মাঝখানের বিশাল হলরুমের ভেতর প্রবেশ করা মাত্রই খুব মিষ্টি একটি গন্ধ নাকে এসে পৌঁছালো। রুমের মাঝখানে কয়েকটি সোফা বৃত্তাকারভাবে সাজানো। সেখানে বসে আছেন অ্যান ড্রুইয়ান নামক এক ভদ্রমহিলা। তিনি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে হলরুমের দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন পোস্টার দেখছেন। ডানদিকের দেয়ালের ‘স্টার ট্রেক’ সিনেমার পোস্টারটি তার বেশ ভালো লাগলো। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ হনহন করে হাঁটার শব্দে ভদ্রমহিলার মনোযোগে ছেদ পড়লো। তিনি হলরুমের দরজার দিকে তাকালেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন স্টার ট্রেকের মতো কালজয়ী সিনেমার প্রযোজক ব্রানোন ব্রাগা। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন ড্রুইয়ান। প্রযোজক ব্রাগার সাথে তিনি একটি নতুন টিভি সিরিজ নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। তিনি ব্রাগাকে জানালেন, “সাগানের কসমসের কথা মনে আছে? আমরা সেটি নতুন করে দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করতে চাই। আমি চাই আপনি এই প্রকল্পে আমাদের সাথেই থাকবেন।”
কসমসের কথা শুনে নড়েচড়ে বসলেন ব্রাগা। কসমসের কথা কে না জানে? কার্ল সাগানের মতো একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর চমৎকার উপস্থাপনায় মহাজাগতিক এবং পার্থিব বৈজ্ঞানিক রহস্যগুলো চোখের সামনে ধরা দিতো ‘কসমস’ টিভি সিরিজের মাধ্যমে। সেই বিংশ শতাব্দীর কসমসকে আবার ফিরিয়ে আনা হবে, এ কথা ভাবতেই ব্রাগা উৎসাহী হয়ে উঠলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিলো। “কসমস মানেই একটু আলাদা কিছু, যা সবার থেকে সেরা। কার্ল সাগানের সেই কসমসকে দর্শকদের চাহিদানুযায়ী পুনরায় উপস্থাপন করা কি আসলেই সম্ভব?” ব্রাগার প্রশ্নের উত্তর ড্রুইয়ান অনেক আগেই প্রস্তুত করে রেখেছেন। তিনি জোর গলায় বললেন, “অবশ্যই সম্ভব। এবং আমি জানি এমন একজনের কথা, যিনি কার্ল সাগানের অভাব পূরণ করতে পারবেন।” পুরাতন কসমস সিরিজের লেখিকা ছাড়াও ড্রুইয়ানের আরো একটি পরিচয় আছে। তিনি কার্ল সাগানের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাই, ড্রুয়াইনের চেয়ে বেশি কার্ল সাগানকে কারো চেনার কথা নয়। তাহলে কে সেই ব্যক্তি, যিনি কার্ল সাগানের কসমসকে নতুন করে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন?
