যারা যারা যৌথ বা বড় পরিবারে বড় হয়েছে, তাদের শৈশবের প্রথম ধাপ কেটেছে কীভাবে? এমন প্রশ্ন করলে বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোররা নানা রকম উত্তর দিতে পারে। কিন্তু প্রযুক্তি বিপ্লবের আগের সময়টাতে যারা শৈশব কাটিয়েছে তারা হয়তো বলতে পারে- তাদের শৈশব কেটেছে রূপকথা-কিছছা-গল্প শুনে। এই গল্প শোনার বিষয়টি এই একবিংশ শতাব্দীর আগে জন্মানো মানুষদের জীবনে একটি বড় অংশ জুড়ে মিশে আছে। হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় দাদীর কোলে বসে গল্প শোনার বিষয়টি বইপত্রে তুলে ধরা হলেও একসময় এটিই ছিল বাঙালি শিশু-কিশোরদের জীবনের একটি বড় অংশ।
তবে এখানে আমাদের গল্প শোনার বিষয়টি মুখ্য নয়, গল্পগুলো মুখ্য। শিশুদের আবদার মেটানোর জন্য সেকালের বয়োজ্যেষ্ঠরা নানারকম গল্প বানাতেন। তবে পুরোপুরি বানানো বললে ভুল হবে। গল্পগুলো হতো কিছুটা সত্য আর এর সাথে কল্পনা মেশানো রূপকথা ধরনের। সেসব গল্পে যেমন থাকতো রাজা-রানী বা ভুত-প্রেতেরা, আবার বিশেষভাবে থাকতো নির্দিষ্ট কিছু স্থানে প্রচলিত অদ্ভুত লোককাহিনী, যা কোনো পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ নেই, শুধু মুখে মুখে চলে এসেছে।
এই গল্প শোনার পর আসে জীবনের আরেক ধাপ। ব্যাটম্যান, সুপারম্যান ধাঁচের কমিক গল্পের দুনিয়া। এরপর আসে মিথোলজি। নর্ডিক মিথোলজির সেই থর ও লোকির কীর্তি। গ্রিক মিথে জিউসের কাহিনী। পার্সিয়াস বা হারকিউলিসের বীরত্বের গল্প। মিশরের অসীম ক্ষমতাধর দেব-দেবীর রোমাঞ্চকর কাহিনীগাঁথা। এসব মিথোলজি পড়ে সেসব কাল্পনিক বীরদের স্থানে নিজেদের কল্পনা না করে শৈশব পার করেছে, এমন মানুষ কমই আছে।
কিন্তু বড় হবার পর আমাদের মনে কখনো কি প্রশ্ন এসেছে, বিদেশি এসব পৌরাণিক কাহিনীর মতো আমাদের এই বাংলাদেশে কী আছে? আমাদের সংগ্রহে এমন বীরত্বের গল্পগাঁথা নেই, আছে সেই ছোটবেলায় মুখে মুখে শোনা লোককাহিনী। কোথাও লেখা নেই, অস্তিত্ব তো অবশ্যই নেই। এবং ধীরে ধীরে সেই গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝে থেকে। আর কালের আবর্তনে বর্তমানে বাংলাদেশের লৌকিক গল্প জানা মানুষও কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকলে গল্পগুলোর কী হবে? হারিয়ে কি যাবে চিরতরে?
