ইন্ডিয়ানার সাজানো গোছানো এক শহর হকিন্স। কিন্তু এর তলে তলে চলছে ভয়ানক সব এক্সপেরিমেন্ট, আক্ষরিক অর্থেই। আশির দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে হকিন্স ল্যাবে অবৈধভাবে সরকারি এক্সপেরিমেন্টের দরুন খুলে যায় এক ভয়ানক প্যারালাল ইউনিভার্সের দরজা, মানুষজন উধাও হয়ে যেতে শুরু করে। আমাদের পৃথিবীর বিকৃত সংস্করন ‘আপসাইড ডাউন’ থেকে আসা ডেমোগরগন কিংবা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা মাইন্ড ফ্লেয়ারের বিরুদ্ধে একত্র হয় কয়েকজন রহস্যপ্রিয় শিশু-কিশোর। নিজেদের বন্ধু উইলকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তাদের এই অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দেয় অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী ইলেভেন, উইলের মা, পুলিশ চিফ হপারসহ আরো কয়েকজন।
নেটফ্লিক্সের সেরা অরিজিনাল সিরিজের নাম বলতে গেলে নার্কোস, ডেয়ারডেভিল, ডার্ক, মাইন্ডহান্টার, মানি হাইস্টসহ জনরাভেদে একেকজনের উত্তর হবে একেকরকম। কিন্তু ফ্যান্টাসি, হরর, কিশোর অ্যাডভেঞ্চার আর আশির দশকের নস্টালজিয়াকে পুঁজি করে গড়ে তোলা ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ এর আবেদন সবসময়েই একটু অন্য পর্যায়ে থাকবে। বহুল জনপ্রিয় এই সিরিজের তৃতীয় সিজন নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন। আগের সিজন মুক্তি দেয়া হয়েছিল হররপ্রেমীদের পছন্দের সময় হ্যালোউইনে। এবার তার ব্যত্যয় ঘটলো। বেশ কিছু প্লটপয়েন্ট উঠে এসেছে এখানে। সুতরাং স্পয়লার অ্যালার্ট!
মাইন্ড ফ্লেয়ারের হাত থেকে উইল এবং হকিন্সবাসীকে বাঁচানোর পরে বেশ আনন্দের সাথেই গরমের ছুটি কাটাচ্ছে মাইক, উইল, লুকাস, ইলেভেন, ম্যাক্সসহ সবাই। সদ্যই সামার ক্যাম্প থেকে ফেরা ডাস্টিনের সাথে অ্যাডভেঞ্চার আর উইলের সাথে গেম খেলায় খুব একটা আগ্রহ পায় না নতুন নতুন রোমান্সের স্বাদ পাওয়া মাইক আর লুকাস। বান্ধবী সুজির সাথে যোগাযোগের সময়ে ভিন্নভাষার এক কোডের সন্ধান পেয়ে ডাস্টিন যায় স্টিভের কাছে। এদিকে লর্ড ভল্ডেমোর্ট আর হ্যারি পটারের মতো মাইন্ড ফ্লেয়ারও যুক্ত হয়ে আছে উইলের সাথে। ফলে আপসাইড ডাউনের দরজা আবার খুলে যাবার আভাস পেয়ে যায় সে। ম্যাক্সের ভাই বিলির উদ্ভট আচরণ সন্দেহ জাগিয়ে তোলে তাদের। এদিকে ভিন্ন ভিন্ন রহস্য সমাধানে জোট বাঁধে জোনাথন/ন্যান্সি এবং জয়েস/চিফ হপার।
