আশির দশকে আমেরিকান পরিচালক জন হিউজের নির্মিত সিনেমাগুলো কিশোর এবং তরুণদের চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ, জীবনপ্রণালি ইত্যাদিকে রূপালী পর্দায় তুলে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার অধিকাংশ চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট শিকাগোর মেট্রোপলিটন এলাকা। জাদু বাস্তবতা এবং শহুরে কিশোর জীবনের বাস্তবিক চিত্রায়ণের মিশ্রণে নির্মিত কামিং-অফ-এইজ সিনেমার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ।
হিউজ নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘সিক্সটিন ক্যান্ডেলস’ (১৯৮৪), ‘উইয়ার্ড সায়েন্স’ (১৯৮৫), ‘দ্য ব্রেকফাস্ট ক্লাব’ (১৯৮৫), ‘ফেরিস বুয়েলার’স ডে অফ’ (১৯৮৬) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সময়ের সাথে তার এই সিনেমাগুলো অর্জন করেছে ক্লাসিকের সম্মান, কেননা বর্তমানের কিশোর-তরুণরাও এগুলোর সাথে নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পায়। আর আশি বা নব্বইয়ের দশকে যারা কৈশোর-তারুণ্য পার করেছেন; তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। হিউজের সৃষ্টি মিশে গেছে তাদের জীবনের সাথে।
ব্যঙ্গাত্মক রসবোধ আর অম্লমধুর গল্পের সমন্বয়ে নির্মিত ‘দ্য এজ অভ সেভেন্টিন’ হিউজের রেখে যাওয়া সে ঐতিহ্যের যোগ্য উত্তরসূরী। এই ফিচার ফিল্মটির মাধ্যমেই পরিচালনায় অভিষেক ঘটল লেখক ও পরিচালক কেলি ফ্রিমন ক্রেইগের। এতে তিনি টিনেজ ড্র্যামেডি জনরায় মুখ্যতম বলে বিষয়গুলো তুলে এনেছেন নিপুণতার সঙ্গে। যেমন, নিজেকে ও নিজের জীবনের ঘটমান বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, আশেপাশের মানুষের সাথে মানিয়ে চলতে না পারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, স্বকীয়তা বজায় রাখার প্রচেষ্টা বা সকলের মাঝে নিজের একটা আলাদা পরিচয় বা ভাবমূর্তি সৃষ্টির সংগ্রাম ইত্যাদি। মোটকথা, স্কুল বা কলেজের মতো প্রেশার কুকার সদৃশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিশোর এবং তরুণদেরকে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ভেতর দিনাতিপাত করতে হয়; তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে।
তবে ‘দ্য এজ অভ সেভেন্টিন’ হিউজের সিনেমাগুলোর তুলনায় অনেকটা ডার্কার এবং বেশি বাস্তবসম্মত। এখনকার দর্শকদের উপযোগী করে এখানকার চরিত্রগুলোকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ফলে, তারা পর্দার চরিত্রগুলোর সাথে নিজেদের মিল খুঁজে পাবে। আর ফ্রিমন যে হিউজের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত, সেটির আভাস পাওয়া যাবে গোটা সিনেমা জুড়েই।
বলতে গেলে, ‘দ্য এজ অফ সেভেন্টিন’ সিনেমায় দর্শককে পুলকিত করার সকল উপকরণ রয়েছে। বিশেষ করে যারা টিনেজ ড্র্যামেডি বা কামিং-অফ-এইজ ধারার সিনেমা পছন্দ করেন, তাদের এটি ভালো লাগবে। গল্পের মূল চরিত্রের নাম নেডিন। আর এই চরিত্রে হেইলি স্ট্যানফিল্ড তার মেধার দ্যুতি ছড়িয়েছেন পুরোটা সময় জুড়ে। এমনিতেই ক্যারিয়ারের বৃহস্পতিতে আছেন তিনি। ২০১০ সালে কোয়েন ব্রাদার্সের ‘ট্রু গ্রিট’-এ অভিনয় করে অর্জন করেছিলেন অস্কার মনোনয়নের সম্মান।
এছাড়া তিনি পপস্টার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইতোমধ্যে। প্রত্যুৎপন্নমতি, কিন্তু সামাজিক দক্ষতার দিক থেকে অনুজ্জ্বল নেডিন চরিত্রে আরেকবার নিজের বহুমাত্রিক প্রতিভার পরিচয় দিলেন তিনি। আবার মার্ভেল এবং ডিজনি প্লাসের শো ‘হকআই’তেও অভিনয় করবেন গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে।
অন্যান্য মুখ্য চরিত্রের মধ্যে আছে নেডিনের শৈশবের একমাত্র বান্ধবী ক্রিস্টা (হেলি লু রিচার্ডসন); যে হাসিখুশি এবং নেডিনের চেয়ে মিশুক স্বভাবের। আছে নেডিনের আপন বড় ভাই ডেরিয়ান (ব্লেইক জেনার); যে জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল এবং আদর্শ ভাই, পুত্র ও ছাত্রের প্রতীক। ডেরিয়ান এবং নেডিনের বিধবা মা মোনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন কাইরা সেজইউক। স্বামীর মৃত্যুর পর অবসাদগ্রস্ত মোনা নিজের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। ডেরিয়ানের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক থাকলেও; নেডিনকে তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না।
