রাফিউজ্জামান সিফাতের ‘মনোপাখি’: বাস্তবতার মোড়কে গাঁথা পরাবাস্তব এক জগত

সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের মানোন্নয়নে মানুষগুলো হতে থাকে নির্জীব, প্রাণহীন, অচেতন। সম্পর্কে জড়ানোর পর মানুষ আর সম্পর্কের উন্নয়নে ভাবিত হয় না। তারা ভেবেই নেয়, মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন যেভাবে চলেছে বাকিটা সময় সেভাবেই চলে যাবে। ফলে সম্পর্কের তার কোথায় কেটে গেল, কোন সুইচ কাজ করছে না। কোথায় বাতি ফিউজ করল, কোন বোতাম অকেজো, সেসব আর কিছুই মানুষ পরখ করে দেখে না। পণ্য মেরামত ও উন্নয়নের মতো সম্পর্কেরও সংশোধন ও পরিমার্জন জরুরী মানুষ সেটা বিলকুল ভুলে যায়। আর ভুলটা হয় ঠিক ওখানেই।

– রাফিউজ্জামান সিফাত 

সাহিত্যে উপন্যাস একটি বিশাল কলেবরের সংযোজন বিশেষ। উপন্যাসের আবার অনেক বিভাজন আছে। যেমন- রহস্যোপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, রাজনৈতিক উপন্যাস, আঞ্চলিক উপন্যাস, আত্মজৈবনিক উপন্যাস, রূপক উপন্যাসসহ অসংখ্য ধারা, যা আবার উপধারা পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, যেহেতু মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব তাই সামাজিক উপন্যাসের গল্পটাও হয়তো পাঠককে সবচাইতে বেশিই আকৃষ্ট করে থাকে। কেননা, যান্ত্রিক জীবনে বিক্ষুব্ধ পাঠকের মন খোঁজে খানিক স্বস্তি।

লেখকের পরাবাস্তব জগতের প্রধান চরিত্রে পাঠক নিজেকেই আবিষ্কার করে। নিমেষেই ডুবে দেয় অথবা হারিয়ে যায় বাস্তবতার মোড়কে গাঁথা পরাবাস্তব এক জগতের অন্তরালে। আর সেজন্যেই হয়তো সামাজিক উপন্যাস যুগ যুগ ধরে শুধুমাত্র জনপ্রিয়তাই নয়, বরং মানুষের উৎসাহ আর প্রেরণার বিষয়বস্তু হিসেবেও গণ্য হয়ে আসছে। সেরকমেরই নিত্যদিনের সমাজ জীবন নিয়ে কল্পিত ভুবনে দৃশ্যত রচিত উপন্যাসের নাম ‘মনোপাখি’, যা আজকের আলোচনার মূল বিষয় বস্তু। 

© Wazedur Rahman Wazed

অভাবকে আটকানোর সাধ্য আছে কার? অভাব নিজেকে প্রকাশ করবেই। ভাতের থালায় দারিদ্র্য নিজেকে জানান দিবে। সে নিজেকে জানান দেয় চায়ের ভাঙা কাপের হাতলে, আত্মীয়দের দাওয়াতে খালি হাতে, উৎসবের আমেজে পুরনো পোশাকে, সাংসারিক মনকষাকষিতে, ভিজে যাওয়া বালিশে।

– রাফিউজ্জামান সিফাত

চোখ বন্ধ হয়ে আসে রুপুর। সে অনুভব করে রাধিকার গায়ের মিষ্টি সুবাস তার আরও কাছে এগিয়ে আসছে। রুপু হয়তো নিজেকে ছেড়েই দিতো, কিন্তু তখনই তার চোখে ভেসে ওঠে জমিদার বাড়ির দোতলার বদ্ধ ঘরের সেই মুহুর্তগুলোর স্মৃতি। সজোরে ধাক্কা দিয়ে রাধিকাকে রুপু ফেলে দেয়। মাটিতে ছিটকে পড়ে রাধিকা। গাছের গুঁড়ির সাথে বাড়ি লেগে তার কপালের ডান পাশ কেটে রক্ত বেরোতে থাকে। রাধিকা রুপুর দিকে তাকায়। সেই চোখে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল কেবল একরাশ বিমূঢ়তা। 

