একজন পরিচালক তার জীবনে কয়টি ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন? ৫টি, ১০টি কিংবা ১৫টি? কিছুক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায়। খুব কম সময়েই আমরা দেখতে পারি একজন চলচ্চিত্রকার যতগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই ভালো। উদাহরণ হিসেবে সুইডিশ সিনেমার উজ্জ্বল নক্ষত্র ইংমার বার্গম্যানের কথা বলা যায়। নিজের জীবদ্দশায় তিনি নির্মাণ করেছেন ৪৯টি চলচ্চিত্র, যার মধ্যে ৪৫ ট ফিচার ফিল্ম, বাকি চারটি ডকুমেন্টারি। এত বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও তিনি সবসময় চলচ্চিত্রগুলোর মান বজায় রেখেছেন।
তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম না বললেই নয়: ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস’, ‘দ্য সেভেন্থ সিল’, ‘উইন্টার লাইট’, ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেক্সান্ডার’, ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান’, দ্য ভার্জিন স্প্রিং’, ‘অটম সনাটা’, ‘পার্সোনা’, ‘ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পার্স’, ‘দ্য সাইলেন্স’, ‘দ্য প্যাশন অভ অ্যানা’, ‘আওয়ার অভ দ্য উল্ফস’, ‘সিন্স ফ্রম অ্যা ম্যারেজ’। এই ১৩টি বাদেও তার আরো অনেকগুলো ভালো চলচ্চিত্রের নাম বলা যায়, তবে, অতগুলোর নাম বলে বিরক্ত করতে চাই না। প্রত্যেক পরিচালকেরই নিজের নিমার্ণ করা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্র থাকে। বার্গমানেরও আছে; সেই চলচ্চিত্রের নাম ‘পার্সোনা’।
তখন ১৯৬৩ সাল, তিনি মাত্র স্টকহোমে অবস্থিত রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। নতুন দায়িত্ব কাঁধে আসার পরেও চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে তিনি বিরতি নিতে চাননি। একইসাথে দু’টি কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ফলাফল হিসেবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, সঙ্গে আরো ছিল পেনিসিলিন পয়জনিং। সবকিছু মিলে তার সেরে উঠতে সময় লাগে ৯ সপ্তাহ। এই ৯ সপ্তাহে তিনি ‘পার্সোনা’র স্ক্রিপ্ট লেখা সম্পন্ন করেন।
চলচ্চিত্রের ধারণাটা তার মাথায় সর্বপ্রথম আসে অভিনেত্রী বিবি অ্যান্ডারসন ও লিভ উলম্যানকে সমুদ্রে রোদ পোহাতে দেখার সময়। বিবি অ্যান্ডারসন তার পুরনো কোলাবরেটর হলেও লিভ উলম্যান ছিলেন একেবারেই তার অজানা। তবুও, তাদের দুজনকে একসাথে দেখে তার মনে হয়, তারা দুজন নন, যেন দুজনে মিলে একজন। বার্গমান দেরি না করে সুইডিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তৎকালীন সিইও কেন ফান্টের সাথে যোগাযোগ করেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তার পরবর্তী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তহবিল তিনি দেবেন কি না। ফান্ট চলচ্চিত্রের প্লট সম্পর্কে জানতে চাইলে বার্গমান তাকে বলেন,
“চলচ্চিত্রটি এমন দুজনকে নিয়ে, যাদের মধ্যে একজন কথা বলতে পারে ও আরেকজন কথা বলতে পারে না এবং তারা একে অন্যের মধ্যে মিশে যাচ্ছে।”
এমন চলচ্চিত্র নির্মাণে তেমন খরচ হবে না ভেবে ফান্ট বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে যান। ১৯৬৫ সালের গ্রীষ্মে মাত্র দুইমাসে ‘পার্সোনা’র শ্যুটিং শেষ হয়।
চলচ্চিত্রটির গল্পের শুরুটা এভাবে,
