স্লিদারিন; নামের সাথেই যেন মিশে আছে ধূর্ততা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশুদ্ধ রক্তের গরিমা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, এবং কালো জাদুর বহুল চর্চা। হাউজ স্লিদারিন ও হগওয়ার্টসের চার প্রতিষ্ঠাতার একজন সালাজার স্লিদারিনের কাছে এই গুণগুলো ছিল খাঁটি হীরের ন্যায় মূল্যবান। স্কুলজীবনে তিনি এসবের উপর প্রাধান্য দিয়েই নিজ হাউজে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছেন। এ ধরনের গুণাবলী সাথে নিয়ে বেলাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ, টম রিডলের মতো ধূর্ত শিক্ষার্থীরা হেঁটেছে ঘোর অমানিশার পথ ধরে, যার পরিণতি ঠেকেছে গিয়ে কালো জাদুর আগ্রাসনে। এই হাউজের অনেক জাদুকরই অনুপ্রাণিত হয়েছে ভলডেমর্টের নেতিবাচক চিন্তাভাবনায়, পরিণত হয়েছে ডেথ ইটারে। আবার হাউজ স্লিদারিনের এমন জাদুকরের সংখ্যাও কম নয় যারা তাদের চালাকি, কৌশল এবং আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহার করেছেন নিঃস্বার্থ ও প্রশংসনীয় উপায়ে। ফলে, তারা হয়ে গেছেন জাদু জগতে জগদ্বিখ্যাত, স্থান করে নিয়েছেন সেরাদের তালিকায়। সবুজ-রূপালী রঙে আচ্ছাদিত স্লিদারিন বংশের অজানা ইতিহাস নিয়েই আজকে এই আলোচনা।
স্লিদারিন শব্দের সাথে যে নামটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তা হলো সালাজার স্লিদারিন। যশস্বী এই জাদুকরের জন্ম ৯৩৪ সালের ৩১ অক্টোবর, দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের এক পিওর ব্লাড জাদুকর পরিবারে। যাদের পূর্বপুরুষ মোটামুটি সবাই জাদুকর ছিল, তাদেরকেই ‘পিওর ব্লাড’ বলে অভিহিত করা হয়। বাবা টারটিয়াস স্লিদারিন এবং মা করডেলিয়া স্লিদারিনের একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন তিনি। ইলিয়ানা স্লিদারিন নামে ছোট এক বোনও ছিল তার। পিওর ব্লাড বা বিশুদ্ধ রক্তের পরিবারের ছায়ায় বেড়ে ওঠায় ছোটবেলা থেকেই জাদুর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান তিনি। ওই জামানায় জাদুকরদের জাদু প্রশিক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ শেখানোর জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল না। তাই পরিবারের কাছেই ঘরোয়া প্রশিক্ষণে জাদুতে হাতেখড়ি হয় তার। মা-বাবা দুজনেই নিয়মিত কালো জাদুর চর্চা করায় কালো জাদু হয়ে ওঠে সালাজার স্লিদারিনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কালো জাদু অনুশীলনের মাধ্যমে ক্রমশ নিজের দক্ষতাকে পাকাপোক্ত করে জাদুজগতে নিজেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন স্লিদারিন।
পারিবারিক সূত্রে, সালাজার স্লিদারিন তিনটি ক্ষমতা পেয়েছিলেন:
- পার্সলটাঙ বা সাপের ভাষা বলার ক্ষমতা,
- লেজিলিমেন্সি বা জাদুর মাধ্যমে কারও মনের ভাব পড়ে ফেলার ক্ষমতা, এবং
- ট্র্যাকিং স্কিল বা কারও পিছু নিয়ে তার ঠিকানা বা তাকে খুঁজে বের করে ফেলা।
এসব ক্ষমতা তার পরিবার পেয়েছিল তাদের বহু দূরের পূর্বসূরি প্রাচীন গ্রিসের জাদুকর হারপো দ্য ফাউলের কাছ থেকে। তিনিই প্রথম সফলভাবে হরক্রাক্স এবং ব্যাসিলিস্ক তৈরি করতে সক্ষম হন। ছেলেবেলা থেকেই সালাজার স্লিদারিন সাপের সাথে কথা বলার পাশাপাশি সাপকে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণও করতে পারতেন।
