‘দ্বৈরথ’ শব্দটি সামনে এলেই ভেসে আসে দু’দলের তুমুল সংঘর্ষের প্রতিচ্ছবি। কার থেকে কে বেশি সেরা, তা নিয়ে যেন চলে এক গ্রীস ও ট্রয়ের উপাখ্যান। প্রকৃতির নিয়মটাই যেন এভাবে লিপিবদ্ধ করা যে, দ্বৈরথের লড়াইটা হতে হবে বাঘে-মহিষে। সেজন্যই খেলার মাঠে বারবার প্রশ্ন উঠে আসে, কে সেরা? মেসি না রোনালদো? ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? রিয়াল মাদ্রিদ না বার্সেলোনা? ভারত না পাকিস্তান? আর খেলার বাইরেও আছে! ফোর্ড না ফেরারি? কোক না পেপসি? স্যামসাং না অ্যাপল? এ-তো কেবল তুলনা নামক বৃক্ষের পাতা ধরে টান দিলাম। আরও নাড়াচাড়া করলে বেরিয়ে আসবে এরকম শ’খানেক তুলনা করার জিনিস।
প্রত্যেক দলের সমর্থকেরাই তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে নিজের দলের পাল্লা ভারী করতে সদা প্রস্তুত। সুযোগ পেলে তুলাধুনা করতেও ছাড় দেয় না! তেমনি কমিকস জগতেও সেই চল্লিশের দশক থেকেই দ্বৈরথের বৈঠা টেনে আনছে ডিসি ও মারভেল নামের আলাদা আলাদা দুই আমেরিকান কমিকবুক কোম্পানি। কমিকস বইকে জনপ্রিয় করে তুলতে দু’দলই পাঠকদের উপহার দিয়েছে হাজার-হাজার কাল্পনিক চরিত্র। তবে, ডিসি ও মারভেল উভয়ই এমন কিছু চরিত্র পাঠকদের সামনে এনেছে, যা নানা সময়ে বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উভয় প্রকাশনাই একজন আরেকজনের চরিত্র থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন চরিত্রের জন্ম দিয়েছে। সেই থেকেই ভক্তদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক ব্যতিক্রমী দ্বন্দ্বের, কে বেশি কার থেকে ভালো বা কে বেশি অরিজিনাল- তা নিয়ে। তবে পাঠকদের অগোচরে প্রকাশনাগুলো নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখেছে ঠিকই। তবে ডিসি নাকি মারভেল, এদের মাঝে কে সেরা, সেই আলোচনায় আজ আমরা যাব না। আজ শুধু আলোকপাত করব ডিসি মারভেল থেকে কোন কোন চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের ভক্তকুলকে কী কী চরিত্র উপহার দিয়েছে, তা নিয়ে।
১. ডেথলক থেকে সাইবর্গ
২০১৭ সালে ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের ৫ম সিনেমা ‘জাস্টিস লিগ’ মুক্তি পেলে কমিকস ভক্তরা রূপালী পর্দায় দেখতে পায় অর্ধ-মানব ও অর্ধ-যন্ত্রের মিশেলে তৈরি সাইবর্গকে। এর আগে অবশ্য, ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস সিনেমায় একটি ক্যামিও ছিল সাইবর্গের। দুই চলচ্চিত্র সাইবর্গ কমিকমবুক-মুভিপ্রেমীদের জগতে বেশ ভালোই জনপ্রিয়। কিন্তু অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, ডিসির এই চরিত্রটি মারভেলের চরিত্র ‘ডেথলক’ থেকে অনুপ্রাণিত। মারভেল ডেথলককে নিয়ে আসে ১৯৭৪ সালে, আর ডিসি কমিকসে প্রথম সাইবর্গের দেখা মিলে ১৯৮০ সালে।