প্রচ্ছদপটে এরকমই খানিক শব্দে রহস্য রেখে লেখক চুপ করে আছেন পাঠকের বইপড়া পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার আশায়। ২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলাতে আদী প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায় বইটি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সুপরিচিত প্রচ্ছদশিল্পী রাজীব দত্ত। একেবারে সাদামাটে একটা গল্পের সাদামাটা একটা প্রচ্ছদ-গল্পের স্বার্থে যেমনটা ঠিক দরকার। বইটির পৃষ্ঠা, বাঁধাই অর্থাৎ আগাগোড়া বইটি সুন্দর লাগলেও মাঝখানের কিছু পৃষ্ঠা কুঁচকানো ছিল, যার জন্যে পড়তে বেশ সমস্যা হয়েছে; এছাড়া বইটির বাহ্যিক কোনো ত্রুটি বলার মতো বিশেষ কিছু না। 

মুগ্ধতারও একটা সময় সীমানা থাকে। কোনো মানুষ অনন্তকাল ধরে অপরকে মুগ্ধ রাখতে পারে না। মোহিতের রেশ আরও দ্রুত বিনাশ ঘটে যদি মানুষটির কাছাকাছি চলে আসে। বিহবলতা দূর থেকেই সুন্দর।

– রাফিউজ্জামান সিফাত 

© Wazedur Rahman Wazed

গল্পপ্রসঙ্গ

শফিক আযাদ: ওয়্যার আর ক্যাবলের খুচরা আর পাইকারি বিক্রেতা। দুই মেয়ে, এক ছেলে আর স্ত্রী লুতফাকে নিয়ে তার সুখের সংসার। বড় মেয়ের বিয়ের পর আলাদা হলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ এখনো বিদ্যমান। বড় ছেলে মিঠুন। খুব এলোমেলো আর অগাছালো। কখনো ছবি আঁকে, তো কখনো ছবি আঁকা একেবারেই বন্ধ। কখনো নিজের ঘর ছেড়ে এক মুহুর্তের জন্যেও বের হয় না, আবার কখনো নিজের ঘরেই ফেরে না। শফিক আযাদ কিংবা লুতফা কেউই মিঠুনকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। 

শফিক আযাদের মা আর আর তার ছোট মেয়ে রুমঝুমের চোখজোড়ার মধ্যে এক নিবিড় মিল আছে। তবে শফিক আজাদের গোপনে বিয়ে করা দ্বিতীয় ঘরের সন্তান ছোট্ট রুমালীর চোখেও একই মায়া লক্ষ্য করেছেন তিনি। আর সেই জন্যেই, লুতফার সাথে এত বছর সংসার করেও লুতফার আপন হয়েও ঠিক আপন হতে পারেননি শফিক আযাদ। 

রুপু: ইমতিয়াজ হোসেন আর রাবেয়ার একমাত্র পুত্র। ট্রেনের মাস্টার ইমতিয়াজ হোসেন, এক ট্রেন দুর্ঘটনায় চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছেন সবার কাছ থেকে। তাই আশ্রয়ের আশায় রাবেয়া ফিরে গিয়েছিল কিশোরগঞ্জ জেলার প্রয়াত জমিদার আলাউদ্দিন শিকদারের সাবেকী দোতলা জমিদার বাড়িটায়। জমিদারী প্রভাব-প্রতিপত্তি আর জৌলুস অনেকটাই মিইয়ে গেছে। তবে মেটেনি আলাউদ্দিন শিকদারের পুত্র তৈমুর শিকদারের জমিদারি তেজ; যে কি না রুপুর নানা। বাড়ির দোতলার বিশাল বড় ঘরে থাকেন তৈমুর শিকদার। বড় মামা ইলিয়াস শিকদার আর ছোট মামা ছোটন শিকদার থাকেন দালানের নীচতলায়।  

