“জাফর সাদেক তাকে প্রশ্ন করেছিলো, স্বাধীন দেশে তার কেমন লাগছে? দ্রুত চোখের পলক ফেলে শেফালি সোজা ক্যামেরায় চোখ রেখেছিল। একটু আগের কোঁচকানো চোখের পাতা, পরিপাটি আলোটা যেন তাকে আর বিরক্ত করছে না। শেফালি ধীরে, পরিষ্কার গলায় বলেছিল, দেশটা স্বাধীন হয়ে তাকে পরাধীন করেছে। যুদ্ধটা যদি না হতো তাহলে তার মত লাখ লাখ মেয়েদের জীবনটা বরবাদ হত না।”
লেখক ওয়াসি আহমেদ বোধহয় এই বই লেখার সময় কল্পনাও করেননি যে, মুক্তিযুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে রচিত অন্যতম সেরা বই-ই তিনি লিখতে যাচ্ছেন। যেখানে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে উপেক্ষিত অংশ— বীরাঙ্গনাদের দুর্ভোগ, বাংলার রক্ষণশীল সমাজের অকৃতজ্ঞতা, লোকচক্ষু এড়িয়ে যুদ্ধশিশুদের যাযাবরের মতো জীবন— নিরাপত্তার ভয়ে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়ানো। যুদ্ধকালে হানাদার বাহিনীর কাপুরুষোচিত অত্যাচারের শিকার, আবার সদ্য স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের নানা অনাচার।
বইয়ের গল্পটা রেখাবু-শেফালি-চম্পাবু-জবা-জাফর সাদেক চরিত্রগুলোকে পাথেয় করে এগিয়েছে। শেফালি বেগম, পালিয়ে বেড়ানো এক বীরাঙ্গনা। যার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে সে পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়া। তার দোষ হচ্ছে সে বীরাঙ্গনা উপাধিপ্রাপ্ত। এই রক্ষণশীল সমাজে তার মুখ দেখানো মানা। চম্পা— যে একজন যুদ্ধশিশু, যাকে নিরাপদ ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য তার মা শেফালি তাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক রেখা বুবুর কাছে রেখে গিয়েছিল। রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিতে তারও একটা গুরুতর দোষ আছে। তার দোষ হচ্ছে সে একজন যুদ্ধশিশু— যার জন্ম হয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্রে, পিতৃপরিচয়হীনতা নিয়ে। যার জন্য তাকে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কারণে দূর করা হয়েছে। যাকে এখনো তার মেয়ে জবাকে নিয়ে নিজের যুদ্ধশিশু তকমা থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে বেড়াতে হয় নিজের স্বামী, পরিবার ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে।
রেখা, যাকে শেফালি রেখাবু বলে ডাকে। সে-ই শেফালিকে পাকিস্তানি সেনা বাংকার থেকে উদ্ধার করে পুনর্বাসন কেন্দ্রে এনে পুনরুজ্জীবিত করেন। যার কাছে বড় হয়েছেন শেফালির মেয়ে চম্পা, এবং চম্পার মেয়ে জবা। চম্পার মেয়ে জবার পিতৃপরিচয় থাকার পরও জবা বের হতে পারে না চম্পা-শেফালির জীবনের বৃত্ত থেকে। শেফালির মতো আরও অনেককেই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আগলে রেখেছিলেন রেখা। আর তার ভাষ্যে, এবং তাকে কেন্দ্র করেই গড়িয়েছে পুরো বইয়ের কাহিনী।
এই বইয়ের আরও এক অন্যতম চরিত্র জাফর সাদেক। উন্নত জীবন এবং ফটোগ্রাফির নেশায় পড়ে যুদ্ধের আগে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। যার কাছে আদতে নিজ দেশের কোনো মূল্য ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে হঠাৎ একদিন পত্রিকায় এক পাকিস্তানি কমান্ডারের সাক্ষাৎকারের এক অংশে চোখ আটকে যায় তার,
“This is war, you rape the woman.”