নেডিনের জীবনের প্রত্যেকটি দিন আগের দিনের চেয়ে শোচনীয়। কারণ বয়ঃসন্ধির হরমোন আর বয়সের অপরিপক্কতা কোনো আলোচনায় তার সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে বিবেচিত হওয়ার পথটি রুদ্ধ করে রাখে। এ নিয়ে তার কষ্ট এবং উদ্বেগের শেষ নেই। তার উপর ছোটবেলা থেকেই সে অন্য বাচ্চাদের দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। এ সকল হতাশা কাটানোর এবং তর্কাতর্কি করার একজন যোগ্য সঙ্গী খুঁজে পায় সে। তিনি হলেন ইতিহাসের শিক্ষক মিস্টার ব্রুনার; যে চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন সবার পরিচিত উডি হ্যারেলসন।
মিস্টার ব্রুনার নেডিনের শ্লেষাত্মক রসিকতা বেশ উপভোগই করেন। তবে তার অবাধ্যতা নিয়ে বিচলিত না হলেও, তিনি নিজেও ছেড়ে কথা বলেন না। কড়ায়-গণ্ডায় তাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। তাদের দুজনের মধ্যকার আত্মিক যোগাযোগ এবং এই আকস্মিক কথোপকথনসমূহ মিলে সৃষ্টি হয়েছে সিনেমার সেরা দৃশ্যগুলো।
তার আরেক সুহৃদ হলো মিষ্টভাষী, বুদ্ধিদীপ্ত আরউইন কিম (হেইডেন সিটো)। এদের দু’জনের মাঝে বন্ধুত্ব হওয়ার কথা না, কিন্তু তাও কীভাবে যেন হয়ে যায়। কিছুটা নার্ডি এবং আচার-আচরণে নিপাট ভদ্র কিম নেডিনকে মনে মনে পছন্দ করে, যা সহজেই বুঝে যায় সে। কিমের চরিত্রের মাধ্যমে সিনেমার গল্পে গভীরতা নিয়ে এসেছেন ফ্রিমন। এই চালাক, চতুর এবং সহজাত দক্ষতাসম্পন্ন চরিত্রের মাধ্যমে তিনি এই জনরায় প্রচলিত স্টেরিওটাইপ ভেঙেছেন। আরেকটি এশীয় বংশোদ্ভূত চরিত্র, যেটি সিনেমার শেষে নায়ক এবং হার্টথ্রব উভয় রূপেই আবির্ভূত হয়; তার মাধ্যমে নিজের অনুপ্রেরণা হিউজের ভুল শুধরেছেন তিনি।
এ রকম ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়েছে হিউজের শেষের দিকে কাজগুলোতে; যেখানে অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জাতিগত চরিত্রগুলো উপস্থাপিত হয়েছে ক্যারিকেচারের মতো করে। ‘সিক্সটিন ক্যান্ডেলস’-এর লং দুক ডং চরিত্রটির কার্যকলাপ আরেকবার খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, ফ্রিমন এক্ষেত্রে কী ধরনের প্রাঞ্জলতা নিয়ে এসেছেন।
এবার এ সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে ফ্রিমন যে বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ রেখেছেন, সে ব্যাপারে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমবার যখন নেডিন সাহস করে নিকের সাথে কথা বলতে যায়; তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে ইংলিশ পপ ব্যান্ড স্প্যানডাউ ব্যালের ‘ট্রু’ গানটি বেজে ওঠে। যেটি হিউজের ‘সিক্সটিন ক্যান্ডেলস’-এর প্রতি ট্রিবিউট। নিকের সাথে দেখা করবে, এই বড় উপলক্ষকে সামনে রেখে নেডিন বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে নিজেকে আয়নায় দেখে, এ রকম একটি মন্তাজ আছে সিনেমায়। যেটির দৃশ্যায়নে এ ধারার অন্যান্য সিনেমা থেকে ভিন্নতা দেখা গেছে।
আর নেডিনের কার্যকলাপের ফলে যে বিপর্যয় নেমে আসে তার জীবনে; সেই অংশের চিত্রায়নের ক্ষেত্রে বিষাদময় আবহের সৃষ্টি করেছেন পরিচালক। এটি প্রমাণ করে, পরিচালক ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। কারণ এ ধারার সিংহভাগ সিনেমাতে বর্ণিল সিনেম্যাটোগ্রাফি আর মাদকের ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত আমরা। ‘দ্য এজ অভ সেভেন্টিন’-এর বেশিরভাগ অংশই তেজস্বী এবং প্রাণোচ্ছল; কিন্তু গল্পকে আরো বিষাদময় এবং বাস্তবিক দিকে নিয়ে যেতেও পরিচালক সমভাবে পারদর্শী। সবকিছুকে পরিপাটি এবং প্রীতিকরভাবে গুটিয়ে নিতে হবে, এ কথায় তিনি বিশ্বাসী নন।
একইভাবে, নেডিন চরিত্রটি দর্শকের হৃদয়গ্রাহী হওয়ার কারণ, সে সবসময় প্রীতিকর নয়। সে একের পর এক ভুল করে নিজের কার্যকলাপ নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে। কিন্তু যারা বিরক্ত করে, তাদের সাথে ভালো আচরণ করবে, এতটাও ভালো মানুষ নয় সে। আর মানুষের কাছে থেকে তফাতে চলার সহজাত স্বভাব তো তার আছেই। ঝোঁকের বশে অন্যের সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলে সে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার নিজের কার্যকলাপই তার সর্বনাশের কারণ।
নেডিন চরিত্রের এই পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলোকে সতেজ এবং বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন হেইলি স্টেইনফিল্ড। নারীত্বে পা দেবার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েকে সবার পছন্দ করতে হবে; এমন কোনো মনোভাব নেই তার ভেতর। বরং তিনি চেষ্টা করেছেন, নেডিনের অনুভূতিগুলোকে যতটা সম্ভব বাস্তবভাবে পর্দায় তুলে ধরতে। আর ঠিক এই কারণেই আমরা নেডিনকে আর তার গল্প এবং সংগ্রামকে ভালোবেসে ফেলি।