চলচ্চিত্র হাওয়া নিয়ে আগ্রহের অন্যতম কারণ মুভির পোস্টার এবং সাদা সাদা কালা কালা সাউন্ড ট্র্যাক। এছাড়া, সবার ক্যারেক্টার লুকেও নান্দনিকতার আভাস পাওয়া গেছে। তাতে রিলিজের আগে অপেক্ষা আর উন্মাদনায় বুঁদ হয়েছে পুরো দেশ। দৃষ্টিনন্দন পোস্টারে চোখ যেমন আটকেছে, তেমনই খমকের বাদ্যে মন জুড়িয়েছে মেজবাউর রহমান সুমনের প্রথম ছবি। জনরা বিচারে ফিল্মটি মিস্ট্রি ফিকশন। এই অঞ্চলের নিজস্ব লোককাহিনি আশ্রয় করে প্লট সাজানো হয়েছ। বেহুলা লখিন্দর, চাঁদ সওদাগর আর মনসা দেবীতে ভর করে চিত্রনাট্য লিখেছেন নির্মাতা। হাওয়া‘র ইতিবাচক দিক হলো কারো এই লোককাহিনি জানা না থাকলেও সিনেমা শেষ করে মনে হবে না যে কোথাও একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল। কিন্তু জানা থাকলে আবার পরিচালককে একটা বাহবা দেয়ার ইচ্ছা জাগবে। কেননা, এরকম প্রচেষ্টা তো বাংলা চলচ্চিত্রে বিরল!
হাওয়া‘র কাহিনি বেশ সাদামাটা ও সরলরৈখিক। সুতরাং, বোধগম্যতার ক্ষেত্রে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। তদুপরি, মিস্ট্রি ঘরানার সুবাদে হরর সিকুয়েন্সের মাত্রাও বেশ সহনীয় পর্যায়ে। যদিও কাঁটাছেরার দৃশ্যগুলো বেশ ভয় জাগায়। ফনির কপাল ভেদ করে ঢুকে যাওয়া বটি আর কোপানোর কিছু দৃশ্য ক্ষণিকের জন্য অস্বস্তির সৃষ্টি করে। কারণ, মেকআপে দারুণ বিশ্বাসযোগ্যতা এসেছে। কিন্তু, আমার কাছে মাঝিদের স্কিন টোন একটু বেশিই ট্যানড মনে হয়েছে। তার মধ্যে মুভির কালার গ্রেডিংয়ে ডার্ক টোন আগাগোড়া বিদ্যমান ছিল। সাউন্ড ডিজাইন ও মিক্সিং কিছু কিছু সিকুয়েন্সে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক লেগেছে। যেমনটা নেশাগ্রস্ত নাগুকে ডেকে নিয়ে চান মাঝি যখন কানপড়া দেয়, তখন মাতাল নাগুর পিওভি থেকে সাউন্ড ইফেক্টস শোনা গেছে। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের দিক থেকে চমৎকার হলেও নাগুর পিওভি থেকে দর্শক কেন সংলাপ শুনতে পাবে তার সদুত্তর স্পষ্টভাবে আসেনি। বিপরীতে, দৃষ্টিভ্রমের দুটি দৃষ্টিনন্দন বুদ্ধিদীপ্ত পিওভি ব্যবহার করেছেন নির্মাতা।
প্রথমবার নাগু ঘোর চোখে গুলতিকে রূপালি মাছ হিসেবে দেখে। মাছ হিসেবে দেখার মধ্য দিয়ে অবশ্য নির্মাতা দ্বিতীয়াংশের সাথে গল্পের যোগসূত্র তৈরির কাজও করে ফেলেছেন। আর, দ্বিতীয়বার হতাশাগ্রস্ত পারকেসের মরীচিকায় কোস্টগার্ডের জাহাজ দেখতে পাওয়া। তবে, সব ছাপিয়ে মুভির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো শিল্পীদের অভিনয় এবং সিনেমাটোগ্রাফি। এত চোখধাঁধানো চিত্রগ্রহণের কাজ শেষ কবে বাংলা ছবিতে দেখা গেছে তা মনে করাও দুরূহ।