হারপো দ্য ফাউল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে: ডার্ক উইজার্ডদের সন্ধানে || হারপো দ্য ফাউল
শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেওয়ার পর এক ভাইকিং তাদের গ্রামে এসে তাণ্ডব শুরু করলে, সেসময় বাবা-মাকে হারান তিনি। এতিম স্লিদারিনের মূল দায়িত্ব হয়ে ওঠে তার ছোটবোনের দেখভাল করা। এভাবেই কেটে যেতে লাগল সময়। সবে চব্বিশে পা দিয়েছেন সালাজার স্লিদারিন। তখনই ডাইনী অপবাদ দিয়ে মাগলেরা হত্যা করে ইলিয়ানা স্লিদারিন এবং তার নবজাতককে। আপনজন হারানোর শোক প্রচণ্ড বিমর্ষ করে তোলে সালাজারের মন। সেই থেকেই মাগলদের প্রতি দারুণ ক্ষোভ জন্মায় তার অন্তরে। ক্রমে তা রূপ নেয় ঘৃণায়।
পরিবারের সকলকে হারিয়ে তিনি ইংল্যান্ডের এক জঙ্গলে পাড়ি জমান। ওখানে সাপ নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন তিনি। একসময় তিনি সফলভাবে ব্যাসিলিস্ক ব্রিডিংয়ে সক্ষম হলেন। এরপর ব্যাসিলিস্কের শিং আর সর্প-কাঠ (স্নেক-উড) দিয়ে তৈরি করলেন শক্তিশালী এক জাদুর ছড়ি। ওই ছড়ির বিশেষত্ব হলো- তিনি সর্প-ভাষায় মন্ত্র ফুঁকে সেটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন পারতেন। যেটাকে বলা হয়, ছড়িকে স্লিপিং মুডে রাখা। সর্প-ভাষার ওই মন্ত্র ছাড়া এই ছড়িকে আর জাগানো যাবে না। তাই, ওই ছড়ির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শুধু সালাজারের হাতে। ছোটবেলায় বাবা তাকে গবলিনদের তৈরি এক লকেট উপহার দিয়েছিলেন, যা তিনি সবসময় গলায় পরতেন। এটাই সেই বিখ্যাত স্লিদারিনের লকেট, যেটাকে ভলডেমর্ট হরক্রাক্সে রূপান্তরিত করেছিল। হঠাৎ একদিন একদিন তার মোলাকাত হলো ইংল্যান্ডের তৎকালীন বিখ্যাত যোদ্ধা-জাদুকর গড্রিক গ্রিফিন্ডরের সাথে। একে একে পরিচিত হলেন রোয়েনা র্যাভেনক্ল, হেলগা হাফলপাফের সাথে। সময়ের সেরা চার জাদুকর মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন জাদুশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘হগওয়ার্টস স্কুল অভ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রি’।
চার হাউজে ভাগ করা হলো স্কুলকে। সকলের অগোচরে স্লিদারিন হগওয়ার্টসের বেজমেন্টে তৈরি করলেন ‘চেম্বার অব সিক্রেটস’ নামে এক গুপ্তকক্ষ। সেখানে অত্যন্ত গোপনীয়তায় তার হাউজের মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থীকে কালো জাদু শিখাতেন। মাগলবর্ন জাদুকরদের ভর্তি ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তা নিয়ে বাকি তিন জাদুকরের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় হগওয়ার্টস ত্যাগ করেন তিনি। তবে, যাওয়ার আগে ব্যাসিলিস্ককে চেম্বার অব সিক্রেটসে রেখে যান। তিনি আশা করেছিলেন, তার কোনো এক যোগ্য উত্তরসূরি এসে খুলবে এই চেম্বার। তারপর সেই ব্যাসিলিস্ক একে একে খুন করবে হগওয়ার্টসে অধ্যয়নরত সকল মাগলবর্নকে। যে মাগলদের কারণে তাকে হতে হয়েছে পরিবারহারা, ছাড়তে হয়েছে নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান।
