১৯৬৪ সাল। সাতচল্লিশের দেশভাগের জের ধরে তখনও থেমে থেমে দুই বাংলায় দাঙ্গা হচ্ছিল। এপারের সংখ্যালঘুরা তাতে ওপারে যাচ্ছিল, ওপার থেকেও অনেকে এপারে আসছিল। মহানগর কলকাতায়ও ছড়িয়ে পড়েছে সে দাঙ্গা। এমনই এক অসহিষ্ণু সময়ে দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অভিনয়পাগল ২২ বছরের এক যুবক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলে আসেন এপার বাংলায়।
পুরোনো জমিদার পরিবারের এক আদুরে সন্তান ঢাকায় এসে আশ্রয় নেন শরণার্থী শিবিরে। এরপর জীবনের সাথে ক্রমশ সংগ্রাম করে, বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে একদিন হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের এক রাজপুত্র। আস্তে আস্তে ঢালিউড নামক রাজ্যের এক রাজাধিরাজে পরিণত হন। সেই রাজাধিরাজের নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। ভালোবেসে মানুষ যাকে উপাধি দেয় নায়করাজ।
হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার। আন্তঃস্কুল ফুটবলে খেলতেন, ছিলেন গোলকিপার। কলকাতায় তখন ফুটবলাররা সুপারস্টার হিসেবে গণ্য হতেন। একদিন গোলবারে একটা বল ধরতে গিয়ে স্ট্রাইকারের প্রচণ্ড জোরে মারা লাথি লাগে বুকে। তারপর থেকেই গুডবাই জানান সাধের ফুটবলকে। মনোযোগ দেন অভিনয়ে।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন। এরপর নিয়মিত মঞ্চ আর নাটক নিয়ে পথ চলতে থাকেন। এপার বাংলায় আসার আগে কলকাতায় তিনটি সিনেমায়ও অভিনয় করেন। সেখান থেকে একদিন মুম্বাই চলে যান। মুম্বাইয়ে সুবিধা করতে না পেরে সিনেমার নায়ক হওয়ার আশায় একদিন পা রাখেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসে সিনেমাপাড়ায় ঘোরাঘুরি করতেন, কাজের জন্য নানা জায়গায় ধর্না দিতেন। একসময় পরিচালক কামাল আহমেদের সাথে ফোর্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভেবেছিলেন হয়তো ধীরে ধীরে সিনেমা জগতে প্রবেশ করবেন। কিন্তু মনে ছিল অভিনেতা ও নায়ক হওয়ার সংকল্প। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না মোটেও। একে ওকে ধরে দু’চারটে সিনেমায় এক্সট্রা আর্টিস্টের রোল করলেও তাতে মন ভরছিল না যেমন, তেমনি সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছিল।
আব্দুল জব্বার খানের অধীনে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন। এরই মধ্যে একদিন কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের নজরে পড়েন। তার সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা বলে রাজ্জাককে সেই সিনেমার নায়ক বানাতে চান তিনি। কিন্তু নানা কারণে সেই সিনেমাটি আর হচ্ছিল না। তাতে আরও হতাশ হয়ে পড়েন রাজ্জাক।
একদিন হঠাৎ করে একটা টিভি ধারাবাহিকে অফার পেয়ে বসেন, যার নাম ছিলো ‘ঘরোয়া’। সেখানে অভিনয় করে সংসারের টানাটানি কিছুটা দূর হয়েছিল। এর মধ্যে খবর পান জহির রায়হান তাকে খুঁজছেন। দেখা করেন জহির রায়হানের সাথে। গিয়ে শোনেন, এই খ্যাতিমান পরিচালকের নতুন ছবি ‘বেহুলা’য় তাকেই নায়ক হিসেবে নিতে চান জহির রায়হান।
কিন্তু ছবির প্রযোজক বেঁকে বসেন। শওকত আকবর, হাসান ইমাম, রহমানের মতো তুখোড় অভিনেতা থাকতে নতুন একটি ছেলেকে তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু জহির রায়হানের জেদের কারণে তাকে নিতে বাধ্য হন প্রযোজক। এরপর রাজ্জাককে দিয়ে ছবির একটি গানের শুটিং করে প্রযোজককে দেখানো হলো। এবার খুশিমনে তিনিও মেনে নেন।
