আবু হাসান বুঝতে পারে, মানুষ আসলে একা। সামাজিক যোগাযোগের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ প্রতিদিন কুড়িয়ে নিচ্ছে অসংখ্য সামাজিক শূন্যতা। আবু হাসান জানে, এই পৃথিবীতে এখন প্রেম মানে শূন্যতার বিনিময়। প্রতিটি সঙ্গমে শরীর থেকে উড়ে যায় শূন্যতার চিল। আবু হাসানের যৌনচেতনায় নারীর শরীর আজ ব্যর্থতার গ্লানি বয়। এই শহর, শহরের দালান, অকেজো সিগন্যাল বাতি আর অসংখ্য যন্ত্রের কথা ভেবে আবু হাসান ফিরে আসে হস্তমৈথুনে। সে টের পায়, মানুষ তার কাছে হয়ে পড়ছে অপাঙ্কতেয়। সে হাত বুলায় যন্ত্রের শরীরে, চুমু খায়। স্ত্রীর সেই ক্রোধকে করুণা করে আবু হাসান।
এই ক্রোধ সকল মানুষের ক্রোধ। পৃথিবীর মানুষেরা প্রতিদিন এভাবে হেরে যাচ্ছে আর তীব্রভাবে সাড়া দিচ্ছে ক্রোধাগ্নি জ্বালিয়ে। এই যন্ত্রসভ্যতার সামনে আজ নারীর যোনি-স্তন কিংবা পুরুষের শিশ্ন মুখ থুবড়ে পড়ছে। কাটা চামচে গাঁথা এই গোটা সভ্যতার শরীর। ঘন্টায় ১৬ মিলিয়ন মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়ে যাবার এই সকালে বাস থেকে নামার পর আবু হাসানের ইচ্ছে করে মালঞ্চ রেস্তোরার কলিজা সিঙারা মুখে পুরতে, যেমন করে এক বিশাল হাঁ-তে চালান হয়ে যাচ্ছে গোটা মানব সভ্যতা।
কে এই আবু হাসান ? আবু হাসান, ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে নয় বছর যাবত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করা সেই মানুষটি, কোনোকিছুই যাকে আর আলোড়িত করে না। জীবন, আবু হাসানের কাছে একটি নিতান্ত আলোড়নহীন ধারণা। এমনকি জীবনের বিনাশও তা-ই। সাতপাঁচ ভেবে হাঁটতে হাঁটতে আবু হাসান ফিরে যায় ২২ বছর আগে তার ছেলেবেলার একটি দিনে। সেদিন সিলিংয়ে ঝুলে থাকতে দেখেছিল সে মায়ের নিথর মৃতদেহ। সেই দেখার মাঝে কোনো বিষাদ সে অনুভব করতে পারেনি। আবু হাসান সে-নিয়ে অনেক ভেবেছিল, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি তখন। পরে ব্যাখ্যা দাঁড় করালো, বিষাদ অনুভব করেনি কারণ এসব কোনো অর্থ রাখে না তার কাছে।
তা ভাবতে ভাবতে আবু হাসানের চিন্তাগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে ফিরে ফিরে যায় মেহেরজানের কাছে, যায় ময়না ভাইয়ের উপুড় হয়ে থাকা লাশের পাশে, যায় ১০ বছর আগে বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে অকারণে খাওয়া এক কাপ চা এবং অকারণে পড়া সেই প্রেমের সন্ধ্যায়। তার চোখে ভাসতে থাকে ইয়েমেনি শিশুদের লাশ, দুই লক্ষাধিক ধর্ষণের শিকার নারীর লাশ যা বাড়ছে সময়ের সাথে সাথে, রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়ত চাকা, জলবায়ুর আমূল পরিবর্তন, ডাটার বাহারে হারিয়ে যাওয়া মানুষের শূন্য এই পৃথিবীর সকল নিয়মতন্ত্র। আবু হাসানকে গ্রাস করেছে জীবনের নানামুখী পরাবাস্তবতা। সে তাতে হারিয়ে গিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে চোখ মেলে অপেক্ষা করতে থাকে আসন্ন পৌষের। পৌষ কি তবে বদলে দেবে জীবনের সকল জ্যামিতিক সমীকরণ?