ডিজাইনের দিক থেকে দুইজনের চরিত্র প্রায় হুবহু মিলে যায়। দুইজনেই হাফ-হিউম্যান ও হাফ-মেশিন। তবে সাইবর্গ যতটা না মানব প্রকৃতির, ডেথলক তার চেয়ে বেশি হিংস্র স্বভাবের। দুজনের এই অবস্থার পেছনের ঘটনাটা সম্পূর্ণ আলাদা। ভিক্টর স্টোনের (সাইবর্গ) ট্রান্সফরমেশন হয়েছিল এক দুর্ঘটনা থেকে, যেটা তাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় ঠেলে দিয়েছিল। অন্যদিকে মাইকেল কলিন্সের শরীরে (ডেথলক) এক প্রকার জোর করেই ‘ডেথলক প্রজেক্ট’ সম্পন্ন করা হয়। সাইবর্গের আগে ডেথলক কমিকে আসলেও, উভয়েই তাদের ইউনিভার্সে দারুণ জনপ্রিয়।
২. থ থেকে অ্যাকোয়াম্যান
স্থলে ও শূন্যে হাজার হাজার সুপারহিরো পৃথিবী কাঁপালেও, জলের সুপারহিরোদের সংখ্যা নেহাতই অল্প। অল্প বলতে ডিসি-মারভেলের হাতে গোণা মাত্র দুটো! ন্যামর ও অ্যাকোয়াম্যান। এই দুজনের মধ্যে কে বেশি জনপ্রিয় তা হয়ত আর খুলে বলতে হবে না। কারণ, চোখ বুজে জলের তলার কোনো সুপারহিরোর কথা চিন্তা করলেই ভেসে আসে জেসন মমোয়া ওরফে অ্যাকোয়াম্যানের দৃশ্যপট।
জাস্টিস লিগের ব্যর্থতার পর, অ্যাকোয়াম্যান বক্স অফিস ও দর্শকদের মন, দুটোয় জয় করে নিয়েছিল। অথচ, সেই সুপার-ডুপার আন্ডার-ওয়াটার চরিত্রটি কিনা মারভেল থেকে টুকে নেয়া! ন্যামরের উত্থান ঘটে ১৯৩৯ সালে, যেখানে অ্যাকোয়াম্যান ডিসির হয়ে দেখা দেয় আরো দু’বছর পর।
সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে, ক্ষিপ্রতায়, গতিতে, শক্তিতে, সাঁতারু হিসেবে দুইজনই অতুলনীয়। দুজনের মধ্যে শুধু পার্থক্য একটাই, শুরু থেকে ন্যামর ছিল একজন অ্যান্টি-হিরো এবং নৈরাজ্যের মদদ দাতা। আর অ্যাকোয়াম্যান ছিল জল ও স্থল উভয় স্থানের সুপারহিরো। তবে লাইভ অ্যাকশনে আসার দরুন অ্যাকোয়াম্যানই যে আজকে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
৩. ঘোস্ট রাইডার থেকে অ্যাটমিক স্কাল
ঘোস্ট রাইডার ১৯৭২ সালে মারভেলে প্রকাশিত হওয়ার ঠিক ৮ বছরের মাথায় ডিসি প্রায় একই ধরনের এক চরিত্র দর্শকদের উপহার দেয়; নাম, অ্যাটমিক স্কাল। দুই চরিত্রের পরস্পর মিল অন্য যেকোনো চরিত্র থেকে বেশি। যেমন, অ্যাটমিক স্কালের মাথায় জ্বলন্ত আগুনের শিখা দেখলে ঘোস্ট রাইডারের কথাই মনে পড়ে। আবার দুজনেরই লেদারের পোশাকের প্রতি তীব্র ঝোঁক, সেই পারস্পরিক মিলের কুণ্ডলীর আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিয়েছে। তবে দু’জনের অরিজিনের দিকে নজর দিলে খানিকটা অমিল লক্ষ্য করা যায়। ঘোস্ট রাইডার মারভেলের সুপরিচিত একজন অ্যান্টি-হিরো ও স্ট্যান্টম্যান, যে পারিবারিক অভিশাপের ফলে তার এই জ্বলন্ত খুলি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
অপরদিকে অ্যাটমিক স্কাল ছিল একজন কলেজ স্টুডেন্ট, যার এই অবস্থা হয়েছে রেডিয়েশন পয়জনিংয়ের ফলে। ঘোস্ট রাইডারের অরিজিন পিশাচ-তত্ত্বে নিবদ্ধ থাকলেও অ্যাটমিক স্কালের সাথে পিশাচ-তত্ত্বের কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তবে ইনস্পায়ার হোক বা কপি, ডিসির উচিৎ ছিল আরেকটু ভিন্ন করে চরিত্রটার রূপ দেয়া।