দোতলায় ওঠা নিষেধ জেনেও কৌতূহলের মাশুল হিসেবে একবার রুপুকে জমিদার বাড়ির ছাদে নিয়ে আটকে রাখা হয় সারারাত। বদ্ধ ঘরের সেই দুঃসহ স্মৃতি সারাজীবন তাড়া করে ফেরে রুপুকে। তাই তো, দেবী বিসর্জনের সময়ে যখন রাধিকা রুপুকে নিজের করতে চায় তখন রুপুর ধাক্কায় গাছের গুঁড়িতে লেগে রাধিকার কপাল কেটে যায়। কারণ, রুপু জানে আশ্রিতদের কোনো শখ-আহ্লাদ থাকতে নেই। 

রুমঝুম: শফিক আযাদের ছোট মেয়ে। কলেজে পড়ে। ছোট থাকতেই নাচে বেশ পারদর্শিতা অর্জন করলেও বয়ঃসন্ধিকাল থেকে নাচটা কেবল একান্ত নিজের করে নেয় রুমঝুম। যেমন- নিজের করে নেয়া আয়নার সাথে কথোকপথনের মুহুর্ত কিংবা মায়ের শাড়ি পরে বউ সেজে ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নায় তাকিয়ে থাকা। একদিন রুমঝুমের পা মচকে যায়। সেদিন বাসায় লুতফা আর শফিক আযাদের কাছে ওয়্যার হাউজের হিসাব দিতে আসা রুপু বাদে আর কেউই ছিল না। রুপু রুমঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে মোড়ের ফার্মেসিতে চলে যায়। রুপু নিজেও জানে না তার এই রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানো ক্লান্ত দেহে কী করে এত শক্তি এলো?

© Wazedur Rahman Wazed

রুমঝুমকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু বাড়ির ফেরার পর রুমঝুম খেয়াল করে ওর এক পায়ের একটা নুপুর নেই। সারা বাড়ি এমনকি হাসপাতাল বা ফার্মেসি তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি নুপুরটা। আচমকাই রুপু নামের ছেলেটার কথা মনে পড়ে রুমঝুমের। পাশাপাশি বাবা-মায়ের নীরব মনোমালিন্য সবাইকে এড়িয়ে গেলেও রুমঝুমের চোখে ঠিকই ধরা পড়ে। বাবা কেন বই পড়ার দোহাই দিয়ে ভিন্ন ঘরে যে ঘুমিয়ে পড়ে তা ঠিকই টের পায় রুমঝুম। 

নিয়াজ সোলাইমান: যার কাছে জীবন মানেই সিনেমা। সিনেমার পাশাপাশি রেহানা নিয়েই তার সংসার। বড়লোক বাবার শিক্ষিত মেয়ে রেহানা আচমকাই সিনেমা পাগল মানুষটার প্রেমে পড়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। অথচ বাস্তবতা আর সিনেমার গল্পে যে কতটা সত্য-মিথ্যে লুকানো থাকে তা রেহানা টের পায় বিয়ের পর। যখন টিভি নাটকের সফলতার বদলে সিনেমা বানায় নিয়াজ অথচ পরপর তিনটা সিনেমা গ্রহণযোগ্যতা হারায়। 

হতাশ না হয়ে নিয়াজ দুই বছর ধরে রাত-দিন একাকার করে নতুন চিত্রনাট্য লেখে। রেহেনার করুণ দৃষ্টি নিয়াজের চোখ এড়ায় না। চিত্রনাট্য জমা দেয় দেশের প্রথিতযশা আর সবচাইতে ব্যবসা সফল প্রযোজক ফারুক গোলন্দাজের কাছে। একদিন কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে রেহানা বাড়ি ছাড়ে; অথচ ফারুক গোলন্দাজ ততক্ষণে নিয়াজের খোঁজে নামে। খালি পকেটে, মাথায় সিনেমার পোকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো পুরুষে কারই বা আকর্ষণ থাকে? 