আবারও তিনি ফিরে আসলেন আয়ারল্যান্ডে। বিয়ে করলেন একজন জাদুকর মহিলাকে। তাদের ঘর আলো করে সন্তানসন্ততি এলো। সবাইকে হগওয়ার্টস থেকে দূরে রাখা হলো। স্লিদারিন বিশ্বাস করতে লাগলেন- বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, পরোপকারিতা সবকিছুই ধোঁকা। দুনিয়াতে একমাত্র খাঁটি জিনিস হলো শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা। নিজে ঘৃণায় বাঁচতে লাগলেন, বাচ্চাদেরও এসব শেখালেন। একসময় তার মেয়ের ঘরে এক ছেলে জন্ম নিল। তার ভাগ্যে স্লিদারিনের লকেটটা জোটে। সালাজার স্লিদারিনের মৃত্যুর পর শেষ হয় স্লিদারিন পদবির অধ্যায়। কিন্তু তাদের রক্তে তখনও পার্সলটাঙ, লেজিলিমেন্সি, এবং ট্র্যাকিং স্কিল রয়ে গেল।
সালাজারের প্রয়াণের ১২৮ বছর পর পেভেরেল নামে এক জাদুকর বংশে জন্ম নিল তিন ছেলে। ক্যাডমাস পেভেরেল, ইগ্নোটাস পেভেরেল, এবং অ্যান্টিয়োচ পেভেরেল। এরা হলেন ওই তিন ভাই, যাদের কাহিনি আমরা হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোস মুভিতে ‘দ্য টেইল অব থ্রি ব্রাদার্স’ অংশে দেখেছি। বড় ভাই অ্যান্টিয়োচ পেয়েছিলেন বিখ্যাত জাদুর ছড়ি এল্ডার ওয়ান্ড। কিন্তু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হওয়ায় তিনি কোনো উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি। অদৃশ্য আলখাল্লা পাওয়া মেঝ ভাই ইগনোটাস পেভেরেল মৃত্যুর আগে তার ছেলেকে ওই আলখাল্লা দিয়ে গিয়েছিলেন। ওই ছেলে ইয়োলান্থ নামে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিল। ইয়োলান্থের বিয়ে হয় হার্ডউইন পটারের সাথে। এই হার্ডউইন পটার হলেন হ্যারি পটারের প্রপিতামহের প্রপিতামহ।
একেবারে ছোট ভাই ক্যাডমাস পেভেরালের হাতে যায় পুনর্জন্মী পাথর। বংশানুক্রমে তা ক্যাডমাসের ছেলের হাতে আসে। সে স্লিদারিন পরিবারের এক মেয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া মেয়ের বিয়ে হয় গন্ট পরিবারের এক ছেলের সাথে। তাদের ঘরে করভাস গন্ট এবং এবং করভিনাস গন্ট নামে দুই ছেলে শিশুর জন্ম হয়। এই পর্যায়ে আসতে আসতে পেভেরেল আর স্লিদারিন দুই বংশের নামই মুছে গিয়েছিল। এর পরিবর্তে পটার আর গন্ট বংশ সামনে বাড়তে থাকে। তবে, বংশের নাম বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেলেও, তাদের রক্তে তখনও স্লিদারিন পরিবারের ক্ষমতা বাহিত হচ্ছিল। সাথে বংশানুক্রমে হাতবদল হচ্ছিল দুই মূল্যবান সম্পদ পুনর্জন্মী পাথর এবং স্লিদারিনের লকেটেরও। করভাস গন্ট এবং করভিনাস গন্ট হগওয়ার্টসের আঙিনায় পা রাখলে দুজনেই স্লিদারিন হাউজের জন্য নির্বাচিত হন। করভাস বিয়ে করে এক জাদুকরকে। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুই মেয়ে- গর্মলেইথ গন্ট আর রিয়োনাচ গন্ট।
এদের মধ্যে গর্মলেইথ গন্ট জাদুজগতে সবচেয়ে নিন্দিত কালো জাদুকর হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে। উভয়ই ছিল পার্সলমাউথ (যাদের সাপের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা আছে)। কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে একজন ছিল অপরজনের সম্পূর্ণ বিপরীত। গর্মলেইথ তার বিশুদ্ধ রক্তের গরিমা দেখিয়ে মাগলদের প্রচণ্ড ঘৃণা করত। অপরদিকে, রিয়োনাচ ছিল কোমল হৃদয়ের অধিকারী। রক্তের মাধ্যমে কোনো প্রকার মানব বিভাজন সে পছন্দ করত না। ১৬০৩ সালে সে উইলিয়াম সায়ার নামে এক পিওর ব্লাড জাদুকরকে বিয়ে করে, যে ছিল মরিগান পরিবারের বংশধর। এই মরিগান বংশ থেকেই ম্যালফয় বংশ এসেছে। উইলিয়াম এবং রিয়োনাচের গভীর প্রণয়ের ফলে তাদের কোল আলো করে আসে ইসল্ট সায়ার নামে এক মেয়ে।