‘রুদ্রপ্রহর’, ‘কাঁচা দুধের গন্ধ’, ‘রক্তকিংশুক’ উপন্যাসসমূহের লেখক মারুফ রসূলের দশম উপন্যাস এই ‘কাঙ্খিত মৃত্যুর খসড়া’। আকৃতির দিক থেকে অবশ্য উপন্যাসিকা। কিন্তু বিস্তৃতিতে উপন্যাসের সেটিংই বেছে নিয়েছেন লেখক। তাই ৭৯ পৃষ্ঠার এই বইকে তিনি বলছেন উপন্যাস।
মারুফ রসূলের এই উপন্যাস বস্তুত জীবনের কতগুলো সারিবদ্ধ গল্প। মগজে নেমে আসা স্তব্ধতা, অপসৃয়মান মন ও বেহাত হয়ে যাওয়া ব্যক্তিগত অনুভূতির সবটুকু এই উপন্যাসে ছিন্ন খঞ্জনীর মতো সাজিয়েছেন লেখক। তিনি এই উপন্যাসে উদ্যমী জীবন নয়, বরং একটি প্রার্থিত মৃত্যুকে রচনা করতে চেয়েছেন। একটি জীবনের যাবতীয় সকল ব্যর্থতায় লুকিয়ে থাকা নৈরাশ্যের ক্রুর শব্দ ভেসে ভেসে আসে উপন্যাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, যা ছড়ায় পাঠকের মনেও। পাঠকের ভাবনার দেয়ালে আঘাত করে এই উপন্যাস।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবু হাসান; সন্তানের মুখ, নারীর আদর, পৃথিবীর মায়া, জীবনের বিস্বাদ সব পিছে ফেলে মৃত্যুর খসড়া রচনা করে। কারণ এই জীবনের অপার অর্থহীনতার গোমর সে আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই চরিত্রের মাঝ দিয়ে লেখক বয়ান রেখেছেন জটিল সব বিষয়াদির। নোংরা রাজনীতি, বিকল রাষ্ট্রযন্ত্র, ধসে পড়া সমাজব্যবস্থা, প্রযুক্তির ভয়াবহতা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো এই শতকের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং বিপজ্জনক বিষয়াদি নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশাপূর্ণ বক্তব্যের বয়ান উপস্থাপন করেছেন তিনি।
যন্ত্রের শরীরে হাত বুলিয়ে তাতে নারীর শরীরের কোমলতা পাওয়া, বড় দালানের আকৃতি দেখে হস্তমৈথুন করা; এই বিষয়গুলো যতখানি অস্বস্তিদায়ক, ততখানিই নিগূঢ়। যন্ত্র আর পুঁজিবাদের আগ্রাসন দুটোই এই বিষয়ে সরাসরি অবস্থানে চলে আসে। উপন্যাসে মানুষের অস্তিত্ববোধের চেতনা নিয়েও উঠে এসেছে গূঢ় বিষাদ। মানবতার জয়গান নয়, বরং পারমাণবিক বোমা আর অস্ত্রের মিছিলে, অসুস্থ যুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়া মানবতার করুণ ব্যর্থতার দলিল হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস।
ঔপন্যাসিক মারুফ রসূল প্রচন্ড রাশভারী ভঙ্গীতে লিখেছেন উপন্যাসখানা। সহজ, সরল ভঙ্গীমা তিনি অনুসরণ করতেও চাননি। কারণ বিষয়াদিই ততখানি জটিল। তাই সরলীকরণ না করতে চাওয়া এক্ষেত্রে যথোপযুক্ত। গল্পের বয়ানভঙ্গীও সরল নয়। মোটাদাগে, কোনো নির্দিষ্ট গল্পও নেই এই উপন্যাসে। একটি চরিত্রের রোজকার কিছু রুটিনবাঁধা কাজ কিংবা ঘটনার বর্ণনা, যে ঘটনাগুলোর ভেতরের অর্থহীনতা গভীরভাবে রেখাপাত করে প্রধান চরিত্রটির দর্শনে। এবং সেই অর্থহীনতা প্রধান চরিত্রটির ভেতরে জন্ম দেয় কিছু বিক্ষিপ্ত চিন্তার। এই বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোই আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত, কিন্তু তার মাঝেই খুঁজে নেওয়া একটি সংহতিপূর্ণ উপায়ে বর্ণিত হয়েছে গোটা উপন্যাসে।