৪. স্কারলেট উইচ থেকে জ্যাটানা
মারভেলে অতিমানবীয় ক্ষমতাধর স্কারলেট উইচের আগমন ঘটে ১৯৬৪ সালের মার্চে। এর মাত্র ৮ মাস পরেই, অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে ডিসি নিয়ে আসে আরেক ফিমেল চরিত্র জ্যাটানাকে। মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে কমিকবুক জগতে আসলেও তাদের মধ্যে বেশ কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। জেনেটিক দিক থেকে তারা উভয়েই মিউট্যান্ট। এরা দুজনেই মানবকুলের ভেতর এমন এক প্রজাতি, যারা জন্ম থেকেই ‘ম্যাজিকাল আর্ট’ নিয়ে জন্মায়। নিজ নিজ ইউনিভার্সে দুজনই বিশাল পরিবর্তনের মুনশিয়ানা দেখাতে ওস্তাদ! জ্যাটানা তো ‘মাইন্ড ওয়াইপ স্পেল’ ব্যবহার করে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগানোর ক্ষমতা রাখে। ‘ইয়ং জাস্টিস’, ‘জাস্টিস লিগ’, বা ‘জাস্টিস লিগ ডার্ক’ সব জায়গাতেই সে তার কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। স্কারলেট উইচের সাথে তার পার্থক্য হলো এই যে, সে আসল ম্যাজিশিয়ানের সাথে সাথে একজন স্টেজ ম্যাজিশিয়ানও। কালো হ্যাট ও জাদুকরী লাঠি সমেত সেই জ্যাটানাকে ডিসি কমিকসের অন্যতম সেরা জাদুকর হিসেবে গণ্য করা হয়।
স্কারলেট উইচ ও জ্যাটানা, দুজনই টেলিপ্যাথি, টেলিকাইনেসিস, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ এসব ক্ষেত্রে সমান দক্ষ। ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের ১১ নম্বর চলচ্চিত্র ‘অ্যাভেঞ্জারস: এইজ অব আল্ট্রনে’র মাধ্যমে স্কারলেট উইচের দেখা মিললে, চলচ্চিত্র জগতে সে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই থেকে অ্যাভেঞ্জারদের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য হিসেবে পৃথিবী রক্ষায় গুরুভার দায়িত্ব পালন করে আসছে। নিজেদের ইউনিভার্সে দুজনই সমান সমান জনপ্রিয়।
৫. আয়রন ম্যান থেকে রকেট রেড
১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে মারভেল ইউনিভার্সের’টেইলস অব সাসপেন্স’ নামে কমিকস অ্যান্থলজি সিরিজে আগমন ঘটল মেটাল স্যুট পরা এক সুপারহিরোর। মারভেল হয়তো নিজেরাও তখন জানত না, তারা কী এক সোনার ডিম পাড়া হাঁস তৈরি করে ফেলেছে! ‘অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম’ দেখার পর যার জন্য অগণিত ভক্তবৃন্দ চোখের পানি ফেলেছে। সুপারহিরো জগতে সে একটা আলাদা ‘ভক্তকুল’ই তৈরি করে নিয়েছে। হ্যাঁ, বলছিলাম ধনকুবের টনি স্টার্ক ওরফে আয়রন ম্যানের কথা।
১৯৬৩ সালে ‘টেইলস অব সাসপেন্সে’ এলেও, ‘আয়রন ম্যান’ নামে কমিকস বাজারে আসতে আসতে পেরিয়ে যায় আরও ৫ টি বছর। তখনও ডিসি এরকম কোনো ‘লৌহমানব’ আনার পরিকল্পনা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে হঠাৎ ডিসির তরফ থেকে ‘জাস্টিস লিগ ইন্টারন্যাশনাল’ দলের সদস্য ‘রকেট রেড’ নামক এক সুপারহিরোর দেখা মেলে। তুলনা করলে দেখা যাবে, রকেট রেডের সাথে আয়রন ম্যানের প্রায় অনেক কিছুই মিল খেয়ে যায়। দুজনরেই টেকনোলজির প্রতি বেশ ঝোঁক। তবে দুজনের মধ্যে যে জিনিসটা বিস্তর ফারাক তৈরি করে দিয়েছে, তা হচ্ছে – টনি স্টার্ক একটু জটিল এবং নতুন নতুন স্যুট তৈরিতে তার আগ্রহ থাকলেও রকেট রেড সে দিক থেকে একটু শান্ত। স্যুট আপগ্রেডেও তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না রকেট রেড। