নোবেল বিজয়ী তুর্কি লেখক ওরহান পামুক সাহিত্য-ভুবনের পরিচিত এবং শক্তিশালী এক নাম। তিনি একজন ওপন্যাসিক, চিত্রনাট্য সম্পাদক এবং শিক্ষক। ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। তবে মূলধারার পাঠকদের কাছে পামুক তার লেখালেখির শুরুর দিক থেকেই পরিচিত। বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই লেখকের বই প্রায় ৬০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অফিসিয়ালি তার বই বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি।
ওরহান পামুকের লেখালেখি শুধু পাঠকের মন জয় করেনি, লেখালেখি করে জয় করেছেন বহু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরষ্কার। বলা হয়ে থাকে তুরস্কের ইতিহাসে জনপ্রিয় লেখকদের মধ্য ওরহান পামুক অন্যতম এবং সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত।
১৯৭৪ সাল থেকে লেখালেখি শুরু করেন ওরহান পামুক। ছাত্রজীবনে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করলেও মাঝপথে তা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতক শেষ করেন। লেখালেখির জীবনের যতগুলো বই লিখেছেন, প্রায় সবগুলোই পেয়েছে তুমুল পাঠকপ্রিয়তা। তবে তার নতুন বই পেতে বরাবরই পাঠকদের অপেক্ষা করতে হয় অনেকদিন, কারণ তিনি বিশ্বাস রাখেন বারবার সম্পাদনায়! একটি উপন্যাস লেখা শেষে পামুক কয়েকবার সেটি সম্পাদনা করেন বলেই পাঠকের অপেক্ষা কখনও কখনও বেশ দীর্ঘ হয়।
ওরহান পামুকের দীর্ঘ পরিসরে লেখা ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসটি সারা বিশ্বে তুমুল আলোচিত এবং প্রশংসিত। বইটি প্রকাশিত হয় লেখকের স্বদেশী ভাষায় ১৯৯৮ সালে। তুরস্কের পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর ইংরেজিতে অনুবাদ হয় ২০০১ সালে। ইংরেজি অনুবাদের পর আসলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লেখক রাতারাতি সাহিত্য-সমালোচকদের চোখে একজন শক্তিশালী লেখক হিসেবে আখ্যায়িত হন। একে একে যখন সারা পৃথিবীতে দাপুটে গতিতে বইটি ছড়িয়ে পড়ে, তারই ধারাবাহিকতায় উপন্যাসটির বাংলায় অনুবাদ হয় ‘আমার নাম লাল’ নামে।
একদম ভিন্নধর্মী বিষয় আর বয়ানের কারণে বইটি খুব দ্রুত তুমুলভাবে আলোচিত হয় বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছেও। সারা বিশ্বে আলোচিত উপন্যাসটি দ্রুতই জিতে নেয় বহু পুরুস্কার। সেই সাথে প্রায় ৬০টি ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়, এবং একথা অস্বীকার করা যাবে না যে ওরহান পামুকের নোবেল বিজয়ের পেছনে ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসের ভূমিকা অনেক। বইটি পাঠকমহল ছাপিয়ে সাহিত্য সমালোচক মহলেও এত আলোচিত হয় যে, তখন থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল পামুক তার এই উপন্যাসের জন্য বেশ বড় কোনো স্বীকৃতিই পেতে যাচ্ছেন। এমনকি সাহিত্য সমালোচকেরা সেই কথা স্পষ্ট করে জানিয়েও দেন। যেমন- মরীন ফ্রীলি ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এ বলেছিলেন,
আজ পর্যন্ত যত বই পড়েছি, এই বইটি সেগুলোর মধ্য সর্বশ্রেষ্ঠ। ইস্তাম্বুলের অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে দ্বন্দ্বই শুধু নয়, সেই শহরের কালজয়ী সৌন্দর্য এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। এটি প্রায় নিখুঁত একটি উপন্যাস, নোবেল পুরষ্কারের উপযুক্ত।
তবে সকল আলোচনা-সমালোচনা-প্রশংসা পাশ কাটিয়ে ওরহান পামুক শুধু লিখে যেতে চান নিজের মতো করে; নিজের পরিবেশে বসে লিখতে চান পুরো পৃথিবীর মানুষের কথা, মানুষের আবেগ-অনুভবের কথা। তিনি আসলে খুব সহজভাবেই মানুষের গভীরতম আবেগ-অনুভবের কথা বলেন, যেমন বলেছিলেন,
সুখ হচ্ছে যখন তুমি কাউকে জড়িয়ে ধরো এবং জানতে পারো তুমি আসলে পুরো পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরেছো!