কালো স্যুট পড়া বেশ পরিপাটি এক ভদ্রলোক এবার দৃশ্যপটে হাজির হলেন। তার চেহারায় বেশ নিরীহ একটি ভাব আছে। ঠোঁটের কোণায় সর্বক্ষণ হাসি লেগে থাকা মানুষটিকে যে কেউই প্রথম দেখায় পছন্দ করে ফেলবে। বেশ মিষ্টি স্বরে সেই লোকটি বলে উঠলো, “আমি নিল ডিগ্রাস টাইসন। আমিই কার্ল সাগানের বিখ্যাত কসমসকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি।” ব্রাগা বেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে টাইসনকে দেখতে লাগলেন। টাইসন ব্রাগার দ্বিধার কথা বুঝতে পারলেন। তখন তিনি পুনরায় কৌতুক করে বলে উঠলেন,
“কার্ল সাগান একজনই। কেউই কার্ল সাগানের আসন পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু খুশির খবর হচ্ছে, আমার নিজেরই একটি চেয়ার (আসন) আছে। আমি সেখানে বসতে পারি। ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে পারি এবং একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার চেয়ারে আমার চেয়ে আরাম করে আর কেউ বসতে পারবে না।”
একটি ব্যক্তিগত ভ্রমণের গল্প
কার্ল সাগান একজন জাদুকর। অমায়িক হাসির অধিকারী এই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষটি খুব সহজে কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে বেশ উপভোগ্য করে তুলতে পারেন। অসাধারণ প্রতিভাধর কার্ল সাগান অসংখ্য বিজ্ঞানভিত্তিক বই রচনা করেছেন। কিন্তু সেবার তিনি লেখালেখির বাইরে বড় পর্দার সাহায্যে বিজ্ঞানকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাইলেন। তার এই নতুন যাত্রায় তার সঙ্গী হিসেবে পেলেন স্ত্রী ড্রুইয়ানকে। কার্ল সাগান, অ্যান ড্রুইয়ান এবং স্টিভেন সটারের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৩ পর্বের একটি অসাধারণ স্ক্রিপ্ট তৈরী হলো। অনুষ্ঠানটির নাম ঠিক করা হলো ‘কসমস’ (Cosmos)। সাগান নামের শেষে আরো একটি অংশ জুড়ে দিলেন। সেটি হচ্ছে A personal Voyage বা ‘একটি ব্যক্তিগত ভ্রমণ’। মহাবিশ্বের বুকে প্রাণের প্রথম স্পন্দন থেকে শুরু করে সৃষ্টি রহস্যের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের বিভিন্ন জটিল বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সমন্বয়ে রচিত হয়েছে এই সিরিজ।
সাগান চেয়েছিলেন, দর্শকদের নিকট বিষয়গুলো যথাসম্ভব বাস্তবসম্পন্ন করে তুলতে হবে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ঘটনা এবং বিজ্ঞানীদের জীবন কাহিনীগুলো নাটকের মাধ্যমে পরিবেশন করা হবে। আর পুরো অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য একজন চমৎকার উপস্থাপকের প্রয়োজন। আর এই কাজে সাগানের চেয়ে ভালো আর কে হতে পারে? সাগানের উপস্থাপনা নিয়ে কারো সন্দেহ ছিল না, তাই সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। দিন-রাত নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সিরিজের চিত্রায়ন শুরু হলো। কোনো কাজ পছন্দ না হলে সেটি একদম গোড়া থেকে শুরু করা হচ্ছিলো। দিনশেষে সবাই ক্লান্ত দেহে অফিস ত্যাগ করলেও, সবার মনে একটি প্রশান্তির ভাব বিরাজ করতো। শুধু নতুন কিছু করার মাঝে এই অনুভূতি বিরাজ করে।