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ প্রিয় আয়রন ম্যান নিজের পোশাকে যেমন এনেছে সব নতুন নতুন টেকনিক্যাল পরিবর্তন, তেমনি স্পাইডার-ম্যানের স্যুটেও দিয়েছে আধুনিক ও উন্নত মার কাটারি অস্ত্রের ছোঁয়া। এছাড়াও ‘অ্যাভেঞ্জারস: এইজ অব আল্ট্রন’ ও ‘অ্যাভেঞ্জারস: ইনফিনিটি ওয়ার’ মুভিতে হাল্কের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ‘হাল্কবাস্টার’ নামক স্যুট হাল্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আয়রন ম্যান নিজের স্যুট নিজে তৈরি করলেও, রকেট রেডের স্যুট বানিয়ে দিয়েছিল ‘গ্রিন ল্যান্টার্ন কর্পস’ ও ‘রকেট রেড ব্রিগেডে’র সদস্য কিলোওগ। মেটাল স্যুট হিরো হিসেবে অবশ্য রেড রকেটও ততোটা খারাপ নয়। তবে ক্ষমতা, নিপুণতা, জনপ্রিয়তা, টেকনোলজির প্রতি ভালোবাসা তাকে পৌঁছে দিয়েছে সফলতার শীর্ষে এবং রেড রকেট থেকে বেশি জনপ্রিয় তো বটেই!
৬. ওয়াস্প থেকে বাম্বলবি
২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অ্যান্ট-ম্যান এন্ড দ্য ওয়াস্প’ মুভির পর দ্য ওয়াস্পকে এখন মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের এক গুরুত্বপূর্ণ ফিমেল চরিত্রই বলা চলে। এখানে বলে রাখা ভালো, আসল ওয়াস্প হলো হ্যাঙ্ক পিমের স্ত্রী জ্যানেট। কোয়ান্টাম রাজ্যে জ্যানেট হারিয়ে যাবার পর থেকে হোপ ভ্যান ডাইন-ই এই রোল প্লে করছেন। অ্যান্ট-ম্যান সিরিজের ২য় কিস্তির পর ওয়াস্পকে দেখা গিয়েছিল থানোস বধ পর্ব, ‘অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম’ মুভিতে। যদিও স্ট্যান লি, এরনি হার্ট ও জ্যাক কার্বির হাত ধরে মারভেল কমিকসে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৩ সালের জুন মাসে, ‘টেলস অফ অ্যাস্টনিশ’ নামের কমিক বইয়ে। অপরদিকে ডিসি কমিকসও ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে কঠোর ও কোমলতার মিশ্রণে গড়া, পতঙ্গের ন্যায় ‘বাম্বলবি’ নামক এক ফিমেল সুপারহিরোকে সামনে আনে। তার আসল নাম ক্যারেন ব্রিচার-ডানকান এবং সে মূলত ‘টিন টাইটান্স’ ও ‘ডুম পেট্রোলে’র সদস্য। দুই ফিমেল সুপারহিরোর বাহ্যিক দিক লক্ষ্য করলে, তাদের মধ্যে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এর থেকে বুঝা যায়, ডিসি ওয়াস্প চরিত্রটা থেকে মোটামুটি ভালোই অনুপ্রেরণা নিয়েছে।