মাই নেম ইজ রেড (My Name is Red)
‘মাই নেম ইজ রেড’ নিয়ে বলার শুরুতে একজন সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টিতে বইটির মান কেমন তা জেনে নেয়া যাক। এই উপন্যাস সম্পর্কে আভকাট আলটিনেক অবজার্ভারে বলেছিলেন,
অপূর্ব! নকল শিক্ষানবিশদের লেখা সস্তা সাহিত্যে যখন বাজার ছেয়ে গেছে, পামুক তখন নিজের মৌলিক চিন্তা বজায় রেখেছেন। এই বইটি সেই মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ মনে রাখবে।
উপন্যাসটির শুরুটাই আসলে জানিয়ে দেবে- আমরা একটি অন্যরকম উপন্যাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছি! এর শুরু হয় এভাবে,
এখন আমি পচা গলা মৃত শরীর, পড়ে আছি এক কুয়োর তলায়।
একজন মৃত চিত্রশিল্পীর বয়ানের ভেতর দিয়েই গল্প তার ডানা মেলে মহা-উপন্যাস হিসেবে পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। মোট ৫৯টি অধ্যায়ে সকল চরিত্রের নিজস্ব বয়ানের ভেতর দিয়ে লেখা হয়েছে ‘মাই নেম ইজ রেড’। এর মূল শক্তি হলো প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব জবানি। শুধু মৃত শিল্পী নয়, এখানে কথা বলবে একটি গাছ, এমনকি একটি চিত্রে ব্যবহৃত লাল রঙ।
চরিত্রগুলোর নিজস্ব বয়ানের ভেতর দিয়ে উপন্যাস তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, সেই সাথে নিঃসন্দেহে নতুন এক সৃষ্টির সাথে পরিচিত হবে পাঠকসমাজ। ওরহান পামুকের লিখনী এত শক্তিশালী যে পাঠক গাছ, কুকুর অথবা রঙের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং অভিভূত হবে নতুন এক যোগাযোগ দেখে। সাহিত্যের গভীরতা যে কত ব্যাপক তা এই উপন্যাস যেন খুব আয়োজন করেই আমাদের জানাবে। উপন্যাসে যখন প্রতিটি চরিত্র কথা বলবে, সেই কথায় আসলে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠবে। এতে করে পাঠক শুধু গল্পের সাথে এগোবে না, বরং ওরহান পামুক পাঠকের জন্য একটু সুযোগ রেখে দিয়েছেন যেখানে গল্পের সাথে পাঠকের নিজস্ব ভাবনাও এগোতে থাকবে, কারণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে আসলে শুনে যেতে হবে প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব বয়ান!
স্বাভাবিকভাবে আমরা উপন্যাসের শুধু দর্শকসারির অংশ হই। লেখক যে ঘটনাগুলো আমাদের বলতে চান তা শুনে যাই, কিন্তু ‘মাই নেম ইজ রেড’ পুরোপুরি আলাদা। এখানে সবার নিজস্বতা নিয়ে কিছুটা অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। রহস্য-প্রেম-বিরহ-সম্পর্কের টানাপোড়ন-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে উপন্যাসটি আকারে যত বড়, আসলে তার চেয়ে শত গুণ বেশি এর গভীরতা।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে অটোম্যান সুলতান তার জীবন এবং রাজত্বকাল নিয়ে সচিত্র পাণ্ডুলিপি তৈরির হুকুম জারি করেন। সেই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় সেসময়ের শ্রেষ্ঠ চিত্রকরদের। এদের ভেতরই একজন খুন হয়, যার জবানিতেই গল্প এগিয়ে যায়!