১৯৮০ সালে পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস (পিবিএস)-এর আওতায় প্রথমবারের মতো কার্ল সাগানের কসমস প্রচারিত হলো। প্রথম পর্বের নাম ছিল ‘দ্য শোরস অফ দ্য কসমিক ওশেন’। কার্ল সাগানের কাল্পনিক মহাকাশযানে চড়ে দর্শকরা এক ব্যতিক্রমধর্মী যাত্রায় শামিল হলো। এক পর্বেই বিজ্ঞানমনস্ক দর্শকদের কাবু করে ফেললেন সাগান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তার। কসমস সিরিজ যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক প্রচারিত সিরিজের খেতাব অর্জন করে। এমনকি বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, কার্ল সাগানের কসমস পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচারিত পিবিএস সিরিজ হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি এমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেওয়া কসমস প্রায় ৬০টি দেশে ৬০০ মিলিয়ন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু কসমসের গল্প তার শেষপর্ব ‘হু স্পিকস ফর আর্থ’-এ এসে থেমে যায়। কসমসপ্রেমীরা বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এ যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ। কিন্তু এই অপূর্ণতার মাঝেই কসমসের শ্রেষ্ঠত্ব। সবাই যখন কসমসের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা প্রায় বাতিল করে দিয়েছে, তখন প্রায় ৩৪ বছর পর এক নতুন সাগানের হাত ধরে কসমস ফের জ্ঞানপিপাসুদের নিকট উপস্থিত হয়েছে।
সাগানের উত্তরসূরী: নিল ডিগ্রাস টাইসন
হেইডেন প্লানেটেরিয়ামের নতুন প্রধান হিসেবে যোগ দিলেন কৃষ্ণবর্ণের একজন হাসিখুশি মানুষ। সবাই তাকে টাইসন নামে ডাকে। পুরো নাম নিল ডিগ্রাস টাইসন। অফিসে যোগদানের প্রথম সপ্তাহেই টাইসন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়লেন। কী এমন করলেন তিনি? তিনি নাকি প্লানেটেরিয়ামের প্রদর্শনী থেকে প্লুটো নামক এক গ্রহকে বাদ করা দিয়েছেন কোনো নোটিশ ছাড়াই! ব্যাপারটি অনেকেরই পছন্দ হলো না। প্লুটো আবার কী দোষ করলো যে একে বাদ দিতে হচ্ছে? টাইসনের নিকট প্রশ্নটি উত্থাপিত হবার সাথে সাথে সে বিশাল বোর্ড টেনে সেখানে নানা হিসাব কষে প্লুটোর গ্রহ হিসেবে অযোগ্যতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি সুরাহা না হলেও পরবর্তীতে টাইসনের দেখানো পথেই হাঁটলো আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা ইউনিয়ন। ২০০৬ সালে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
নিউ ইয়র্কের শহুরে ব্যস্ততার মাঝে বড় হওয়া নিল ডিগ্রাস টাইসনকে বর্তমান যুগের অন্যতম প্রতিভাবান জ্যোতির্বিদ এবং টিভি উপস্থাপক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নয় বছর বয়সে টাইসন হেইডেন প্লানেটেরিয়াম প্রদর্শনে যান। মূলত সেদিনের স্মৃতিই টাইসনকে জ্যোতির্বিদ্যার সাথে প্রেমে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলো। বড় হয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে হার্ভার্ডে ভর্তি হন টাইসন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভের পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি প্লানেটেরিয়ামে যোগ দেন। হেইডেন প্লানেটেরিয়ামকে নিজের স্বপ্নের মতো সাজিয়ে তুলেন টাইসন।
প্লানেটেরিয়ামের বাইরেও টাইসনের সরব উপস্থিতি। টাইসনের একটি অসাধারণ প্রতিভা আছে। তিনি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। এই গুণকে কাজে লাগিয়ে টাইসন নিজেকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। টাইসনের ভাষ্যমতে,
