সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত তারকাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র অপারেশন সুন্দরবন নিয়ে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ সরব। সিনেমা হলে চলমান অ্যাকশনধর্মী সিনেমাটি ইতোমধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করতে পেরেছে তরুণ দর্শকদের মাঝে। ঢাকা অ্যাটাক খ্যাত পরিচালক দীপংকর দীপন এবার বেশ সময় নিয়ে মুক্তি দিয়েছেন তার দ্বিতীয় ছবি। বাংলাদেশের চেনা মুখদের সাথে কলকাতার শিল্পীদেরও তিনি যুক্ত করেছেন এই প্রজেক্টে।
অপারেশন সুন্দরবন (২০২২) আপাদমস্তক অ্যাকশন ফিল্ম। বাংলাদেশের বিশেষায়িত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করার সাহসী অভিযান এবং তাদের নির্ভীক জীবনসংগ্রাম থেকে প্রেরণাপুষ্ট এর চিত্রনাট্য।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আক্রান্ত জলদস্যুদের হাতে। বছরের পর বছর ধরে এই এলাকার মানুষ ও জীবজগতের ওপর চলছে এই দস্যুদের অত্যাচার। তাদের হাত থেকে সুন্দরবনকে মুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে অভিযানে নামে র্যাবের বিশেষ স্কোয়াড। অভিযানের এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারে, সুন্দরবনের জলদস্যুরা কোনো বড় অশুভশক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা পুতুল মাত্র। সেই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে তাদের লড়াই শুরু করতে হবে। এই গল্প নিয়েই সিনেমা অপারেশন সুন্দরবন।
নির্মাতা দীপংকর দীপন নিজেই এই চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখেছেন। সুন্দরবনের অপরাধচক্র এবং জলদস্যুদের পাকড়াও করার অভিযানের গল্পে রেখেছেন একের পর এক লেয়ার। তবে এই লেয়ারগুলোতে ছিল কিছুটা বৈচিত্র্যের অভাব, ফলে তৈরি হয়েছে একঘেয়েমি। বনদস্যু কাদের ধরা পড়লে জানায় গজাল ডাকাতের কথা, গজাল ডাকাত ধরা পড়লে বলে মনা ডাকাতের কথা, মনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় র্যাব সন্ধান পায় হাবিব রাজার… এভাবেই চলতে থাকে! ফলে স্ক্রিনে গৎবাঁধা ধারাবাহিক কাঠামোর বিন্যাস কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করেছে।
চলচ্চিত্রের শুরুতে টাইটেল কার্ডে টু-ডি অ্যানিমেশনে জলদস্যুদের উৎপত্তি ও অতীত ইতিহাস আংশিকভাবে উঠে আসে ধারাবর্ণনায়। অ্যানিমেশনের মোহনীয়তা কাটতে না কাটতেই ডিসক্লেইমার অংশে একটি বিষয় খাপছাড়া মনে হয়েছে। স্পষ্টভাবে যেখানে প্রথম বাক্যে একে ‘ফিকশন ফিল্ম’ দাবি করা হয়েছে, সেখানে দ্বিতীয় বাক্যে ফাইটিং তথা মারামারির দৃশ্যের ‘সিনেম্যাটিক’ উপস্থাপনের কথা উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না।
লাইভ অ্যাকশনের শুরুতে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইশতিয়াককে বেশ নিষ্ঠাবান, কর্মঠ অফিসারের ভূমিকায় দেখা যায়। কোর্সমেট লেফটেন্যান্ট রিশান এবং মেজর সায়েম চরিত্র দুটোতে জিয়াউল রোশান ও সিয়াম আহমেদ সত্যিকারার্থে মুগ্ধ করেছেন শারীরিক ভাষায়। তবে সিও চরিত্রে রিয়াজ আহমেদের কণ্ঠে অতি-অভিনয়ের ছাপ শ্রুতিকটু লেগেছে। পাশাপাশি, তার বডি মুভমেন্ট আর এক্সপ্রেশনও যথাযথ মনে হয়নি। অন্য চরিত্রগুলো সে তুলনায় বেশ ভালো করেছে। লেফটেন্যান্ট রিশান ও মেজর সায়েমের প্রতি মুগ্ধতাকে খানিকটা ম্লান করেছে অযাচিত রোম্যান্টিক দৃশ্যের সংযোজন। ফিল্মকে জোরপূর্বক বাণিজ্যিক ঘরানায় রূপ দেবার এই প্রয়াস নিরপেক্ষ যেকোনো দর্শকের কাছেই নিন্দনীয় প্রচেষ্টা বলে মনে হতে বাধ্য। পাঁচটি গানের মধ্যে শুধুমাত্র শেষ ট্র্যাকটি বাদে বাদবাকি কোনোটিই গল্পে প্রাসঙ্গিকতা আনেনি। ঠিক তেমনিভাবে টাই হারুন চরিত্রটি কমিক রিলিফের পরিবর্তে চটুল বিনোদনের প্রয়াস বলে মনে হয়েছে।