তারা আয়ারল্যান্ডের ইলভারমরনি কটেজ নামক জায়গায় বসবাস শুরু করে। তারা প্রতিবেশী মাগলদের প্রতি ছিল ভীষণ সদয়। জাদুর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন প্রাণীর রোগবালাই এবং ক্ষত সারিয়ে তুলত। কিন্তু তাদের এই জনহিতকর কর্মকাণ্ড ক্রমশ ফুসলিয়ে তুলছিল গর্মলেইথ গন্টকে। ইসল্টের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন গর্মলেইথ তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই আগুনে ইসল্টের বাবা-মা দুজনেই মারা যান। কিন্তু গর্মলিথ ইসল্টকে আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়ে সাথে করে নিয়ে আসে। কারণ, গর্মলেইথের ইচ্ছা ছিল ভাগ্নিকে তিনি নিজ আদর্শে নিজের মতো করে গড়ে তুলবে।
বিশুদ্ধ রক্তের গরিমা দেখিয়ে মগজ ধোলাইয়ের পাশাপাশি কালো জাদুও শেখাতে লাগল তাকে। ১৬১৪ সালে ইসল্টের ১১ বছর পূর্ণ হলে হগওয়ার্টস ভর্তির চিঠি আসতে থাকলেও গর্মলিথ তা পুড়িয়ে ফেলত। ইসল্টকে হগওয়ার্টসে যেতে দিল না গর্মলেইথ। গর্মলেইথ যে ছড়ি ব্যবহার করত সেটা ছিল মূলত সালাজার স্লিদারিনের। সতের বছর বয়সে পা রাখার পর ইসল্ট একদিন সর্প-কাঠের তৈরি সেই ছড়ি চুরি করে গর্মলেইথের কব্জা থেকে পালিয়ে যায়। স্লিদারিনের বংশধর হিসেবে গর্মলেইথের ট্র্যাকিং স্কিল বা খুঁজে বের করার ক্ষমতা ছিল প্রবল। তাই গর্মলেইথের হাত থেকে বাঁচতে মেফ্লাওয়ার নামের এক জাহাজে করে নিউ ওয়ার্ল্ড (যুক্তরাষ্ট্র) নামক দেশে চলে আসে ইসল্ট।
নিউ ওয়ার্ল্ডে আসার পর এক জঙ্গলে সে নিজেকে গোপন করে রাখল। কারণ, তখন পুরো পৃথিবীতেই চলছে মাগলকর্তৃক ডাইনি নিধন উৎসব। কয়েক সপ্তাহ পর হঠাৎ হাইডবিহাইন্ড নামে জংলী পশু সম্মুখীন হলো তার। ভাগ্যক্রমে, তখন গবলিনসদৃশ এক পাকবুজি হাজির হয় সেখানে। দুজন মিলে তখন সেই জানোয়ারের দফারফা করে ফেলে। কিন্তু, লড়াইয়ে পাকবুজি গুরুতর আহত হয়। মানুষের জন্য পাকবুজি হাইডবিহাইন্ডের চেয়ে ভয়ংকর হওয়া সত্ত্বেও অসুস্থ পাকবুজিকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলল ইসল্ট। পাকবুজি তখন প্রতিজ্ঞা করে, এই ঋণ সে নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও শোধ করবে।
এরপর দুজনের মাঝে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পাকবুজিকে তার আসল নাম না বলায় ইসল্ট তার বাবার নামের সাথে মিল রেখে পাকবুজির নাম ‘উইলিয়াম’ রেখে দেয়। কয়েকবছর পর এক অভিযানে গেলে দুজন আবারও এক হাইডবিহাইন্ড দেখতে পেল। তাদের দেখে পালিয়ে যায় হাইডবিহাইন্ডটি। ওখানে দুটো ফুটফুটে বাচ্চা চোখে পড়ে তাদের। তাদের মধ্যে একজন ছিল চ্যাডউইক বুট, অপরজন ওয়েবস্টার বুট। কিছুদিন পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেল উইলিয়াম। এরপর ইসল্ট খোঁজ নিয়ে জানতে পারল- বাচ্চা দুটো জাদুকর বংশের। তাদের বাবা-মাকে দাফন করার সময় জেমস স্টুয়ার্ট নামে সুদর্শন এক মাগল যুবকের সাথে পরিচয় হয় ইসল্টের। একসময় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো তারা।