হয়তো এরকম ভাবনা ও শঙ্কা এসেছিল লেখক রাজীব চৌধুরীর মাথায়। হয়তো মিথোলজিকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন বলে বাংলার এ গল্পগুলোর কিছু অংশ একত্র করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি লিখলেন ‘বঙ্গদেশি মাইথোলজি’। তবে লিখলেন বললে ভুল হবে। তিনি এই বইটি লিখতে গিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। গবেষণা করেছেন। তিনি যে অধিকাংশ সময় গল্প শুনেছেন, তার প্রমাণ বইয়ের পাতায়। কারণ এই বইয়ের অধিকাংশ গল্পের কোনো প্রমাণ নেই। কিছু নির্দিষ্ট জেলার নির্দিষ্ট মানুষ এ গল্পগুলো জানে। বিষয়টি লেখক ভূমিকাতেই বলে দিয়েছেন।
তাহলে এ গল্পগুলো কি মিথ্যা? তা-ও নয়। কারণ লেখক নিজেই বলেছেন,“এই গল্পগুলো কিছু মানুষের কাছে সত্য। কিছু মানুষ এই গল্পগুলো সত্যিই ঘটেছিল বলে ধারণা করে।”
বইয়ে প্রথম গল্পের নাম ‘বদর আউলিয়া উপাখ্যান।’ ইতিহাস বলে, তিনি জঙ্গল এলাকা চট্রগ্রামকে অশুভ শক্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে বসবাসযোগ্য নগরীতে রূপান্তরিত করেন। এজন্য চট্টগ্রামকে বদর পীরের চট্টগ্রাম বলা হয়। তবে চট্টগ্রামে হযরত বদর আউলিয়া (র.) এর গল্প লোকমুখে বিভিন্নভাবে শোনা যায়। তাই লেখক তার দৃষ্টিভঙ্গিতে হযরত বদর আউলিয়া (র.)-কে মুখ্য চরিত্র রেখে এ গল্পটি সাজিয়েছেন।
পরের গল্পটি ‘গাজী কলু চম্পাবতী’। একসময় এ লোকগল্প মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এখন তেমনটা শোনা যায় না। তবে ঝিনাইদহ গেলে বোঝা যাবে এ কাহিনীর আবেদন এখনো কেমন বহাল আছে। গাজী, কলু ও চম্পাবতীর মাজার ঝিনাইদহে অবস্থিত। গল্পটি মধ্যযুগের পাঁচালী কাব্যের অন্যতম উদাহরণ। ব্যাঘ্রদেবতা, গাজী পীর ও দক্ষিণ রায়ের মধ্যকার যুদ্ধের কাহিনী নিয়েই এ গল্পের প্রস্তাবনা। বিভিন্ন পটভূমিতে এ কাহিনী রচিত হলেও এ কাব্য-কাহিনী সম্পূর্ণই কাল্পনিক। গাজী-কলুর কথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শোনেনি, এমন লোক নেই। তবে লেখক যেভাবে এ গল্পটি উপস্থাপন করেছেন, লোকমুখে ঠিক এমনটি শোনা যায় না।
কক্সবাজারের একটি এলাকার নাম আলীকদম। কেন এ অদ্ভুত নাম? প্রচলিত আছে যে, হযরত শাহজালাল (র.) এর নেতৃত্বে ৩৬০ আউলিয়া ধর্মপ্রচারের জন্য সিলেট অঞ্চলে এলে সেখান থেকে তাদের একটি অংশ এ পার্বত্য এলাকায় আসেন। এদের কারো নামের অংশে আলী উপাধি ছিল। সেই উপাধি থেকে আলীকদম নামের জন্ম হয়। তবে এখানে একটি গুহাকে ঘিরে দারুণ এক রূপকথা ছড়িয়ে আছে পুরো কক্সবাজারে। সুন্দর উপস্থাপনায় সেটি উঠে এসেছে এখানে।
চন্দ্রদ্বীপ। বর্তমানে যা বরিশাল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। তখনো বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। পুরো ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের হাতে। ১৮৭০ সাল বা তার কিছু আগের বা পরের কোনো একটা সময়। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে এলাকার মানুষ। নিশুতি রাতের শুনশান ভেঙে দিলো বিকট এক শব্দ। কামান দাগানোর মতো সে শব্দ কোনোদিন দুটি হতো আবার কোনোদিন তিনটি। দিনের পর দিন চলতেই লাগলো। ব্রিটিশ এক ম্যাজিস্ট্রেট, হেনরি বেভারিজ তার লেখা বই ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ বইতে এই শব্দের কথা উল্লেখ করেছেন। সে সময় অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও এ রহস্যের সমাধান কেউ করতে পারেনি।
এই বরিশালেই জন্ম বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম সুফিয়া কামালের। তার আত্মজীবনীমূলক রচনা একালে আমাদের কাল বইতে এ শব্দের কথা উল্লেখ করে গেছেন। তার মতে শৈশবের এ রহস্যময় শব্দের কথা তিনি তার মামা এবং বয়স্কদের কাছে শুনেছেন। তবে এটাও উল্লেখ করেন যে, ১৯৫০ সালের পর থেকে এ শব্দ আর কেউ কখনো শোনেনি।