বিশাল পরিসরে পাণ্ডুলিপির কাজ করতে গিয়ে শিল্পীরা মধ্যপ্রাচ্য অনুচিত্র শিল্প আর পাশ্চাত্য অনুচিত্রের ভেতর দ্বন্দ্বে পড়ে যায়! কারণ দুনিয়ার কাছে আর বিশেষ করে ইউরোপের কাছে সুলতান আর সালতানাত তুলে ধরতে ইউরোপের চিত্রশিল্পের শৈলী ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়ে ওঠে। কিন্তু এদিকে শত শত বছরের যে চিত্রশিল্পের নিজস্বতা, তা কি বর্জন করবে সবাই সুলতানের আদেশে? এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয় চিত্রশিল্পীদের আত্মকলহ। অন্যদিকে উগ্রপন্থায় বিশ্বাসীদের থেকে আসে আরও বড় বাধা। তারা চিত্রশিল্পকে পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দেয়। পুরো চিত্রশিল্পী সমাজে নেমে আসে হতাশা। নিজেদের বিবাদে চিত্রশিল্পী মহলে নীরব খুনোখুনি শুরু হয়ে যায়। কারো উদ্দেশ্য হয়ে যায় সুলতানের কাছাকাছি থাকা, আর কারো উদ্দেশ্য থাকে নিজের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা। এসবের ভেতর চিত্রশিল্পীদের জীবনের নেমে আসে এক অন্যরকম সময়, যে সময়ের কথা তারা কখনো ভাবেনি।
এই উপন্যাসে আরও দেখা মিলবে একজন মায়ের, যার সন্তানদের নিয়ে তার সংগ্রামী আর প্রেম সন্ধানী জীবনের সাথে বর্ণিত হবে তার নিজের পরিবার আগলে রাখার গল্পগুলো। সেই সাথে বর্ণিত হবে তার শরীর নির্ভর সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামগুলো, যেখানে থাকবে একের পর এক বাধা-বিপত্তি!
আরও থাকবে বারো বছর পর ইস্তাম্বুলে ফিরে আসা এক প্রেমিকের কথা, ভালবাসা পাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতায় যার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে, কারণ তাকে খুঁজে বের করতে হবে তার প্রেমিকার বাবার খুনীকে, না হয় সে তার ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলবে! এমন নানা রকম ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে উপন্যাস জুড়ে উঁকি দেবে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-কলহের কথা, মানুষের জীবন আর মানুষের সাংস্কৃতিক শিকড়ের কথা।
এত ঘটনা, এত কাহিনী আর রহস্য থাকা সত্ত্বেও বইটিকে কখনো রহস্য উপন্যাস মনে হবে না, কারণ এসব রহস্য এই উপন্যাসের আবছা ছায়া মাত্র! উপন্যাসের মূল অংশ এগিয়ে যাবে সম্পর্ক-প্রেম-পরিবার-ভালোবাসা-ঈর্ষা-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে। আসলে এমন সব গল্প মিলিয়ে অসাধারণ এক সৃষ্টির নাম ‘মাই নেম ইজ রেড’।
উপন্যাসটির বহু রকম গল্পের বিস্তারের জন্যই হয়তো দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ প্রায় জনপ্রিয় সব পত্রিকায় ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এমনটি আসলেই খুব কম দেখা যায় যে একটি উপন্যাস সব মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সত্যিই ‘মাই নেম ইজ রেড’ বিশ্বসাহিত্যের জন্য এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস।
শেষের আগে
নিঃসন্দেহে ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইজ রেড’ পাঠককে নতুন এক সাহিত্য আর সাহিত্যশৈলীর সাথে পরিচিত করবে, পরিচিত করবে নতুন চিন্তা-ভাবনার সাথে। সেই সাথে জানিয়ে দেবে সাহিত্যের সাথে পাঠকের যোগাযোগ কতটা নিবিড় আর সমৃদ্ধশালী হতে পারে!