If it was never new, and it never gets old, then it’s a folk song.
গান পরিবেশন শেষে লুইনের এই উক্তিতে ফোক ধারার সঙ্গীতের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ আর এই ধারার চিরন্তনতার কথাই ঘোষিত হয়। ইথান ও জোয়েল কোয়েন লিখিত এবং পরিচালিত ইনসাইড লুইন ডেভিস-এ আমরা ১৯৬১ সালের ঘটনাপ্রবাহ দেখতে পাই। সিনেমার মূল উপজীব্য বিষয় লুইন ডেভিস নামক এক কল্পিত ফোক শিল্পীর জীবনের এক সপ্তাহের ঘটনাবলী। তাকে আমরা যে স্থানে সংগীত পরিবেশন করতে দেখি, তার নাম ‘গ্যাসলাইট’। যেটি কিছুকাল পরে সংঘটিত আমেরিকার ফোক রিভাইভালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ফোক রিভাইভালের সফলতার গল্পগুলোর একটি লুইন হতে পারবে কিনা, সেটা নিয়ে আমরা দর্শকরা সন্দিহান হয়ে পড়ি। তার প্রথম কারণ, লুইন কোয়েন ব্রাদার্সের সিনেমার মূল চরিত্র। এই দুই ভাইয়ের কাজ সম্পর্কে ধারণা থাকলে সহজেই অনুমান করতে পারবেন এ কথা কেন বলা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সংগীত শিল্পে সফলতা পেতে তাকে শুরু থেকেই আমরা সংগ্রাম করতে দেখি। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের যেটুকু অংশ বাকি আছে, সেটাকে রক্ষা করতে হলে আনতে হবে ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ন্ত্রণ। আর লুইনকে এতক্ষণে আমরা যতটা চিনেছি তাতে সহজেই বলা যায় যে, এটা বলা সহজ কিন্তু করা ভীষণ কঠিন।
গ্রিক পুরাণের এক বিখ্যাত চরিত্রের নাম সিসিফাস। কারো কারো মতে তিনি ছিলেন ডাকাত, আবার কারো কারো মতে তিনি ছিলেন করিন্থের রাজা। দেবতারা তাকে দিয়েছিলেন অভিশাপ। শাস্তিস্বরূপ তার ওপর একটি পাথরকে ঠেলে পাহাড়ের উপর নিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু উপরে নিলেই সেটি আবার গড়িয়ে নীচে পড়ে যায়। ফলে আবার তাকে ঠেলে তুলতে হয় সেই পাথর। আর এভাবেই চলতে থাকে তার অনন্ত শাস্তি। লুইনের চরিত্রেও আমরা অনন্ত কষ্টের ছায়াপাত হতে দেখি। সিসিফাসের যেমন অনন্ত শাস্তি থেকে কোনো মুক্তি নেই, তেমনই লুইনের জীবনেও সুখের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেন অনন্ত দুঃখের সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক।
শুরু থেকেই অস্কার আইজ্যাকের লুইন ডেভিস তার রুক্ষ চেহারা, গাল ভরা দাঁড়ি, এলোমেলো চুল, এবং মসৃণ, ভঙ্গুর গানের গলা দিয়ে আপনাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলবে। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই আইজ্যাক গানের সাথে যুক্ত ছিলেন (একসময় ‘দ্যা ব্লিংকিং আন্ডারডগস’ নামে একটি ব্যান্ডসহ কয়েকটি ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি), যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার অভিনয়ে। সংগীত শিল্পীর চরিত্রে কাউকে কাস্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এখানকার পুরো গল্পই যেহেতু লুইন ডেভিসকে ঘিরে আবর্তিত হয়, সেহেতু এই সিদ্ধান্তের উপরই সবকিছু নির্ভর করছিল। কোয়েন ভাইরা যদি মিসকাস্টিং করতেন, তাহলে পুরো প্রজেক্টটাই মুখ থুবড়ে পড়তো।
এ ব্যাপারে তাদের নিজেদের অভিমতও একইরকম। এ কথাও স্বীকার করেছেন আইজ্যাকের সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের কাছে মনে হয়েছে এই প্রজেক্ট ‘আনফিল্মেবল’। দুই ভাই জানতেন তাদের এমন কাউকে দরকার যে গান গাওয়া, গিটার বাজানোর পাশাপাশি কমেডিক সিনগুলোতেও সমান তালে সাবলীল। লুইনের চরিত্র এতটাই জটিল যে কিঞ্চিৎ ভুলও পুরো গল্পের আবহকে নষ্ট করে ফেলতো। সৌভাগ্যক্রমে তারা অস্কার আইজ্যাককে নির্বাচন করেন, যিনি লুইন ডেভিস চরিত্রের সাথে পুরোপুরি মিশে গেছেন এবং দিয়েছেন জীবনের সেরা পার্ফরম্যান্সগুলোর একটি।