রাজীব চৌধুরী এ গল্পকেই তার বইতে জীবন্ত রূপ দিয়েছেন। গল্পে আছে হেনরি বেভারিজ, সুফিয়া কামলসহ আরো অনেক চরিত্র।
ঠগীদের কথা আমাদের সকলের জানা। এর মতো কিছু পথের খুনি আমাদের এ বাংলার বুকেও একসময় ছিল। যারা প্রায় ঠগীদের মতো আচরণ করলেও তারা খুন করতো জলপথে। তারা লোকজন ভরা কোনো খেয়া ঘাটে মাঝি সেজে বসে থাকতো যাত্রীর অপেক্ষায়। আবার কিছু লোক ডাঙায় ফাঁদ পাততো, তারপর যাত্রীদের কৌশলে নৌকায় এনে নির্জন জায়গায় নিয়ে প্রথমে লুট করে তারপর খুন করে পানিতে ডুবিয়ে দিতো। বাংলার এ ঠগীদের নাম ‘ভাগিনা’। রাজীব চৌধুরী তার বইয়ে এই ভাগিনাদের গল্প বলেছেন ‘ভাগিনা বিভীষিকা’য়।
প্রমত্তা পদ্মা নদী। এর তীরে অবস্তিত মহাকালগড়। এখানে বাস করতো মহাকাল দেবের পুজারি ‘দেও’ জাতি। আর ছিল প্রকাণ্ড এক মহাকাল মুর্তির মন্দির। অংশুদেও চান্দ ভন্ডি বর্ম্মাভোজ ছিল দেও আলয়ের সেবাইত। আর অন্য রাজা ছিল অংশুদেব খেজ্জুরচান্দ খড়গ বর্ম্মা গুজ্জভোজ। এই মন্দিরে নরবলি দেবার জন্য দুর দুরান্ত থেকে মানুষ কিনে আনা হতো। মাঝে মাঝে রাজাদের জবরদস্তিতে জোর করেও মানুষ ধরে এনে নরবলি দেওয়া হতো। এই মহাকালগড় ও নরবলির মতো ঘটনার সাথে মিশে আছেন এক মহামানব। হযরত শাহ মখদুম (রা.)। এই সত্য গল্পই লেখক তুলে ধরেছেন ‘নরবলি’ গল্পে।
এতে আরো আছে ভাওয়াল রাজার মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার সত্য গল্প, চা বাগানে বিভীষিকা, কমল বাওয়ালির বীরত্ব, দক্ষিণের কুড়িটিলায় এক রহস্যময় কালো পাথরের কাহিনী, নবাব সিরাজউদ্দৌলার অজানা এক সত্য গল্প। এগুলো পাঠককে অবাক হতে বাধ্য করবে।
কেন এ বইটি বাংলাদেশের সাহিত্যের বিশেষ একটি স্থান দখল করবে সে প্রসঙ্গে আসার আগে লেখকের সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। রাজীব চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামে। পেশায় তিনি স্থপতি, তবে লেখালেখি করছেন কয়েক বছর ধরে। নিজের ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করেন তিনি। বঙ্গদেশি মাইথোলজি প্রকাশ পাবার আগে তার বই প্রকাশ হয়েছিল ৩টি। এই বইয়ের মাধ্যমেই লেখক প্রথম নন-ফিকশন জগতে পা রেখেছেন।
বঙ্গদেশি মাইথোলজি বইয়ের বেশিরভাগই কাল্পনিক। তবে গল্প হবার কারণে সত্য গল্পেও নানা ধরনের মিথ্যা লুকিয়ে আছে। সেগুলো যেমন চিহ্নিত করা দুষ্কর, আবার বাদ দেওয়াও দুষ্কর। এমন কিছু কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো সত্যিই আমাদের বাংলার বুক একসময় ঘটেছিল। আর লোকমুখে সেগুলো চলে এসেছে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে।
সেসব গল্পকে তুলে ধরা একটি জটিল প্রক্রিয়া। লোকমুখে প্রচলিত বা অপ্রলিত কোনো গল্পকে লেখার মাধ্যমে ফুঁটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। লেখক এখানে গল্পগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাতে কাহিনীর গভীরতা ও আবেদন অনেক বেড়ে গেছে। যেটা এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য একটি দিক।
রাজীব চৌধুরীর এই বইটি হয়তো ছোট, তবে বাংলার মিথ প্রসঙ্গে বেশ ভালো একটি সংযোজন। গল্পগুলো আপনাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা দেবে, আরো ধারণা দেবে সে অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে।
শেষ বেলায় একটি কথা বলা উচিত। এই বইয়ের কাহিনীগুলো যেহেতু গল্পের রূপে উপস্থাপিত হয়েছে তাই এগুলোকে ইতিহাস ভেবে নিলে ভুল হবে। এগুলোকে নিছক গল্প হিসেবে বিচার করলেই বরং ভালো হবে।
এ গল্পগুলো আমাদের ঐতিহ্য, লৌকিক সংস্কৃতি ও জীবনবোধের পরিচয় বহন করে। গল্পগুলো বেঁচে থাকুক প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ধীরে ধীরে আরো সমৃদ্ধ হোক এরকম দেশীয় উপকথার ভাণ্ডার।