বুট ভাইয়েরা তাদের সাথেই সন্তান হিসেবে রয়ে গেল। হগওয়ার্টসের কথা শুনে শুনে দারুণ রোমাঞ্চিত হয় তারা। বড় ভাই এগারো বছর পা রাখলে তাদের জাদুচর্চার কথা ভাবেন ইসল্ট। যেহেতু আমেরিকায় তখন জাদুশিক্ষার কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, তাই ইসল্ট ও জেমস ‘ইলভারমর্নি স্কুল অব উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রি’ নামক এক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। হগওয়ার্টসের মতো এখানেও চারটি হাউজ রাখা হয়। আমেরিকার জাদুকর সমাজে এই খবর পৌঁছালে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে থাকে সেখানে।
ইসল্ট আর জেমসের ঘরে দুই মেয়ে হয়, যাদের নাম রাখা হয় রিয়োনাচ এবং মার্থা। গর্মলিথের কানে এই খবর পৌঁছানোর পর রক্ত মাথায় উঠে যায় তার। সে আমেরিকা এসে ইলভারমর্নি স্কুল ধ্বংস করে তার মেয়েদের অপহরণ করে। ইসল্ট আর গর্মলিথ একে অন্যের মুখোমুখি হবার পর দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য তৈরি হয় তারা। ইসল্ট ছড়ি উঠিয়ে দেখল তার ছড়ি কাজ করছে না। কারণ, এই ছড়ি সে তার খালা গর্মলেইথের কাছ থেকে বাগিয়ে এনেছিল, যার আসল মালিক ছিল খোদ সালাজার স্লিদারিন।
গর্মলেইথ সর্প-ভাষার মাধ্যমে সেই ছড়িকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। সর্প-ভাষা না জানায় ইসল্ট ছড়িকে জাগাতে পারছিল না। তখনই পুরো শক্তি দিয়ে ইসল্টের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল গর্মলেইথ। প্রাণ যাবে যাবে অবস্থা, এমন সময় নিজ বাবা উইলিয়ামকে চিৎকার করে ডাকতে লাগল ইসল্ট। ঠিক তখনই উইলিয়াম নামক সেই পাকবুজির বিষ মাখানো তীরের ফলা গিয়ে বিঁধল গর্মলিথের বুকে। সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো সর্বকালের অন্যতম কুখ্যাত এই জাদুকর। এরপর থেকে উইলিয়াম তাদের পরিবারের সাথেই থাকতে শুরু করল।
আর স্লিদারিনের সেই ছড়িকে বহু চেষ্টার পরেও জাগাতে না পারায় ঘরের পেছনে এক খালি জায়গায় পুতে ফেলা হয় সেটাকে। সেখান থেকে জন্ম নেয় সর্প-কাঠের এক বৃক্ষ, যেটাকে পুড়িয়ে ফেলা বা কেটে ফেলা যেত না। এরপর ধ্বংসস্তূপ থেকে আবারও গড়ে তোলা হয় ইলভারমর্নি স্কুল। সময়ের সাথে সাথে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ইসল্টের কন্যা মার্থা ছিল একজন স্কুইব। আবার সে বিয়েও করেছিল এক মাগলকে। তাই, তাদের কয়েক প্রজন্মে কোনো জাদুকর সন্তান জন্ম নেয়নি।
এবার আসা যাক করভাস গন্টের ভাই করভিনাস গন্টের প্রসঙ্গে। ১৬৮৩ সালে জন্ম নেওয়া এই জাদুকর ১৬৯৪ সালে হগওয়ার্টসে হাউজ স্লিদারিনের জন্য নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম সালাজার স্লিদারিনের তৈরি করা চেম্বার অব সিক্রেটসের খোঁজ পান, হাজার বছরের প্রচেষ্টায়ও যেটার হদিস কেউ পায়নি। এই করভিনাস গন্টকে ধরা হয় চেম্বার অব সিক্রেটসের রক্ষাকর্তা হিসেবে। চেম্বার অব সিক্রেটসের কাছাকাছি জায়গায় মেয়েদের বাথরুম তৈরির সময় তিনি ওখানেই উপস্থিত ছিলেন। কাউকে এই গোপন কক্ষ সম্বন্ধে কানাকড়িও জানতে দেননি। সালাজার স্লিদারিন চেম্বার অব সিক্রেটসে ঢোকার গুপ্ত রাস্তা তৈরি করেছিলেন দুর্গের নিচে কোনো এক জায়গায়। কিন্তু মেয়েদের বাথরুমের মধ্য দিয়ে চেম্বার অব সিক্রেটসের পথ গোপন করে রাখার বুদ্ধিটা এসেছিল করভিনাস গন্টের মাথা থেকেই। তিনি বাথরুমকে ব্যবহার করেছিলেন ‘ট্র্যাপ ডোর’ হিসেবে।