দুজনের ক্ষমতা, দক্ষতা, কূট-কৌশল পাল্লায় মাপলে প্রায় সমান সমান ফলাফল দিবে। দুইজনের মধ্যে ফারাক শুধু বয়সের। ওয়াস্প যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক, বাম্বলবি সেখানে একজন কিশোরী মাত্র। বিপদের সময় বুদ্ধি খাটানোতে ওস্তাদ হওয়ায়, দুজনেই দুজনের ইউনিভার্সে সমান জনপ্রিয়। কস্টিউম, ডিজাইন হুবহু মিলে যাওয়ায় ডিসি’র আর্টিস্টরা হয়ত একটু অন্যভাবে চেষ্টা করলেও পারত।
৭. সিলভার সার্ফার থেকে ব্ল্যাক রেসার
যারা ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ফ্যান্টাসটিক ফোর: রাইজ অব দ্য সিলভার সার্ফার’ মুভিটি দেখেছেন, তারা সিলভার সার্ফারের সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। ধাতব শরীরের অধিকারী, মানুষের মতো দেখতে মারভেলের এই সুপারহিরোর অবাধ বিচরণ সারা গ্যালাক্সি জুড়ে। জেন-লা তে জন্ম নেয়া এই সুপারহিরোর মারভেল ইউনিভার্সে আগমনটা ঘটেছিল যেন গ্যালাক্সির অবাধ বিচরণের মতোই।
সাল তখন ১৯৬৬। মারভেলের জ্যাক কার্বি তখন শূন্যে সার্ফ করা এক সুপারহিরোর সাথে পরিচয় করান কমিক রিডারদের। প্রজাতিতে সে জেন-লেভিয়ান ও একগাদা দলের সদস্য। ক্ষমতা গুলোর বর্ণনা দিয়েও শেষ করা যাবে না। প্রায় আলোর গতিতে ছুটাও তার কাছে মামুলি ব্যাপার মাত্র। সিলভার সার্ফারের জনপ্রিয়তায় মারভেল যখন তুঙ্গে, তখন ডিসিও বাজারে এমন কিছু ছাড়ার পরিকল্পনা করল। তাই তারা ১৯৭১ সালে ‘নিউ গডস’ নামের কমিকসে মুড়িয়ে বাজারে ছাড়ল, স্পিডিং, নন-কর্পোরাল এন্টিটি- ব্ল্যাক রেসারকে। মজার ব্যাপার হলো এই ফিকশনাল চরিত্রের স্রষ্টাও জ্যাক কার্বি! তিনি তখন মারভেল ছেড়ে ডিসিতে যোগ দিয়েছেন। জিনিসটা ভাবলে একটু অবাকই লাগে- দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কমিকসের, প্রায় একই মিল-সম্পন্ন দুই আলাদা আলাদা কাল্পনিক সুপারহিরোর স্রষ্টা একজনই!
সিলভার সার্ফার যেমন সার্ফিং বোর্ডে চেপে সার্ফ করে, তেমনি ব্ল্যাক রেসার স্কি ব্যবহার করে। সাথে তার মাথায় রয়েছে নাইটদের ন্যায় হেলমেট। ব্ল্যাক রেসারেরও রয়েছে দ্রুত গতিতে উড়ার ক্ষমতা, কসমিক সেন্স, ইল্যুশন কাস্টিং, টাইম ম্যানিপুলেশন, ইলেক্ট্রোকাইনেসিস ইত্যাদি অ্যাবিলিটি। তবে ‘অমরত্ব’ আর ‘মৃত্যুর ছোঁয়া’ এই দুইটা জিনিস তাকে বানিয়েছে সিলভার সার্ফারের থেকে একটু আলাদা।
৮. ক্যাপ্টেন আমেরিকা থেকে কমান্ডার স্টিল
যদি কমিকস রিডার বা কমিকবুক চলচ্চিত্র লাভারদের জিজ্ঞাসা করা হয়, “মারভেল অ্যাভেঞ্জারদের অন্যতম যোগ্য দলনেতা কে?” অনেকের পক্ষ থেকেই উত্তর আসবে, “ক্যাপ্টেন আমেরিকা”! কে যোগ্য আর কে অযোগ্য তা আলোচনার বিষয় নয়, তবে ক্যাপ্টেন আমেরিকার মতো ‘কুল পার্সন’ মারভেলের হয়ত দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