বিখ্যাত গ্রিক ট্র্যাজেডি ‘ইলেক্ট্রা’য় অভিনয়ের সময় হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী এলিসাবেট ভোগলার। ডাক্তারের পরামর্শে তরুণী নার্স আলমার সাথে তাকে পাঠানো হলো সমুদ্র তীরবর্তী এক নির্জন কটেজে। সময়টা তাদের দারুণ কাটতে লাগল। একদিকে আলমা পেয়ে গেল একজন মনোযোগী শ্রোতা, যাকে সে তার জীবনের ঘটে যাওয়া অভিনব সব ঘটনা বলে যেতে লাগল। অন্যদিকে, ভগলার আলমার কথাগুলো শুধু শুনলই না, তাকে রীতিমতো অধ্যয়ন করতে শুরু করল। চলচ্চিত্রে সময় গড়ানোর সাথে সাথে আমরা দেখি, দু’জন যেন একটি ব্যক্তিসত্ত্বায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভগলার আর আলমার দুজনের চেহারার দুটোর অংশ এক হয়ে জোড়া লেগে যেন একজনে রূপান্তরিত হয়।
প্রধান দুই চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন বিবি অ্যান্ডারসন (আলমা) ও লিভ উলম্যান (ভগলার)। দারুণ সব শটের জন্য আলাদাভাবে সিনেমাটোগ্রাফার স্ভেন ভিলহেম নিকভিস্টের নাম তো বলতেই হয়।
ফ্রান্সের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার রবার্ট ব্রেসন একবার বলেছিলেন, “আমি চাইব, মানুষ কোনো চলচ্চিত্র বোঝার আগে সেটিকে যেন অনুভব করে।” পার্সোনা এমনই একটি চলচ্চিত্র যা বোঝার আগে অনুভব করতে হবে, অবশ্য হাজার চেষ্টা করলেও একবারে শতভাগ বোঝা যায় না। কারণ হিসেবে বলা যায়, এর বিষয়বস্তু একাধারে ব্যক্তিসত্ত্বা, দ্বৈতসত্ত্বা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, সমকামিতা, মাতৃত্ব, গর্ভপাতের মতো জটিল বিষয়গুলো। বার্গম্যান নিজেই বলেছেন, প্রত্যেক দর্শকের কাছে চলচ্চিত্রটি ভিন্নরকম লাগবে এবং চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে কারো সাথে কারো মতামত শতভাগ মিলবে না।
সুইডিশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কার্ল ইয়ুংয়ের তত্ত্বের সঙ্গে ‘পার্সোনা’র বিষয়বস্তু অনেকটাই মিলে যায়। প্রত্যেক মানুষেরই একটি অনন্য ব্যক্তিত্ব রয়েছে, যা সচরাচর প্রকাশ পায় না। কারণ, মানুষ অনেকটা শামুকের মতো। সে নিজের আসল ব্যক্তিত্বকে সর্বদা এক খোলসের মধ্যে আটকে রাখে। বাইরের জগতের সামনে সে নিজেকে তুলে ধরে অন্যভাবে। বাস্তবে সে যে অন্যরকম, তা অন্যকে জানায় না। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রায়ই সে একেকজনের সামনে নিজেকে একেকভাবে তুলে ধরে, এভাবে একের পর এক ব্যক্তিত্বকে সৃষ্টি করে সে।
কেবল নিজেই সে তার ‘আসল আমি’টাকে চেনে। বাইরের জগতের সামনে সেটা তুলে ধরলে তার নিজের ক্ষতি হবে, এ ভয়ে সে আমৃত্যু খোলসের আড়ালেই থেকে যায়। কেউই জানতে পারে না, সত্যিকার অর্থে সে কেমন ছিল। এমনকি সে নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারে না, সে সত্যিকার অর্থে কেমন, একসময় শামুক-খোলসের খেলা খেলতে খেলতে তার সেই বুদ্ধিও লোপ পায়। তখন সে পুরাতন কাপড় পাল্টানোর মতো করে নিজের তৈরি ব্যক্তিত্বের উপর হাতুড়ি চালায়, কখনোবা অভিনব কায়দায় সৃষ্টি করে নতুন কোনো ব্যক্তিত্বের। এভাবেই আমৃত্যু চলতে থাকে এই অভিনব খেলা, কেবল মৃত্যু ঘটলেই এর সমাপ্তি ঘটে।
মাত্র ৮৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র অগণিত সমালোচক, দর্শককে ভাবাতে বাধ্য করেনি; অনুপ্রাণিতও করেছে অসংখ্য পরিচালককে। ‘পার্সোনা’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্রের নাম দিয়ে শেষ করছি: মুলহল্যান্ড ড্রাইভ, মেলানকোলিয়া, ব্ল্যাক সোয়ান।