এ রকম একটা ত্রুটিপূর্ণ, জীবনের গতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা, অমিশুক চরিত্রের রূপদানের সময়ও আইজ্যাকের ক্যারিশমা স্ব-মহিমায় বিচ্ছুরিত হয়েছে। তার পার্ফরম্যান্সের সাথে গল্পের অপূর্ব সম্মিলনে দর্শক এক মুহূর্তে নিজেকে লুইনের জায়গায় বসিয়ে ফেলবে, তার সংগ্রামের সাথে নিজের সংগ্রামের তুলনা করবে। আবার পর মুহূর্তেই হয়তো বিরক্ত হয়ে বলবে, এরকম অসহ্য মানুষও হয়! গল্পে লুইনকে যেসব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেগুলো রিলেটেবল এবং হৃদয়বিদারক।
আইজ্যাকের ডায়লগ ডেলিভারি এই ব্ল্যাক কমেডির জন্য ঠিক উপযুক্ত, জোক বলার সময়ও লুইন ভাবলেশহীন। এমনকি পুরো সিনেমা জুড়ে তাকে হয়তো এক-আধ বার হাসতে দেখা গেছে। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিকে লুইন হালকা চালে উড়িয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে দর্শক কি হাসবে নাকি সহমর্মী হবে; তা নিয়ে দোটানার সৃষ্টি হয়।
ইনসাইড লুইন ডেভিস-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং তার জার্নি বা জীবনের পথে অভিযাত্রা। মিউজিক বিজনেসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে লুইনকে রীতিমতো দুঃসাহসিক অডিসিতেই নামতে হয়। আর মিউজিক বা সংগীত আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে।
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা যেকোনো মানবীয় বোধের সময় আমরা গান শুনি। তাই সংগীতশিল্পী হই বা না হই, গান বা এই শিল্প সম্পর্কে আমরা কিছু না কিছু জানি। এছাড়া আমরা সবাই জীবনের স্রোতে বহমান, সবাই কোনো না কোনোভাবে এই যাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাচ্ছি, চাচ্ছি পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেতে। এসব বিষয় নিয়ে কোয়েন ব্রাদার্স এমন একটি গল্প ফেঁদেছেন যেটি দর্শকের কাছে বাস্তবিকভাবে ধরা দেয়।
লুইনের জীবনে চড়াইয়ের চেয়ে উৎরাইয়ের সংখ্যা অধিক। যার ফলশ্রুতিতে সে হয়ে পড়েছে বিষণ্ণ ও একাকী। তারপরও প্রাত্যহিক জীবনের মানুষের মতো লুইনও টিকে আছে কোনোভাবে। হয়তো অন্য সবার মতো সেও আশা করছে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। চরিত্র হিসেবে লুইন যে সহজে পছন্দনীয় ব্যাপারটা এমন না। কিন্তু তারপরও শেষপর্যন্ত আমরা তাকে পছন্দ করে ফেলি। কারণ তার সংগ্রাম এবং গল্পের সাথে আমরা নিজেদের মিল খুঁজে পাই। এই মিল খুঁজে পাওয়াই সিনেমায় দর্শককে মনোযোগী রাখে, তারাও আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে থাকে লুইনের জীবনে কী ঘটে তা জানতে। আর লুইনের জীবনও আমাদের জীবনের মতো অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ।
সিনেমার চিত্রায়নের ক্ষেত্রে কোয়েনরা ব্যবহার করেছেন জীর্ণ, মলিন ও প্রায় বর্ণহীন কালার প্যালেট। কিন্তু এটি কোনোভাবেই ফিল্মের ডাউন সাইড নয়। বরং ব্রুনো ডেলবনেলের চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফির সাথে সৃষ্ট ঐকতানে এই কালার প্যালেট অমোঘ হয়ে ধরা দেয় দর্শকের হৃদয়ে। যেন আমরা লুইনের মনস্তত্ত্বটাকেই ফুটে উঠতে দেখি চোখের সামনে, পরিপার্শ্বকে অবলোকন করি তার অনুজ্জ্বল প্রাণশক্তির আলোকে। এসবের ফলে চলচ্চিত্রে সৃষ্টি হয় একটি ‘ওল্ড স্কুল’ টাইপের আবহ, যা এ ধরনের ক্যারেক্টার স্টাডিকে দেয় পরিপূর্ণতা।
এই আবহের মাধ্যমে দর্শকের মনোযোগ গল্পের মাঝেই নিবদ্ধ করে রাখার কাজটিও সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন কোয়েনরা। কারণ তারা এখানে সুন্দর দৃশ্য বা বর্ণিল কোনোকিছু দেখিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করে দিতে চাইছেন না। গল্পই তাদের মূল ফোকাস। ফলে লুইনের সাথে পরবর্তীতে ভাগ্য কী খেলা খেলবে সেটা দেখতেই ব্রতী হয় সবাই। আর সিনেমার সফলতার জন্য এটিই প্রয়োজন ছিল।