নায়ক হিসেবে অভিনীত প্রথম সিনেমার সাইনিং মানি পান ৫০০ টাকা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় বেহুলা। লখিন্দররূপে রাজ্জাক ও বেহুলারূপে সুচন্দার অভিনয় মুগ্ধ করে সবাইকে। ছবিটি সুপারহিট হয়ে যায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতে থাকেন। নায়ক হিসেবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অভিনয় করে যান, বাংলা চলচ্চিত্রকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়, হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় নায়করাজ।
রাজ্জাক যখন অভিনয় শুরু করেন তখন পাকিস্তান আমল চলছে। উর্দু, হিন্দি ও টালিগঞ্জের সিনেমার জয়জয়কার চারদিকে। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী, জেবা, সুধির, শামীম আরা, ওয়াহিদ মুরাদ, কলকাতার ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, বিশ্বজিৎ, সৌমিত্র এবং মুম্বাইয়ের অর্থাৎ বলিউডের রাজ কাপুর, নার্গিস, দিলীপ কুমার এদের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে হচ্ছিল ঢাকার নির্মাতা-অভিনেতাদের।
আব্দুল জব্বার খান, রহমান, শবনম, খলিল, ফতে)হ লোহানী, খান আতা, সুমিতা দেবী, আনোয়ার হোসেন, সুচন্দাদের সাথে যোগ হন রাজ্জাক। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে নির্মিত বেশিরভাগ ছবির নায়ক ছিলেন রাজ্জাক।
নীল আকাশের নিচে, এতটুকু আশা, আবির্ভাব, অলঙ্কার, সুখে থেকো, দর্পচূর্ণ, ঘরণী, স্বরলিপি, সুতরাং, টাকা আনা পাই, দুই পয়সার আলতা, পরিচয়, অশ্রু দিয়ে লেখা, অভিমান, অঙ্গার, গৃহলক্ষী, কালো গোলাপ, সংসার, কাঁচ কাটা হীরে, অধিকার, নাচের পুতুল, স্মৃতিটুকু থাক, দুই ভাই, বাঁশরী, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল, যোগ বিয়োগ, ছদ্মবেশী, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য একজন।
ভিনদেশী ছবির দাপট থেকে বাংলাদেশের সিনেমাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এই রাজ্জাকই। অবশ্য সেক্ষেত্রে তিনি পাশে পান দুর্দান্ত কিছু পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী, সংগীত-পরিচালককে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঢালিউডের চলচ্চিত্র দাঁড়িয়ে যায় শক্ত ভিতের ওপর।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হবার পর তো বাংলাদেশের বাংলা সিনেমাই এদেশে রাজত্ব শুরু করে, বন্ধ হয় ভিনদেশী সিনেমা, যার নেতৃত্ব দেন নায়করাজ। অসাধারণ সব চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। জুটি গড়ে তোলেন একাধিক নায়িকার সাথে। বিশেষ করে কবরী-রাজ্জাক জুটি তো ওপারের উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই একের পর এক কালজয়ী সিনেমা উপহার দেয় দর্শকদের। শুধু কবরী নয়, ববিতা, সুচন্দা, সুজাতা, শবনমের সাথেও যেমন জুটি গড়েন, তেমনি উর্দু ছবির নায়িকা শাবানাকে বাংলা ছবিতে তিনিই সুযোগ করে দেন, দুজনের জুটিতে দারুণ কিছু ছবিও তৈরি হয়।
ভীষণ সুদর্শন রাজ্জাক একদিকে যেমন ছিলেন রোমান্টিক নায়ক, অপরদিকে তেমনি ভিন্ন ভিন্ন সব চরিত্রে নিজেকে প্রমাণও করেছেন বারবার। নিজের চির-রোমান্টিক ইমেজের বাইরে গিয়ে জীবন থেকে নেয়া, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, ছুটির ঘন্টা, অবাক পৃথিবী, অশিক্ষিত, রংবাজ, গুণ্ডা, ঝড়ের পাখি, স্লোগান, বড় ভালো লোক ছিল-র মতো চমৎকার সব ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অধরা এক অনন্য উচ্চতায়।