এই করভিনাসের সংগ্রহে পুনর্জন্মী পাথর আর লকেট দুটোই ছিল। পাথরটি তিনি এক আংটির সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। তার হাতে সবসময় শোভা পেত সেই আংটি। একজন পিওর ব্লাড জাদুকরকে বিয়ে করলে তাদের ঘরে মারভলো নামে এক সন্তান জন্ম নেয়। বংশ পরম্পরায় তার কাছে যায় সেই লকেট আর আংটি। মারভলো বিশুদ্ধ রক্তের ধারা বজায় রাখতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় নিজের চাচাতো বোনের সাথে। তাদের ঘরে জন্ম নেয় মরফিন আর মেরোপি নামে দুই সন্তান। ছেলে মরফিনকে দেওয়া হয় আংটি আর মেয়ে মেরোপিকে দেওয়া হয় স্লিদারিনের লকেট।
কালের পরিক্রমায় মেরোপি গন্ট একসময় টম রিডল সিনিয়র নামে এক মাগল যুবকের প্রেমে পড়ল। সে লাভ পোশনের মাধ্যমে টম রিডলকে প্রেমের ফাঁদে ফেলল। সেই কথা মেরোপির বাবা মারভলো গন্ট জানতে পেরে টম রিডলকে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও মারভলো তাতে ব্যর্থ হয়। জাদুবলে মাগল হত্যার চেষ্টা করায় সে ‘ম্যাজিক্যাল ক্রিমিনাল আইন’ ভেঙে ফেলেছিল। সেই অপরাধে তাকে পাঠানো হয় ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন আজকাবান কারাগারে।
টম রিডল সিনিয়রের সাথে অবাধ মেলামেশার কারণে একসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায় মেরোপি গন্ট। পেটে সন্তান থাকায় টমের উপর লাভ পোশন প্রয়োগ করা বন্ধ করে দেয় সে। ভেবেছিল, সন্তানের প্রতি টান জন্মানোর ফলে কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না টম রিডল সিনিয়র। কিন্তু ফলাফল হলো এর বিপরীত। মেরোপিকে বিপদসংকুল অবস্থায় রেখে নিরুদ্দেশ হয় টম রিডল সিনিয়র।
গন্ট পরিবারের কাছে স্লিদারিনের রেখে যাওয়া যে লকেট সংরক্ষিত ছিল, অর্থের টানাপোড়েনে মেরোপি তা বিক্রি করে দেয় ‘বর্গিন এন্ড বার্কস’ নামক এক দোকানে। তারপর লন্ডনের ওলস অরফানেজের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। ওখানেই জন্ম হয় হগওয়ার্টসের অন্যতম সেরা খলনায়ক লর্ড ভলডেমর্ট ওরফে টম মারভোলো রিডলের। এরপরের কাহিনি হ্যারি পটার দেখা সকলেরই জানা।
লর্ড ভলডেমর্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে – লর্ড ভলডেমর্ট: এক দুর্ধর্ষ খলনায়কের উপাখ্যান
ডাম্বলডোর আর্মির অভিযানে একে একে হরক্রাক্স হারাতে হারাতে ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে নাকবিহীন ভলডেমর্ট। সবশেষে, হগওয়ার্টস ময়দানে হ্যারির সাথে ছড়িযুদ্ধেও পরাজয় বরণ করে নিতে হয় তাকে। এভাবে সমাপ্তি ঘটে জাদুজগতের দুর্ধর্ষ এক খলনায়কের। ভলডেমর্ট যেহেতু কোনো বিয়ে করেনি, তাই সেই সাথে থেমে যায় স্লিদারিন বংশের জয়যাত্রা। তবে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্স চাইল্ডকে হিসেবে ধরলে স্লিদারিন বংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী ছিল ডেলফিনি রিডল। ২০২০ সালের পর থেকে সে নরকতুল্য আজকাবান কারাগারে বন্দি আছে।
এছাড়াও পড়তে পারেন: জাদুজগৎ কাঁপানো স্লিদারিনের জাদুকরেরা