থ হয় তখন তা ধামাচাপা দিতে রাষ্ট্রনেতারা এ প্রকারের মিথ্যার আশ্রয় নেন। কেনেডি প্রশাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করেছিল যে, আমেরিকা তুরস্ক থেকে মিসাইল সরিয়ে নেবে এবং সোভিয়েত সরাবে কিউবা থেকে। কিন্তু এ চুক্তির ব্যাপারে মিথ্যা বলেন কেনেডি। তিনি বলেন, এরকম কোনো চুক্তি হয় নি।
কোনো সত্য প্রকাশিত হলে শৃঙ্খলাহানি হবে, রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে এমন হলে এরকম ধামাচাপা দেয়া হয়ে থাকে বৃহত্তর স্বার্থে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় একজন ফ্রেঞ্চ জেনারেল ছিলেন একেবারেই অযোগ্য। কিন্তু তার এই অযোগ্যতার ব্যাপারটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। কারণ প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী ও জনগণের মনোবল ভেঙে যেতে পারে, এই ভয়ে।
৪. ন্যাশনালিস্ট মিথমেকিং
এ ধরনের মিথ্যা বলা হয়ে থাকে নিজেদের জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস জন্মানোর জন্য, রাষ্ট্রের মধ্যে বৃহত্তর পরিসরে ঐক্য তৈরী করার জন্য। যেমন, ফ্রান্সের ছাত্রছাত্রীরা তাদের ইতিহাস বইয়ে তাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠত্বের কথা পড়ে। আমেরিকায় জাতির পিতা যারা আছেন তাদেরকে একরকম মানব দেবতা রূপে দেখানো হয়ে থাকে। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্নভাবে দেখানো হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন বাদ দিয়ে এমনভাবে দেখানো হয় যে, ছাত্রছাত্রীদের মাথায় গেঁথে যায় পাকিস্তান আসলে ঐ সময় ঠিক কাজই করেছে।
নিজেদের গর্বের ইতিহাস নিয়ে এখন কেবল পাঠ্যপুস্তক নয়, টিভি সিরিয়াল এবং ফিল্মেও কাজ করা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এরকম কাজ ন্যাশনাল মিথমেকিং বা জাতীয়তাবাদী কল্পবিস্তারের মিথ্যার মধ্যে পড়ে। যেমন বর্তমানে বিজেপি শাসিত ভারতে ও এরদোয়ান শাসিত তুরস্কে এ ধরনের টিভি সিরিয়াল ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী কল্পবিস্তার দেখা যায়।
৫. লিবারেল লাইজ
মাঝে মাঝে বিশ্ব সমাজে, রাজনীতিতে ও দেশে প্রচলিত উদার রীতিনীতির বিরুদ্ধে যেতে হয় কোনো কোনো রাষ্ট্রকে। অন্য একটি রাষ্ট্রের প্রতি প্রচলিত উদারনীতির বাইরে গিয়ে অন্যায় আচরণ করতে হয় বা অন্য দেশের সাথে বা নিজের দেশের মধ্যে অন্যায় করছে এমন কোনো রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতায় যেতে হয়। এসব ক্ষেত্রে নিজের কাজের ন্যায্যতা দানের জন্য রাষ্ট্রনেতারা গল্প তৈরী করে জনগণকে বা বিশ্ববাসীকে বলেন। ব্যাখ্যা দেন কেন তাকে ঐ কাজ করতে হল। যেমন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করা হয়েছে খুব নির্মমভাবে। পৃথিবীর সব সভ্য নীতির বাইরে গিয়ে তারা এ কাজ করছে। কোনো দেশ যদি মিয়ানমারের সাথে এখন সম্পর্কে যেতে চায় বা তাদের এই অন্যায় কাজ সমর্থন করতে যায়, তাহলে অং সান সুচি বা মিয়ানমার প্রশাসন খুব ভালো এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে এমন আচরণ করছে বা আসলে সত্যি সত্যি এমন নির্মম আচরণ হচ্ছে না ইত্যাদি মিথ্যা বলবে নিজেদের জনগণকে।
জন মার্শহেইমার তার বইতে রাষ্ট্রনেতাদের মিথ্যাকে দেখেছেন নিওরিয়ালিস্ট দৃষ্টিতে। তিনি নিজে একজন নিওরিয়ালিস্ট পলিটিক্যাল চিন্তাবিদ। অর্থাৎ বাস্তবতার সাপেক্ষে তিনি যেকোনো কাজকে বিবেচনা করেন। নৈতিকভাবে মিথ্যা খারাপ না ভালো সেদিকে তিনি তাই যান নি। তার কথা হলো, ভূ-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি খুব নির্মম একটি জায়গা এবং এখানে স্ট্যাটেজিক মিথ্যা রাষ্ট্রনেতাদের জন্য রাষ্ট্রচালনার এক উপকারী হাতিয়ার।
রাষ্ট্রনেতাদের মিথ্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মার্শহেইমার দেখেছেন, যেভাবে সাধারণ মানুষজন ভাবে নেতারা সব সময় মিথ্যাই বলে যান, ঘটনা আসলে এমন নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মিথ্যা খুব কমই হয়। এমনকি নেতারা নিজেদের জনগণের সাথে মিথ্যা বলছেন, এমন উদাহরণও মার্শহেইমার বেশি দেখেন নি বলে জানিয়েছেন। তবে তার মতে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতারা জনগণের সাথে বেশি মিথ্যা বলে থাকেন অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় থাকা নেতাদের চাইতে।
মার্শহেইমারের রাষ্ট্রনেতাদের মিথ্যা বলা নিয়ে এসব চিন্তাভাবনা রাষ্ট্রনেতাদের মিথ্যা ও এর কার্যকারণ বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে, বিশেষত আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে।
ফিচার ইমেজ: thedailybeast.com