নায়করাজ রাজ্জাক শুধু অভিনয় নয়, পরিচালক হিসেবেও ছিলেন দারুণ সফল। অনন্ত প্রেম ছবির মাধ্যমে পরিচালনা শুরু করেন। এরপর জিনের বাদশা, প্রফেসর, বাবা কেন চাকর, উত্তর-ফাল্গুনী, চাপাডাঙ্গার বউ, বদনাম, সৎভাই ছবিগুলোতে পরিচালক হিসেবে দারুণ দক্ষতার ছাপ রাখেন। মোট ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন তিনি।
শুধু পরিচালনা নয়, প্রযোজনাও করেন বেশ কিছু ছবি। গড়ে তোলেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন। ২০১৩ সালে তার পরিচালিত সর্বশেষ ছবি আয়না কাহিনি মুক্তি পায়।
একসময় তিনি টলিউডেও অভিনয় শুরু করেন। তার পরিচালিত বাবা কেন চাকর রিমেক হয় কলকাতায় ১৯৯৮ সালে। সেখানেও তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর অন্নদাতা, জন্মদাতা, হিরো, এরই নাম প্রেমসহ টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন।
১৯৯০ সালে নায়ক হিসেবে সর্বশেষ অভিনয় করলেও ১৯৯৫ থেকে নিয়মিত চরিত্রাভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর নিয়মিত কাজ করেন নিজের ও বিভিন্ন প্রোডাকশনের ছবিতে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজ করে যান একের পর এক ছবিতে। তার পুত্র বাপ্পারাজের পরিচালনায় কার্তুজ ছবিতে অভিনয় করেন ২০১৫ সালে। আনুষ্ঠানিকভাবে এটাই তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র।
নায়করাজ রাজ্জাক মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৭৬ সালে কী যে করি, ১৯৭৮ সালে অশিক্ষিত, ১৯৮২ সালে বড় ভালো লোক ছিল, ১৯৮৪ সালে চন্দ্রনাথ, ১৯৮৮ সালে যোগাযোগ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়াও ২০১৩ সালে চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে পান স্বাধীনতা পুরস্কার। এছাড়া বাচসাস, মেরিল-প্রথম আলোসহ (আজীবন সম্মাননা) আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এত পুরস্কারের ভিড়েও ইউনিসেফের জনসংখ্যা-বিষয়ক শুভেচ্ছাদূত হওয়াটাও তার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি হয়ে থাকবে।
নায়করাজ নেই। দুই বছর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি দীর্ঘ ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে আমাদেরকে যা দিয়ে গেছেন, তার ঋণ কখনোই শোধ করতে পারবে না এদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন। উত্তম কুমাররা ওপার বাংলায় আরও অনেক কম সময় অভিনয় করেও মহানায়ক হয়ে বেঁচে আছেন, ওপার বাংলার মানুষ তাকে রেখেছে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে। কিন্তু আমাদেরও তো একজন মহানায়ক ছিলেন!
আজকে বাংলা চলচ্চিত্র নানাবিধ সংকটে বিপর্যস্ত। ভালো গল্প, চিত্রনাট্য, গান কিছুই নেই এখন। এক-দুজন নায়ক নিজেদের কব্জায় রেখেছেন পুরো ইন্ডাস্ট্রি, বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকশ সিনেমা হল। অথচ রাজ্জাক সাহেবরা কীভাবে পরিশ্রম, সাধনা আর সংগ্রাম দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে দাঁড় করিয়েছিলেন, সেসব কথা সর্বজনবিদিত। তাই নায়করাজের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তার দেখানো পথে হাঁটলে, এই মুমূর্ষু অবস্থা থেকেও ইন্ডাস্ট্রি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। ভক্তদের এই মহাতারকা আকাশের তারকা হয়ে সে দৃশ্য দেখলে খুশিই হবেন!