“আমার অনেকগুলো লক্ষ্য আছে। সব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয় জানি। তবে আমার খুব ইচ্ছে, মহাজগতের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সির রহস্যকে এই পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনে এনে উন্মোচিত করে দেবার। জ্ঞানপিপাসুরা জানতে চায়। আমি তাদের জানার পিপাসা বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে চাই। যদি একটি শিশু একটি ডিম নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, তাহলে তাকে ডিম ভাঙতে দেও। এর মাধ্যমে সে শিখতে পারবে ভঙ্গুরতা কাকে বলে।”
ততদিনে টাইসন তার জাদুকরী কণ্ঠ, হালকা হাস্যরসাত্মক বুলি এবং অসাধারণ পরিবেশনার মাধ্যমে সহকর্মী, দর্শনার্থী এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। টাইসনের কণ্ঠে বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বগুলো বেশ সহজভাবে উচ্চারিত হতে থাকলো। অচিরেই বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্রকারের নজরে পড়েন তিনি। তিনি এই সুযোগ লুফে নিলেন। ‘রিয়েল টাইম উইথ বিল মাহের‘, ‘দ্য কোলবার্ট রিপোর্ট‘, ‘দ্য ডেইলি শো’ এর মতো নামিদামি অনুষ্ঠানে টাইসন উপস্থাপক অথবা অতিথি বক্তা হিসেবে বাজিমাত করতে থাকেন। ঠিক একই সময়ে অ্যান ড্রুইয়ান তার কথা জানতে পারেন। তার মাথায় তখন চমৎকার একটি বুদ্ধি এলো। যদি টাইসনকে দিয়ে কসমসের মতো অসাধারণ কিছু পুনরায় সম্প্রচার করা সম্ভব হয়? তাহলে ব্যাপারটা বেশ চমৎকার হবে।
এক মহাজাগতিক যাত্রার গল্প
প্রায় তিন দশক পর কসমসকে নতুন রূপে দর্শকদের প্রত্যাশানুযায়ী উপস্থাপন করা এককথায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যেই বুঝি নিল ডিগ্রাস টাইসনের আগমন হয়েছিলো। অ্যান ড্রুইয়ান কসমসের প্রধান লেখিকা ছিলেন। এবারও তিনি কসমসকে ১৩ পর্বে সাজালেন। কসমসের নাম শুনেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল ড্রুইয়ানের সাথে কাজে যোগ দিলো। ব্রানোন ব্রাগা নিল ডিগ্রাস টাইসনকে খুব পছন্দ করলেন। কিন্তু কার্ল সাগানের কসমসকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য টাইসনকে এক অসাধ্য সাধন করতে হবে, তিনি সেটি বারবার জানিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন কসমসে বিভিন্ন ঘটনা অ্যানিমেশনের সাহায্যে চিত্রায়িত করা হলো। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে পুরো সিরিজটিকে আরো বেশি উপভোগ্য এবং দৃষ্টিনন্দন করে তোলায় কমতি রাখা হলো না।
স্পেস ডট কমের এক সাক্ষাৎকারে ড্রুইয়ান বলেছেন, “আমি প্রথম থেকেই জানতাম টাইসনই কসমসকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। যদি কারণ জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বলবো উনার ভাবভঙ্গি একদম আলাদা। একজন বিজ্ঞানী হয়ে ভালো বলতে পারার মতো অসাধারণ গুণ আর কয়জনের আছে আমার জানা নেই।” ড্রুইয়ানের সহকর্মী ব্রাগা বেশ কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলেন, “কসমসকে যদি এখনই ফিরিয়ে আনা না হয়, তাহলে কখন? অযৌক্তিক এবং অপ্রাসঙ্গিক চিন্তাধারা পুরো বিজ্ঞানকে কলুষিত করতে শুরু করেছে। বিজ্ঞান সবসময় প্রাসঙ্গিক। বাস্তবতা প্রাসঙ্গিক। প্রকৃতি প্রাসঙ্গিক। অপ্রাসঙ্গিক জ্ঞানের ঠাঁই এই বিশ্বজগতে নেই।”