সংগীতই এই সিনেমার মূল উপজীব্য বিষয়। তাই ব্যবহৃত গানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আর এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলে ছিলেন বিশেষভাবে যত্নশীল। এখানকার সকল গানই লাইভ পরিবেশিত হয়েছে। এটা কেবল অস্কারের ক্ষেত্রে নয়, পুরো কাস্টের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। ফলে গল্পে একটা অথেনটিসিটি এসেছে যা সিনেমাকে করেছে আরো চিত্তাকর্ষক।
অস্কারের নাম তো বারবারই নেওয়া হচ্ছে, জিন বার্কলি চরিত্রে অভিনয় করা ক্যারি মালিগানও গাওয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন সাবলীল। এছাড়া বাস্তবের সংগীতশিল্পী জাস্টিন টিম্বারলেককে কাস্ট করা হয়েছে জিম বার্কলি চরিত্রে। ফলে জিম চরিত্রে মিশে যেতে তাকে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। এছাড়া নিজেদের প্রজেক্টে কোয়েন ব্রাদার্স সম্পৃক্ত করেছিলেন টি বোন বার্নেট (যিনি একজন প্রখ্যাত মিউজিক প্রডিউসার এবং সত্তরের দশকে বব ডিলানের জন্য গিটার বাজাতেন), ‘মামফোর্ড অ্যান্ড সন্স’-এর মার্কাস মামফোর্ডকে। ফলে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রেকর্ডকৃত গানগুলো দর্শককে আন্দোলিত করেছে এবং তাদের পরিশ্রমকে সফল করেছে। সংগীত ইনসাইড লুইন ডেভিসে সবসময়ই হাইলাইট হয়ে থেকেছে। এবং অন্য সব উপকরণের সাথে মিশে গিয়ে দর্শকের মনে সিনেমার ষাটের দশকের আবহ সৃষ্টিতে পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা।
কোয়েনদের সিনেমার কাস্টিং নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাদের অন্যান্য সিনেমার মতো এখানকার কাস্টিংও চমৎকার। অস্কার, মালিগান, টিম্বারলেক ছাড়াও রয়েছেন গ্যারেট হেডলান্ড। অ্যাডাম ড্রাইভারকে অ্যাল কোডি নামক ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা গেছে। এছাড়া ইউজুয়াল সাসপেক্টদের মাঝে ছিলেন জন গুডম্যান। তিনি অভিনয় করেছেন জ্যাজ শিল্পী রোনাল্ড টার্নারের চরিত্রে এবং নিজের চরিত্রে দেখিয়েছেন সুনিপুণ পারদর্শিতা। চটুল, শীতল রোনাল্ড যখনই পেরেছে চেপে ধরেছে আমাদের প্রিয় লুইনকে।
অন্যদিকে, জিনকে আমরা বলতে পারি অডিয়েন্স সারোগেট বা দর্শকের প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র। এই প্রাক্তন প্রেমিকা এবং বর্তমানে অন্যের স্ত্রী চরিত্রের সাথে লুইনের লাভ/হেইট রিলেশনশিপ বিদ্যমান। দর্শকদের মতো সেও লুইনের প্রতি সহমর্মী। আর বিশ্বাস আছে তার প্রতিভার উপর। কিন্তু বার বার অবিবেচকের মতো আচরণ করে লুইন তার বিশ্বাস হারিয়েছে। তথাপি তার জন্য জিনের সহানুভূতির কমতি নেই। দুজনের সম্পর্কের এই সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো অনুপমভাবে ফুটে উঠেছে ক্যারি মালিগানের অভিনয়ে।
দিনশেষে লুইনের মতো অন্যান্য মানুষদের জীবনও জিন আর রোনাল্ডের মতো মানুষে পরিপূর্ণ। কেউ আপনার প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে, কেউ অবজ্ঞা করবে। এসবকিছু সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে চলে আমাদের সিসিফাসও।
তো, ইনসাইড লুইন ডেভিসে আপনি দেখবেন একটি রিলেটেবল কাহিনী। যার সাথে যুক্ত হয়েছে অসাধারণ মিউজিক, খুব ভালো কাস্ট আর অস্কার আইজ্যাকের ক্যারিয়ার বেস্ট পার্ফরম্যান্স। আপনার বয়স যেমনই হোক না কেন, কোয়েন ব্রাদার্সের এই রত্ন আপনার মাঝে কোনো না কোনো অনুভূতির সঞ্চার করবে। যার রেশ থেকে যাবে বহু দিন। কারণ জীবনের কোনো একসময় আমরা লুইন ডেভিসের মতোই স্বপ্নকে তাড়া করেছি বা করবো। আর শিল্প যখন বাস্তব জীবনের তখনই তা পায় ক্লাসিকের মর্যাদা। যেমনটা পেয়েছে ইনসাইড লুইন ডেভিস।