জো সিমন ও জ্যাক কার্বির মাধ্যমে মারভেলের অন্যতম জনপ্রিয় এই সুপারহিরোর আগমন ঘটে সেই ১৯৪১ সালে। অন্যদিকে মারভেল ছেড়ে ডিসিতে যাওয়ার পর, জ্যাক কার্বি বানালেন এক সুপারহিরো, হাতে তুলে দিলেন অবিনশ্বর এক ঢাল এবং নাম দিলেন ‘গার্ডিয়ান’। ঢালের কথা শুনলে প্রথমেই ক্যাপ্টেন আমেরিকার কথা মাথায় এসে যায়। সেই এক ব্যক্তিই একই সাদৃশ্যের, আলাদা কমিক জগতে দুই ভিন্ন সুপারহিরোর জন্ম দিয়েছে। সুপারহিরো হওয়ার আগ থেকেই ক্যাপ্টেন ও গার্ডিয়ান দুজনই মানব সুরক্ষায় নিয়োজিত: যেখানে ক্যাপ শুরু করেছিল একজন সৈনিক হিসেবে আর গার্ডিয়ান শুরু করেছিল পুলিশ হিসেবে। দুইজনই সুদক্ষ ট্যাকটিশিয়ান ও হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড ফাইটিংয়ে পারদর্শী।
তবে ডিসি এখানে শুধু গার্ডিয়ানকে বানিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। ১৯৭৮ এ ‘স্টিল: দ্য ইন্ডিসট্রাক্টেবল ম্যান’ নামক কমিকসে অভিষেক ঘটে ‘কমান্ডার স্টিল’ নামক আরেক সুপারহিরোর, যার সাথে ক্যাপ্টেন আমেরিকার ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট মিল খেয়ে যায়। তাঁর লাল, সাদা, এবং নীল স্যুট তাঁকে দেয় এক আকর্ষণীয় প্রদর্শনী। কমান্ডার স্টিলের স্রষ্টা গ্যারি কনওয়ে-ও স্টিলকে বানানোর আগে মারভেলের হয়ে কাজ করতেন। কমান্ডার স্টিলের ক্ষমতা অবশ্য ক্যাপের থেকে খানিকটা বেশি। কারণ, তার ইনফ্রা-রেড ভিশন ও মেটাল স্কিন তাকে বেশি স্বতন্ত্র বানিয়েছে।
৯. ব্ল্যাক প্যান্থার থেকে রেড লায়ন
১৯৬৬ সালে মারভেল তাদের ইউনিভার্সে কৃষ্ণাঙ্গ এক সুপারহিরোর উত্থান ঘটিয়ে এক প্রকার ইতিহাস তৈরি করে ফেলে। ওয়াকান্দার কৃষ্ণাঙ্গ জাতির অভিভাবক এই সুপারহিরো যেমন হিতৈষী, তেমনি যুদ্ধ বিষয়ক কলাকৌশলে পারদর্শী। তাকে কমিক বইয়ের জগতে নিয়ে আসার অর্ধশতক পর, মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটায় ব্লকবাস্টার ফিল্ম ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ উপহার দেয়ার মাধ্যমে। এই সিনেমার দ্বারা মূলত সুপারহিরো মুভির সংজ্ঞাই পাল্টে যায়, চিন্তা-চেতনায় আসে আমূল পরিবর্তন। এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া অন্যতম সেরা সুপারহিরো চলচ্চিত্র বলে বিবেচনা করা হয় একে।
প্রথম জনপ্রিয় সুপারহিরো সুপারম্যান থেকে শুরু করে ক্রমানুসারে যারা এসেছে, তাদের সকলেই ছিল শ্বেতাঙ্গ। ব্ল্যাক প্যান্থারই প্রথম সেই প্রথা ভাঙে। সে-ই প্রথম জানান দিয়েছে, ‘অভিজাত’ শব্দটা শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্য নয়। সেটা হতে পারে আধুনিক বিশ্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির দেশ ‘ওয়াকান্দা’ও। সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে, ডিসি ২০১৬ সালে অভিষেক ঘটায় ‘রেড লায়ন’ এক নামে এক আফ্রিকান সুপারহিরোর। একনায়কতন্ত্র অনুসরণকারী সেই রেড লায়ন প্রায় সময়ই ‘ডেথস্ট্রোক’কে ভাড়া করে জায়গায় জায়গায় নৈরাজ্য চালাতে। রেড লায়নের আসল নাম ‘ম্যাথিউ ব্ল্যান্ড’ এবং আদতে সে একজন ভিলেন। এটাই শুধুমাত্র ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ আর ‘রেড লায়নে’র মধ্যে পার্থক্য। দুজনেরই পোশাকের ডিজাইন প্রায় একই। দুজনই ফায়ার আর্মস, লিডারশীপ, ট্যাকটিক্যাল অ্যানালাইসিসে দক্ষ এবং উভয়েই একটি কৃষ্ণাঙ্গ জাতির নেতা। তাই বলা যায়, ক্রিস্টোফার প্রিস্ট রেড লায়ন চরিত্রটা সৃষ্টি করার সময় ব্ল্যাক প্যান্থার থেকে খানিকটা হলেও অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।