সরলরৈখিক গল্প হবার পরও কাহিনীর ভারসাম্য রক্ষায় বেগ পেতে হয়েছে পরিচালককে। ডাকাত সাজুকে সুস্থ করার জন্য ডাক্তার অদিতির যে আকুল ইচ্ছা দেখা গেছে, তা খুব একটা বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। একইভাবে, বাঘ শুমারিতে কী এমন বিশেষ প্রয়োজনে তানিয়ার টিমে রাকিবকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তারও কোনো সদুত্তর শেষপর্যন্ত মেলে না। এমনকি, পুরো ফিল্মে কিছু বিরক্তির অভিব্যক্তি দেয়া ছাড়া তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ফলে এরকম অহেতুক খরচের খাতায় ফেলে দেয়ার মতো অনেক চরিত্র ও দৃশ্য কেবল সিনেমার ব্যাপ্তিই বাড়িয়েছে।
সাজু চরিত্রে অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা এবং চরিত্রের বিকাশের জন্য অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক ও পরিচালক দীপন দুজনই ধন্যবাদ পেতে পারেন। অবশ্য এখানেও বিপত্তি বাধায় সাজুর প্রেমিকা চরিত্র পাখি। ফিল্মের আগাগোড়া কোথাও পাখির ন্যূনতম অবদান নেই। শুধু তা-ই না, অপারেশন সুন্দরবন-এ কিছু নারী চরিত্রকে যেন রাখাই হয়েছে নিছক প্রেম করার জন্য। এদিক থেকে পাপড়ি কিঞ্চিৎ গুরুত্ব পায় বলে মনে হলেও, সেটিও আহামরি নয়। কেননা, আহরিত সব তথ্যই আসে সরাসরি অপারেশনগুলো থেকে। অর্থাৎ, চলচ্চিত্রে পাপড়ির থাকা না থাকায় আসলে কিছুই যায়-আসে না। একই কথা প্রযোজ্য হবে সাংবাদিক পলাশের বেলায়। কারণ, এনজিও কিংবা পাপড়ির সাথে সাংবাদিকের সম্পর্কের ন্যারেটিভ বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না।
সিনেমায় রিশান এবং সায়েম ছাড়া বাকিদের চরিত্র ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিছু কিছু চরিত্র এবং সিকোয়েন্স অপ্রয়োজনীয়, অহেতুক এবং কখনো কখনো কাল্পনিক, বা অবান্তরও মনে হয়েছে। যেমন- হাবিব রাজার জাহাজে তানিয়ার গোপনে ভিডিও ধারণ গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। ভেঙে টুকরো টুকরো করা মেমোরি কার্ডে ভিডিও থাকার বিষয়টিও বোধগম্য হয়নি। আবার একজন খুনি ডাকাত সাজুকে গ্রেফতার কিংবা বিচারের সম্মুখীন করার মতো পদক্ষেপ নেয়ার বদলে র্যাবের সিও-র অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণও অবাক করেছে।
ফিল্মের সিনেমাটোগ্রাফি প্রশংসা করতেই হবে। অ্যাকশন ছবি হিসেবে অপারেশন সুন্দরবন ভিজুয়ালি স্বস্তিদায়ক অভিজ্ঞতা দেয়। বোটে করে ধাওয়া করার দৃশ্যগুলো ভীষণ ভালো হয়েছে। অ্যারিয়েল ভিউ শটে সুন্দরবনকে দারুণভাবে দেখিয়েছে এ সিনেমা। আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম, মেকাপও যথাযথ ছিল। তবে সুন্দরবনের শ্বাসমূল বার বার না দেখিয়ে বৈচিত্র্যময় নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর দেবার সুযোগ ছিল। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কাহিনী হিসেবে চাহিদা থাকলেও, পশু-পাখি দেখানোর সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করা হয়নি। আর যখন সিজিআইতে বাঘ ও সাপ দেখানো হয়েছে, তখন না চাইলেও যেন কারিগরি ত্রুটিই চোখে পড়েছে বেশ। ভিএফএক্স অপরিপক্ব মনে হয়েছে। সম্পাদনা সব মিলিয়ে ভালো হলেও, লো লাইট ট্রিটমেন্টে সম্পাদক সুবিধা করতে পারেননি, সেখানে কালার গ্রেডিং ঠিক থাকেনি। এছাড়া সার্বক্ষণিক হাই বিট ব্যাকগ্রাউন্ড গল্পের গতির সাথে ভারসাম্য রাখতে পারেনি, কোনো কোনো দৃশ্যে একদমই বেখাপ্পা ছিল। গল্পের লেয়ার, রহস্যজট, এবং টুইস্ট সাদামাটা না হয়ে বরং আরও চমকে দেবার মতো হলে বেশ ভালো লাগত।
তবে মোটের ওপর অপারেশন সুন্দরবন সবাই মিলে হলে গিয়ে উপভোগ করবার মতোই সিনেমা হয়েছে। হাওয়া, পরাণ, বিউটি সার্কাস, অপারেশন সুন্দরবন- এই সিনেমাগুলো এখন দাপটের সাথে সিনেমা হলে যেভাবে দর্শকদের মাতিয়ে রাখছে, তাতে সিনেমাপ্রেমীরা দারুণ আনন্দ পাবেন। নিষ্ঠাবান এক বাহিনীর অকুতোভয় অভিযানের গল্প অপারেশন সুন্দরবনের কাহিনীর কিছু বাড়তি মেদ ছাঁটাই করা গেলে, সিনেমাটি নিঃসন্দেহে আরও উপভোগ্য ও শ্বাসরুদ্ধকর হতে পারত!