অন্তরা: রুপুর বড় মামা ইলিয়াস শিকদারের একমাত্র মেয়ে। রুপু আর অন্তরা পিঠাপিঠি বয়সের। সাবেকী জমিদার বাড়ির সবাই যেখানে দোতলার ঘর কিংবা ছাদে যাওয়ার সাহস পর্যন্ত করে না। তখন অন্তরা দস্যি মেয়ের মতো পুরো জমিদার বাড়ি চষে বেড়ায়। এক রাতে অন্তরা হারিয়ে যায়। সারারাত এমনকি পরবর্তী তিন দিন আর তিন রাত তন্নতন্ন করে খুঁজেও অন্তরাকে কোথাও পাওয়া যায় না। চতুর্থ রাতে অন্তরা ফিরে আসে। কারোর সাথেই কোনো কথা বলে না।

কিন্তু এরপর থেকেই রুপু অন্তরার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পায়। যেদিন অন্তরা ফিরে এলো সেদিন থেকেই অন্তরা যা বলতো তা-ই ফলে যেত। যেমনটা, ছোট মামীর সন্তানসম্ভব হবার খবর এবং বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই তা নষ্ট হওয়ার খবর রুপুকে জানিয়ে দিয়েছিল অন্তরা। কিন্তু, অন্তরার স্বামী রতন যে ক্যান্সারে ধুঁকে প্রতিদিন একটু একটু করে মারা যাবে তা কি অন্তরা আগে থেকেই জানত? 

শফিক আজাদের সুখের সংসার থাকা সত্ত্বেও কেনই বা আরেকটা সংসারের দরকার পড়েছিল? রুপু কি ওর বাবাকে খুঁজে পেয়েছিল? বা কী এমন দোষে রুপুকে ছাদে আটকে রাখা হয়েছিল? রুমঝুম কি রুপুকে নিজের করে পায় নাকি শুধুমাত্রই বয়ঃসন্ধিকালে এক ঝলক মোহ ছিল সেটা? নিয়াজ শেষমেশ কাকে বেছে নিয়েছিল-নিজের স্ত্রী রেহানা নাকি নিজের নেশা সিনেমা? রেহানা কি ফিরে এসেছিল নিয়াজের কাছে? অন্তরাই বা সে রাতে কোথায় চলে গিয়েছিল? আর কী করেই বা ভবিষ্যত বলে দিত ও? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে রাফিউজ্জামান সিফাত রচিত মনোপাখি উপন্যাসে। 

খুব সামান্য স্বীকৃতিও মানুষের বৃহৎ আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার সেই একই মানুষ বিশাল সাফল্যে কূলহারা নয়নে বসে থাকে।

– রাফিউজ্জামান সিফাত

© Wazedur Rahman Wazed

লেখক প্রসঙ্গ

রাফিউজ্জামান সিফাত। ময়মনসিংহ জেলায় জন্ম। বাবা আব্দুস সাত্তার এবং মা রাশেদা আখতার। দুই ভাই-বোনের মাঝে অবস্থান দ্বিতীয়। কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের উপর স্নাতক শেষ করেছেন। বর্তমানে কর্মরত আছেন একটি টেলিকমিউনিকেশন এবং সফটওয়্যার তৈরি প্রতিষ্ঠানে। অল্প বয়সে স্বল্প কৌতূহলে এক জাতীয় দৈনিকে গল্প পাঠানো। সেই লেখা প্রকাশিত হওয়া, ছাপা অক্ষরে নিজের নাম দেখে আনন্দে মহল্লা দৌড়ে বেড়ানো, এভাবেই মূলত লেখালেখি জীবনের শুরু। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছোট গল্প পাঠিয়ে কুড়িয়েছেন পাঠকদের প্রশংসা। 

গল্প লেখাটা তাই ধীরে ধীরে একধরনের নেশায় পরিণত হয়। আর গানের লিরিক বা নাটক লেখাটা পরিণত হয় শৌখিনতায়। বর্তমানে চাকুরির পাশাপাশি বহুল প্রচারিত ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। অমর একুশে বইমেলা ২০১৬ তে তার প্রথম বই ছাপা হয় আদী প্রকাশন থেকে ‘সে আমার গোপন’ শিরোনামে যা মূলত গল্প সংকলন। এরই ধারাবাহিকতায় পরের বছর প্রথম উপন্যাস ‘সুয়া উড়িলো উড়িলো জীবেরও জীবন’ প্রকাশিত হয়। পাঠকদের উষ্ণ ভালোবাসার প্রাপ্তি লেখককে দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পদ্ম, বলে এসো’ লিখতে বাধ্য করে পরবর্তী বছরে। আর এই ভালোবাসা প্রাপ্তির পুনরাবৃত্তির ফসল হচ্ছে লেখকের বহুল আলোচিত ‘মনোপাখি’ উপন্যাস। 