লেখক থার্ড পারসন ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার বেছে নেওয়ায় ‘আবু হাসান’ চরিত্রের চিন্তাচেতনার সবটুকু সম্বন্ধেই জানাতে পেরেছেন পাঠককে। এক সর্বদর্শী চোখ এই থার্ড পারসন ন্যারেটিভ। তৃতীয় একটা চোখ অদৃশ্য হয়েই সবকিছু দেখছে যেন। ঢুকে যেতে পারছে বাধাহীনভাবে যেকোনো কিছুতে। এই ন্যারেটিভ বেছে নেওয়ার ফলে চরিত্র এবং চরিত্রের জগতের সবটা সম্বন্ধে জেনে যেতে পারার সুবিধাটা ভালোভাবেই নিয়েছে এই বই। তবে এই সর্বদর্শী দৃষ্টি আবু হাসানের চারপাশের গন্ডিতেই থিতু ছিল। যেন আবু হাসানেরই অবচেতন দৃষ্টি সেটা। এই চরিত্রের মাঝেই অবশ্য মিশে আছে লেখকের নিজস্ব দর্শন। এই হতাশা, ক্ষোভ সব যে লেখকের নিজেরই দর্শনলব্ধ।
এবং এতে একমাত্রিক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারখানাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বাকি চরিত্রগুলোর গড়ন সংকীর্ণ। এক্ষেত্রে অবশ্য আবু হাসানের চিন্তার দুনিয়ায় তাদের স্থান না থাকাটা অপর পক্ষের যুক্তির কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু চরিত্রের মনস্তত্ত্বের এবং নৈরাশ্যবাদের অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাঠককে দিতে পারতো উপন্যাসের বাকি চরিত্রগুলোর শক্ত গাঁথুনি। এছাড়া মারুফ রসূলের বাক্যের গঠনে সংশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল মাঝেমধ্যে, যা পাঠকের পাঠক্রিয়ায় বিচ্যুতিযুক্ত করে।
শেষতঃ কাঙ্খিত মৃত্যুর এই খসড়া জীবনমুখী নয়। এই বই অনিবার্য মৃত্যুর গভীরতম সত্যগুলোকে তুলে এনে কাঙ্খিত করেছে সেই মৃত্যুকে। পাঠকের মনে হতে পারে, এই উপন্যাস অর্থহীন। কিন্তু সচেতন পাঠে অর্থহীনতার ভেতরের কঠিন সত্যগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আর সেই উপলব্ধির দোরগোড়ায় পাঠককে দাঁড় করিয়েই সার্থক হয়েছে এই উপন্যাস। কাঙ্খিত মৃত্যুর খসড়া গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তার বিষয়াদি এবং বক্তব্য। পৃথিবীর বাড়তে থাকা তাপমাত্রায় পৌষের কুয়াশাদের অস্তিত্বহীনতাই কুণ্ঠাহীনভাবে পাঠককে মুখোমুখি করে এক নির্মম সত্যের।
…
বই: কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খসড়া
লেখক: মারুফ রসূল
প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০ টাকা