১০. ম্যান থিং থেকে সোয়াম্প থিং
২০১৯ সালে ডিসি ঘটা করেই মুক্তি দিয়েছিল সুপারহিরো-হরর ওয়েব সিরিজ ‘সোয়াম্প থিং’। ১ম সিজন বের হবার পর সিরিজটি বেশ সাড়া ফেলেছিল দর্শকমহলে। ১০ এপিসোডের সিরিজটি ভক্ত ও সমালোচক উভয়েরই মন জোগাতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ডিসির পক্ষ থেকে এর ২য় সিজন ক্যান্সেল করে দেয়া হয়। কেন এ কাজ করা হয়েছে, তা এখনো জানানো হয়নি। তবে অনেকের ধারণা প্রোডাকশন কস্ট বেশি হওয়ায় শো টি ক্যান্সেল করে দেয়া হয়েছে। মানুষ থেকে উদ্ভিদে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া এই সোয়াম্প থিং কমিক জগতে প্রথম পা রেখেছিল ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে। ডিসির ফ্যান্টাসি-হরর অ্যান্থলজি কমিক, ‘হাউজ অভ সিক্রেটে’ তার প্রথম আবির্ভাব ঘটে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এর ঠিক দুই মাস আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মে মাসে ‘স্যাভেজ টেলস’ নামক এক কমিকসে মারভেল ‘ম্যান থিং’ নামে এক সুপারহিরোকে সামনে আনে।
দুজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো, দুজনেই ‘সোয়াম্প মনস্টার’ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। দুজনের মধ্যেই রিজেনারেশন অ্যাবিলিটি বিদ্যমান। অরিজিন ঘাঁটলেও দুজনের মধ্যে যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। সোয়াম্প থিং এর কথা বলতে গেলে প্রথমেই উঠে আসে অ্যালেক হল্যান্ড নামক একজন বায়োলজিস্টের নাম, যে কি না লুইজিয়ানার এক জলাশয়ে বায়ো-রেস্টোরেটিভ ফর্মুলার উদ্ভাবন করেছিল। পরিকল্পিত এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে অ্যালেককে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়। ওইখানে মৃত্যুবরণ করলেও, যেভাবেই হোক তাঁর শরীর বায়ো-রেস্টোরেটিভ ফর্মুলার মাধ্যমে এক উদ্ভিদে পরিণত হয়েছিল। মানুষের মতো প্রায় সকল ক্ষমতা ছিল তাঁর। এভাবেই সোয়াম্প থিং নামে এক চরিত্রের জন্ম হয়েছিল। আর ম্যান থিং এর আসল নাম ছিল মূলত টেড স্যালিস এবং পেশায় সে ছিল বায়োকেমিস্ট। ফ্লোরিডার এক টপ-সিক্রেট ল্যাবরেটরিতে সে সুপার-সোলজার সিরাম নামক এক মেডিসিন ডেভেলপ করেছিল। এক সন্ত্রাসী গ্রুপের তাড়া খেয়ে টেড নিজের শরীরেই সেই সিরাম প্রয়োগ করে এক জলাশয়ে পড়ে গিয়েছিল। সেই সিরাম এবং জলাশয়ের জাদুকরী ক্ষমতা টেড রূপান্তরিত করেছিল মানব সদৃশ এক বৃক্ষে। সেই থেকে সে ম্যান থিং। সবদিক বিচারে, দুজনের ক্ষমতা প্রায় একই। ক্রসওভারে কেউ যদি কোনোদিন দুইজনকে যুদ্ধ নামাতে চান, তাহলে নিজেই ভেবে নিবেন দুজনের মধ্যে কে সেরা!