তবে কসমসপ্রেমীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাদের সেই উদ্বিগ্নতাকে দূর করেন নিল ডিগ্রাস টাইসন। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ‘Standing Up in the Milky Way’ শিরোনামে প্রচারিত হয় নতুন কসমসের প্রথম পর্ব। এবার কসমস নামের সাথে জুড়ে দেয়া হয় “A Spacetime Odyssey” বাক্যটি। স্থান-কাল উপেক্ষা করে টাইসনের কাল্পনিক মহাকাশযানে চেপে বসে কোটি কোটি দর্শক রওয়ানা দিলো এক অবিস্মরণীয় যাত্রায়। এক ঘণ্টার প্রথম পর্ব শেষে সবাই অভিভূত হয়ে গেলেন। কার্ল সাগানকে যারা দেখেননি, তারাও যেন টাইসনের মাঝে সাগানকে খুঁজে পেলেন। সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসায় ধন্য হতে থাকলেন টাইসন। টাইসন বিশ্বাস করতেন, তিনি বাজিমাত করতে পারবেন এবং তিনি পেরেছিলেন। ১৩টি পর্বে নতুন কসমস ফের জ্ঞানপিপাসুদের নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করলো। নতুন কসমস অচিরেই সকল রেকর্ড ভেঙে সর্বাধিক সম্প্রচারিত বিজ্ঞানভিত্তিক সিরিজ হিসেবে নির্বাচিত হয়। অধ্যবসায়ের স্বীকৃতিস্বরূপ অ্যান ড্রুইয়ান জিতে নেন অ্যামি অ্যাওয়ার্ড।
নিল ডিগ্রাস টাইসনের বক্তব্য
হাস্যোজ্জ্বল টাইসনকে কসমস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান,
“কসমসকে যদি টিভি সিরিজ বলা হয়, সেক্ষেত্রে ভুল হবে। কসমসের উপর ভর করে আমি পুরো মহাবিশ্বকে নিজের খেয়াল খুশিমতো অবলোকন করে আসতে পারি। নক্ষত্ররাজি, গ্রহ, উপগ্রহ যেগুলো আমাদের পাঠ্যবইয়ের কতিপয় রঙিন কল্পনা হিসেবে বেঁচে ছিল, তা জ্ঞানপিপাসুদের বাস্তব চোখে দেখিয়ে দেয়ার মতো মহান কাজটুকু করার প্রচেষ্টা কসমস করেছে। কসমসের প্রতিটি পর্ব আপনাকে জানিয়ে দেবে, বিজ্ঞান মানে কয়েকটি বইয়ের পাতায় লেখা সূত্র নয়। বরং বিজ্ঞান একটি মহাকাব্য। সেই মহাকাব্য মানুষ দ্বারা রচিত। বিজ্ঞান মানে উৎসব, মানুষের কৌতূহলের বিজয়োল্লাস!”
টাইসনকে কসমসের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মুচকি হাসি দিয়ে উত্তর দেন, “কসমসের লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষকে বিজ্ঞানের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করা।”
কসমসের প্রত্যাবর্তন
২০১৪ সালের কসমসও ১৩ পর্বে এসে থেমে যায়। সেই বিংশ শতাব্দীর সাগানের কসমসের ন্যায় এবারও ভক্তদের থেকে কসমসের নতুন সিজন শুরু করার আবেদন দেওয়া হয়। কিন্তু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু কসমসপ্রেমীদের জন্য আছে সুখবর। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে কসমসের দ্বিতীয় সিজন সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন কসমস ভক্তের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্য নিয়ে প্রায় ৪৩টি ভাষায় সম্প্রচার করা হবে নতুন কসমসকে। কসমসের দ্বিতীয় সিজনের পর্ব সংখ্যা সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। তবে গতবারের মতো এবারও উপস্থাপনায় থাকছেন নিল ডিগ্রাস টাইসন।
২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দীর্ঘ বিরতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে অ্যান ড্রুইয়ান জানান, প্রথম সিজনের পর তার লেখার গতি কিছুটা কমে গিয়েছিলো। আর কসমসের জন্য নতুন গল্প অনুসন্ধানেও কিছুটা সময় লেগেছে।
ইংরেজি প্রবাদে আছে- Better late than never। কসমস যদি আরও কয়েক বছর পরেও ফিরে আসে, তাতে কসমসপ্রেমীদের আপত্তি নেই। শর্ত শুধু একটাই, ফিরে আসতেই হবে! বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশন করা দুর্দান্ত টিভি সিরিজ ‘কসমস’ নতুন আঙ্গিকে পুনরায় জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিবে, ব্যাপারটি ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছে ভক্তরা।
ফিচার ইমেজ: National Geographic