সন্তানের উছিলায় অভিভাবকরা মূলত নিজেদেরকেই মহৎ প্রমাণের চেষ্টা চালায়। ছেলে মেয়েদের প্রতিভাবান হিসেবে জাহির করে কৃতিত্বটা পুরোটাই নিজেদের করে নেয়। কিন্তু সন্তান বিপথে বাবা মা’কে আর মা বাবা’কে এর দায়ভার দিতে চায়।

– রাফিউজ্জামান সিফাত

অমর একুশে বইমেলা ২০১৯ এ অটোগ্রাফ দিচ্ছেন লেখক; © Wazedur Rahman Wazed

পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গ

সাহিত্য হচ্ছে পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতো একটা কাজ। পাড়ঘেরা পুকুরের বদ্ধ পানিতে কারো ঢিল খুব বেশিক্ষণ যাবত তরঙ্গ ধরে রাখতে সক্ষম, আবার কারো ঢিল ব্যাঙের মতো পানির উপর দিয়ে লাফিয়ে চলে যেতেও সক্ষম। আবার অনেকের ঢিলে তরঙ্গের গভীরতাও টের পাওয়া যায় না। তাই পুকুরে যে কেবল ঢিল ছুঁড়লেই তা অর্থবহ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠবে তা কিন্তু নয়। আশেপাশে থেকে আগে পর্যবেক্ষণ করে নিতে হবে পুকুরে অনন্য, গভীর আর নান্দনিক একটা তরঙ্গ তৈরি করতে হলে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

ঠিক একইভাবে, সাহিত্যেও এরকম নানা হিসাব কষে পদার্পণ করতে হয়, নয়তো তরঙ্গ দীর্ঘায়িত হয় না। আর এদিক থেকে লেখক রাফিউজ্জামান সিফাত বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। মনোপাখির শুরুর দিকটা পাঠককে খানিকটা বিভ্রান্ত বা বিরক্ত করতে পারে। কিন্তু পাঠককে ক্ষীণ একটা ধৈর্য্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে। তাহলে পাঠক বুঝতে পারবে যে, লেখক কতটা উপযুক্ত হলে ঢিল ছোঁড়ার ফলে সৃষ্ট তরঙ্গ পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ কাটতে সক্ষম হয়। 

আবার, সাহিত্যে বাস্তব জীবনের আলোকেই অচিত্রিত-অলিখিত-অবর্ণিত এক গল্প শোনানো হয়ে থাকে। আর ঠিক সেই জায়গাতেই পাঠকের সাথে লেখকের নিবিড় এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিংবা অনেকক্ষেত্রে তা গড়ে ওঠার আগেই ভেঙে যায়। কেননা, পাঠক কেবলমাত্র তখনই লেখকের উপর আস্থা অর্জন করে যখন লেখকের লেখনী পাঠককে গল্পের চরিত্রে প্রবেশ করতে বাধ্য করে। চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং পাঠক ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের গভীরে ডুব দেয়। রাফিউজ্জামান সিফাতের লেখনীতে পাঠক স্বেচ্ছায় ডুবে যেতে বাধ্য। এমনকি মূল চরিত্রের সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে দ্বিধাবোধ করবে না পাঠক। 

মনোপাখি মনোপাখি
তোমায় আমি ডাকি
অন্তর জুড়ে শূন্যতা তবু
তোমায় ভালোবাসি…!! 

মনোপাখি মনোপাখি
তোমায় আমি খুঁজি
অন্তর জুড়ে বিষণ্ণতা তবু
তোমায় ভালোবাসি…!!