কম্পোজিশনে দারুন খেলেছেন কামরুল হাসান খসরু, যার দুয়েকটির কথা না বললে অন্যায় হয়। প্রথমবারে নোঙর ফেলার দৃশ্যে নোঙরকে অনুসরণ করে ক্যামেরার প্রবলবেগে পানিতে অবতরণ বিশেষ ভাল লেগেছে। এরপর চান মাঝি ও খাঁচায় বন্দি পাখির চমৎকার একটি কম্পোজিশন অবাক করেছে, যেখানে চান মাঝির মাথার উপরের অংশই শুধু দেখা যায়। এমন মাথাকাটা কম্পোজিশন ইচ্ছাকৃতভাবে মনে হয় না কোনো বাংলা চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। তদ্রুপ উরকেস যখন পারকেসকে অনুসরণ করে, তখন সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সমন্বয় করে ক্যামেরা তরঙ্গের মতো ওঠা-নামা করেছে। এবং এই যে চরিত্রের আস্তে আস্তে পানিতে ডুবে হারিয়ে যাবার অনুভূতি, তা ফ্রেমের অবস্থান থেকেই উপলব্ধি করা গিয়েছে। এত চমৎকার ইউনিক সিনেমাটিক ট্রিটমেন্টকে টুপি খোলা অভিনন্দন। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির সাথে তালে তাল মিলিয়ে সজল অলকের এডিটিংও হয়েছে অনন্য।
ওটিটি প্লাটফর্ম এবং থিয়েটারের বাঘা বাঘা সব কলাকুশলীর মিলনমেলা এই চলচ্চিত্র। ফলে আলাদা করে তাদের প্রশংসায় যাচ্ছি না। প্রবল হাওয়াতে চান মাঝি যেভাবে বিড়িতে আগুন ধরালেন কিংবা নাগু পানির তলদেশ থেকে উঠে মুখ থেকে জ্বলন্ত বিড়ি বের করে ফুঁকলেন তা রীতিমত অবিশ্বাস্য! নাজিফা তুশির অভিনয় প্রত্যাশার মাত্রা ছাড়ানোয় সিনেমার একমাত্র অভিনেত্রী হিসেবে চরিত্রের প্রতি তিনি সুবিচার করেছেন। পক্ষান্তরে, মাঝ দরিয়ায় গল্পের খেই হারিয়েছে প্রতিশোধ ও ভয়ার্ত পরিণামের গল্পের হাওয়া। একদিকে সংলাপে প্রমিত, আঞ্চলিকের মিশ্রণ শ্রুতিকটু অভিজ্ঞতা দেয়। অন্যদিকে, শুরুর আকর্ষণ নিয়ে নয়নতারার যাত্রারম্ভ হলেও তা দ্বিতীয়াংশে এসে পুরোপুরি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়! সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংলাপে চিত্রনাট্যের অপরিপক্বতা স্পষ্ট হয়েছে।
গুলতি চরিত্রকে ঠিকভাবে বিকশিত করতে না পারার ব্যর্থতার দায় পরিচালকের কাঁধেই বর্তায়। সে মানুষ, রূপালি মাছ, সাপ, দেবী না বহুরূপীর যে অস্পষ্টতা- সেটি সম্পূর্ণই খাপছাড়া। অনুরূপ, তার বোবার অভিনয়ের পেছনেও কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। গুলতি কথা বলতে পারে তা জেলেরা জানলে কাহিনির কী এমন বিশেষ ক্ষতি হতো তা বোধগম্য হয় না। তাছাড়া, বেখাপ্পা লেগেছে গুলতির অতীত বর্ণনাও। সবচেয়ে বড় কথা, যে মহাশক্তিধর গুলতির ইশারায় জালে মাছ ওঠে, ইঞ্জিনরুমের ফুয়েলের ড্রাম ফুটো হয়ে যায়; যার ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে দুজন মানুষও খুন হয়ে যায়, সে কেন প্রতিশোধ নিতে এসে ইব্রাহিমকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিজের গোপন অভিসন্ধি প্রকাশ করতে গেল! এখানে তার মোটিভ কী!