এটা দেখার পর তার টনক নড়ল, তিনি বুঝতে পারলেন যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থা দেশের নারীদের। আর তারপরই দেশে ফিরে এসে ‘শাপলা’ নামক এক অর্গানাইজেশনের সাথে যুক্ত হন। তোড়জোড় করে কাজে নেমে পড়লেন ধর্ষক, পাষণ্ড হানাদার বাহিনীর জেনেভা ক্রাইম ল-এর যুদ্ধাপরাধের আওতায় আনতে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সহকর্মী ফাহমিদা, এবং অ্যানমেরিকে সঙ্গে নিয়ে প্রমাণ জোগাড় করতে নেমে পড়লেন মাঠে।
যেকোনো যুদ্ধেই নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে হয় নারী ও শিশুদের। সব যুদ্ধেই বিঘ্নিত হয় নারীদের নিরাপত্তা। নারীদের ব্যবহার করা হয় War-Weapon হিসেবে। উন্নত বিশ্বে যুদ্ধে অত্যাচারিত হয়ে পরবর্তীতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলেও তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত, রক্ষণশীল দেশে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা হয় না তাদের। নারীদের পদে পদে পোহাতে হয় বিড়ম্বনা, গ্লানি। ‘বরফকল’ বইয়ে সেই গল্পই বলেছেন লেখক ওয়াসি আহমেদ।
এই বই আসলে ইতিহাস-আশ্রিত বাস্তববাদী ফিকশন। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে এগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক লেখা হলেও এটা যুদ্ধমুখী গল্প নয়, গল্পটা জীবনমুখী। গল্পে যুদ্ধের চেয়ে অধিক আলোকপাত করা হয়েছে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনাদের দুর্ভোগ, আর তাদের পালিয়ে বেড়ানোর কথা। এতে প্রাধান্য পেয়েছে একজন বীরাঙ্গনা ও তার পরবর্তী দুই প্রজন্মের নিগ্রহের কথা। উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন। চিহ্নিত হয়েছে বাঙালির নারীকেন্দ্রিক রক্ষণশীলতা নামক দগদগে ঘাঁর কথা। আসলে এটা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির দর্পণস্বরূপ। এখনও বাংলাদেশ একাত্তরের সেই হানাদার মানসিকতা নিয়ে ঘুরছে। সেই একাত্তরে যেমন পাকসেনাদের দ্বারা অত্যাচারিত নারী জায়গায় জায়গায় উপেক্ষা এবং পীড়নের শিকার হতো, ঠিক তেমনি এখনও এদেশে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের মুখ গুঁজে থাকতে হয় সমাজ থেকে। সন্দেহের আঙুল সেসময়ের মতো এখনও ঘুরে-ফিরে স্থির হয় ধৃত, অত্যাচারিত নারীর দিকে।
গল্পের প্লট যতটা চমৎকার, ঠিক ততটাই চমৎকার লেখক ওয়াসি আহমেদের লেখার ধরন। পুরো গল্পে মায়াময় লেখায় ফুটে উঠেছে চম্পা-শেফালি-রেখার মানসিক দ্বন্দ্ব। গল্পের কোথাও আবেগের আশ্রয় নেননি লেখক। লিখে গেছেন ঝড়ের মুখে উড়ে চলা পাতার মতো। চরিত্রগুলোকেও তুলে ধরেছেন অমায়িকভাবে। কিছুটা আক্ষেপ, কিছুটা বিষণ্নতা, কিছুটা আশা-নিরাশা, এবং চম্পা-জবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে সুখপাঠ্য বইটি।
লেখক পরিচিতি
লেখক ওয়াসি আহমেদের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ অক্টোবর সিলেটের নাইওরপুলে। স্কুলের পাঠ সিলেটের বিভিন্ন জায়গায়। পরবর্তী শিক্ষাজীবন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু। ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘শবযাত্রী স্বজন’। কথাসাহিত্যে, বিশেষ করে গল্পে মনোনিবেশ করেন আশির দশকে। প্রথম গল্প সংকলন ‘ছায়াদন্ডী ও অন্যান্য’ (১৯৯২), প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়’ (২০০০)। তার গল্প ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি ও আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবি হিসেবে বিদেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নানা অঙ্গনে। বর্তমানে একটি ইংরেজি দৈনিকে সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু সাহিত্য পুরস্কার।