মনোপাখি উপন্যাসের গ্রন্থ-পর্যালোচনা করতে যেয়ে প্রথমেই উপরোক্ত কথাগুলো শব্দের ছন্দে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিছু কথা রয়ে যায়। সেসব না বললে পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে অবিচার করা হয়। আর বিশাল কলেবরের এরকম সামাজিক উপন্যাসে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুলগুলোই পাঠক আর লেখকের সম্পর্কের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। যেমন, উপন্যাসে অনেক জায়গাতেই শব্দের বানানে ‘র’ আর ‘ড়’ এর দ্বন্দ্ব দৃষ্টিকটু লাগে। কয়েক জায়গায় চরিত্রের নাম তালগোল পাকিয়ে ফেলা- হওয়ার কথা রুপু, অথচ হয়ে আছে রুমঝুম; এরকম হলে বিভ্রান্তি জাগে পাঠকের মনে। শুরুতে লেখক বয়ঃসন্ধির এত গভীরে গল্পটাকে টেনে নিয়ে গেছেন যে, পাঠকের বিরক্তি লাগতে পারে, বা খামখেয়ালীপূর্ণ লেখা বলেও মনে হতে পারে। তাছাড়া, সামাজিক উপন্যাসে পরাবাস্তবতার স্বাদ দিতে গিয়ে লেখক যেন খানিকটা থমকে গিয়েছেন; পরিপূর্ণতা পায়নি পরাবাস্তবতার ছোঁয়া। 

© facebook.com/RafiuzzamanSifatStoryTeller

এত বিশাল কলেবরের সামাজিক উপন্যাসে চরিত্রগুলো সাধারণত এককেন্দ্রিক হয়ে যায়। দুটো চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে বাকিদের উপজীব্য করে গল্প এগিয়ে চলে। কিন্তু রাফিউজ্জামান সিফাত কেবল দুজনকে প্রাধান্য করে গল্প বলেননি। গল্প বলেছেন সকল চরিত্রকে কেন্দ্র করে। চরিত্রের স্খলন লক্ষ্য করা যায়নি উপন্যাসের কোথাও। চরিত্রগুলো দৃঢ়, পরিণত আর বেশ পরিপক্ব।

লেখকের বর্ণনাভঙ্গিতে একধরনের সূক্ষ্ম মায়া কাজ করেছে। বর্তমানের গল্পের ভাজে লেখক পাঠককে অতীতের স্মৃতি বিজড়িত এক গল্পে নিয়ে দাঁড় করায় যা পাঠক টের পায় পরে। গল্প বলার ছলে জীবনের কঠিন সত্য বক্তব্যগুলো তুলে ধরেছেন লেখক যা মাথায় গেঁথে যেতে বাধ্য। নিজের দর্শন অন্যের উপর না চাপিয়ে কিংবা কোনো এক ঘটনা অথবা চরিত্রকে কেন্দ্র না করেই, সাবলীলভাবেই সাদামাটা একটা গল্প লিখেছেন লেখক। লেখকের লেখনীর এই গুণগুলোই মূলত মনোপাখি উপন্যাসটাকে অনেকাংশে পূর্ণতা দিয়েছে। লেখকের বক্তব্যেও তা প্রকাশ পেয়েছে; সেখান থেকেই খানিকটা তুলে ধরা হলো-

কেবল জানতাম আমি লিখব। কী লিখব, কার বা কাদের কথা লিখব, তার কিছুই ঠিক ছিল না। অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপ খুলে চেয়ারে হাত পা গুঁটিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি, বিছানায় শুই, এপাশ ওপাশ করি, মাঝ রাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে গল্প খুঁজি। ধীরে ধীরে একটি দুটি চরিত্র তৈরি হয়। একসময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করি চরিত্রগুলো নিজেরাই নিজেদের সাজিয়ে নিচ্ছে। তারা আড্ডা জমাচ্ছে, খিলখিলিয়ে হাসছে, ঠোঁট মুচড়িয়ে কাঁদছে, বড় বড় চোখে ইতিউতি তাকাচ্ছে, অভিমানে গাল ফুলাচ্ছে, বিষণ্ণতায় হচ্ছে মেঘ। এভাবেই মায়া মায়া জ্বর আদরে উপন্যাসটি তৈরি হয়েছে।

© Wazedur Rahman Wazed

অনলাইনে বইটি কিনতে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-

মনোপাখি

This article is in Bangla language. It's a book review about a Bangladeshi novel named 'Monopakhi' which is written by Rafiuzzaman Sifat. 

Feature Image: Wazedur Rahman Wazed

Related Articles

Exit mobile version