তাছাড়া সমাপ্তিতে যেভাবে নাগিনীর বেশে সে চানমাঝিকে ছোবল দিল, সেই একই ছোবল তো আরও আগে দিয়ে অসহায় পরিস্থিতিতে তার বন্ধুকেও বাঁচাতে পারত! তাই নয় কি? এই মহাক্ষমতাধরের এত সংগ্রামের পক্ষে যুক্তি আসলে কী? কিংবা, রশি দিয়ে বেঁধে রাখা অবস্থা থেকে যেভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল গুলতি, অনুরূপভাবে প্রথমদিকে তো সে চান মাঝির কামনা থেকে রক্ষা পেতেও হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারত! ফলে, সার্বিক বিবেচনায় ফিল্মের মধ্যবিরতির পর, অর্থাৎ দ্বিতীয়াংশের চিত্রনাট্যের অবস্থা এতই নাজুক যে, চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের মতো পালে সজোরে হাওয়া লেগে পালই নিচে ছিড়ে পড়ে গেছে।
হাওয়া‘র কিছু দিক চিন্তার জায়গায় ঝড়ো হাওয়া দিয়েছে। অসহায় নারীর ওপর একদল পুরুষের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুপ্ত মনোভাব ক্যামেরাবন্দি হয়েছে সুচারুভাবে। পক্ষান্তরে, উরকেস এবং পারকেসে মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ ভাবনার অবকাশ আছে, যদি না তারা নামের মিলের দিক থেকে ভাই না হয়ে কেবল বন্ধু হয়ে থাকে। নানাজনের শারীরিক প্রবৃত্তি নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান দেখিয়েছে এ সিনেমা। পারকেসের চরিত্রায়নে নির্মাতার সচেতন দৃষ্টি মুগ্ধ করেছে। সেই তুলনায় উরকেসকে পর্যাপ্ত অবকাশ দেয়া হয়নি।
ফিল্মের সিজিআই টেকনোলোজি বাংলা চলচ্চিত্রের ক্রমবিকাশ এবং আগামীর সম্ভাবনায় অত্যন্ত পজিটিভ। খাঁচায় বন্দি পাখি কিংবা সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ! খালি চোখে দেখে বোঝার সাধ্যি কার যে এগুলো বাস্তবের নয়? তবে, শরীরের ওপর ওঠা সাপে আবার ততটা জমেনি। কৃত্রিমতা আঁচ করা গেছে। তদ্রুপ, ফিল্মের সাউন্ড ইফেক্ট ও মিউজিক চলনসই হলেও শীর্ষ মানের লাগেনি।
মোটের ওপর উপভোগ্য সিনেমা হলেও মনে রাখার মতো ভাল মানের সংলাপের ঘাটতি অতৃপ্তির অনুভূতি দিয়েছে। তবে, কাহিনিতে বৈচিত্র্য আনয়ন এবং মিস্ট্রি জনরায় অভিনব নির্মাণের যে প্রচেষ্টা টিম হাওয়া দেখিয়েছে, তা বাংলা চলচ্চিত্রে বেশ আশাসঞ্চারী, যার সুবাদে এখনকার নির্মাতারা হাওয়া‘র সাফল্যে অনুপ্রেরণা নিয়ে নানা অভিনব প্লটে তাদের নিরীক্ষণ অব্যাহত রাখবে- সেই প্রত্যাশা হয়তো এখন থেকে করাই যায়!