স্ট্রেঞ্জার থিংসের মূল শক্তি হলো স্টিফেন কিং, স্টিভেন স্পিলবার্গের কাজসহ আশির দশকের বিভিন্ন পপ কালচার রেফারেন্স দেয়া আর সেই সাথে মানানসই ক্ল্যাসিক রকসমৃদ্ধ সাউন্ডট্র্যাক। হলের মধ্যে ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার (১৯৮৫)’ দেখানোর মুহুর্তটি যেকোনো মুভিপ্রেমীকে গুজবাম্পস দিতে বাধ্য। আশির দশকের টিনেজ মুভি ‘ফাস্ট টাইমস অ্যাট রিজমন্ড হাই (১৯৮২)’, অ্যাকশন মুভি ‘টার্মিনেটর (১৯৮৪)’ কিংবা ‘র্যাম্বো (১৯৮২)’ এর রেফারেন্স ছিল, আর মূল কাহিনীর সাথে অনেকেই ‘রেড ডন (১৯৮৪)’ আর জন কার্পেন্টারের ‘দ্য থিং (১৯৮২)’ এর ভালো রকম মিল খুঁজে পাবেন।
তবে সেই সময়কার ফ্যান্টাসি মুভিগুলোর চেয়ে বড় পার্থক্য গড়ে তুলেছে এর ভিজুয়ালি স্টানিং সিনেমাটোগ্রাফি। আকাশের লাল বজ্রের পটভূমিতে বিশাল দাঁড়াওয়ালা মাইন্ড ফ্লেয়ার ছাড়াও দুর্দান্ত সব সিজিআই ইফেক্টসমৃদ্ধ দৃশ্য ছিল এবারে। আশি বা নব্বইয়ের দশকের মুভিকে এক্ষেত্রে তুলনায় আনা অনুচিত। তবে এই সিজনের অনবদ্য ইফেক্ট দিয়ে স্ট্রেঞ্জার থিংস ছাড়িয়ে গেছে একই জনরার সমসাময়িক অন্যান্য সিরিজকে, এমনকি নিজের প্রথম দুই সিজনকেও।
বিরক্তিকর জক থেকে আদর্শ বেবিসিটারে পরিণত হওয়া স্টিভ আর ডাস্টিনের জুটি ছিল গত সিজনের হাই পয়েন্টের একটি। এবারেও তাদের বন্ধুত্ব সেরকমই অটুট আছে। ইলেভেন আর ম্যাক্সের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও চার বন্ধুর একসাথে রহস্য সমাধানের এবারে মিস্ট্রির চাইতে টিনেজ রোমান্স প্লটে গুরুত্ব ছিল বেশি, সেকারণে প্রথম ৩/৪ এপিসোড অন্য সিজনের তুলনায় ভিন্নরকম লাগতে পারে। পরের দিকে কাহিনী গতি পেয়েছে, ফাইনাল এপিসোডও ছিল ইমোশনাল রোলারকোস্টার। কোকা-কোলাসহ বিভিন্ন প্রোডাক্টের মার্চেন্ডাইজিং ছিল চোখে পড়ার মতো। আগের সিজনে ন্যান্সি জোনাথনের রিলেশনশিপ কাউন্সেলর ভূমিকা পালন করা মারি বাউম্যান এবারে সেই কাজ করেছেন চিফ হপার আর জয়েসের ক্ষেত্রে। এর আগে ক্রিস্টমাস লাইট কিংবা উইলের আঁকা ভাইন দিয়ে রহস্য সমাধানে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন জয়েস। এবার সামান্য ম্যাগনেটকে কেন্দ্র করে কৌতূহলী হয়ে উইলকে ফেলে চলে যাওয়াটা একটু যেন বেখাপ্পা। ‘নেভারএন্ডিং স্টোরি’র মিউজিকাল মোমেন্টটা হাসালেও কিছুটা অসহিষ্ণু করে তুলেছে।
নতুন চরিত্র মেয়র ক্লাইনের ভূমিকায় ছিলেন ‘দ্য প্রিন্সেস ব্রাইড’ খ্যাত ক্যারি এলওয়েস। স্বার্থপর রাজনীতিবিদের মতো নিজের শহরকে হুমকির মুখে তুলে দিতে একটুও বাঁধেনি তার। আশির দশকের আরেক তারকা জ্যাক বাসির চরিত্রটি একমাত্রিকই থেকে গেছে অবশ্য। এই সিজনের সেরা সংযোজন হলো রবিন। রাশিয়ান ষড়যন্ত্র আর হকিন্সে ঘটা অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপারগুলোকে বেশ সহজভাবে মেনে নিয়েছে সে। ইথান হক এবং উমা থরম্যানের মেয়ে মায়া হক এই সিজনের ব্রেকআউট তারকায় পরিণত হয়েছে। রবিন, ডাস্টিন, স্টিভ এবং এরিকার তথা ‘স্কুপ ট্রুপ’ এর অ্যাডভেঞ্চার এবং তাদের বাকবিতণ্ডা বেশ হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। ইঁচড়ে পাকা এরিকাকে নিয়ে অবশ্য অনেকের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জাগতে পারে। ভিলেনের ভূমিকায় রাশিয়ান গুপ্তঘাতক ছিল ভয়ানক। এদিকে সাদাসিধে রাশিয়ান বিজ্ঞানী অ্যালেক্সেই মন জয় করে নিয়েছে সবার।
কর্দমাক্ত আপসাইড ডাউন, ভাইন সুড়ঙ্গ কিংবা ডেমোগরগন না থাকলেও ফ্লেয়েড প্রাণীদের দ্বারা সৃষ্ট বায়োম্যাসের কারণে হররের কোনো কমতি হয়নি। তবে এই সিজনে ক্লাইম্যাক্সের কিছুটা ঘাটতি অনুভূত হয়েছে। এবারের বিপদটা খুব একটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল না বলেই হয়তো এপিসোড শেষের ক্লিফহ্যাঙ্গারগুলো খুব একটা চমক সৃষ্টি করতে পারেনি। এর আগের সিজনগুলোতে ইলেভেনের সাইকোকিনেটিক পাওয়ারের উৎস, আপসাইড ডাউন, হাইভ মাইন্ড, মাইন্ড ভয়েড, উইলের সাথে মাইন্ডফ্লেয়ারের সম্পর্কসহ রহস্যময় সব প্লটের সূচনা করা হয়েছিল, এবারে সেসব কাহিনী খুব একটা এগোয়নি। মনে হয়েছে, ‘দ্য এক্স ফাইলস’ এর মতো অযথা মিথলজিকে টেনে লম্বা করা হচ্ছে।
বেশিরভাগ সময়ে নিজেদের ভাষায় কথা বলা সোভিয়েতরা সবার নাকের ডগা দিয়ে কীভাবে জনবহুল এক শহরের জনপ্রিয় এক শপিং মলের তলায় আস্তানা গাড়লো, সে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। তারা কেন হকিন্স কি দিয়ে ইন্টার ডাইমেনশনাল গেটওয়ে খুলতে চায়, সেটাও পরিষ্কার না। এদিকে পুরো ঘটনায় কোনো মিলিটারি বা পুলিশ ব্যাকআপ না আসাটাও খাপছাড়া দেখায়। তবে এ সবকিছুর দোষই মেয়র ক্লাইনের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায়।
হঠাৎ করে কোনো ব্যাকআপ প্ল্যান ছাড়া একটি অপরিচিত সামরিক ফ্যাসিলিটিতে ঢুকে পড়াটা ছিল সেধে গিয়ে বিপদে পড়া, যেটা বুদ্ধিমান ডাস্টিন কিংবা রবিনের সাথে যায় না। নিজেদের তেমন কোনো প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কাউকে কিছু না জানিয়ে সেখানে ঢোকা আর ভাগ্যের জোরে ফিরে আসাটা দেখতে রোমাঞ্চকর হলেও একটু দুর্বল মনে হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় এক্স-মেন ধাঁচের এপিসোডটাকে বাদ দিলে তিন সিজনের মধ্যে দ্বিতীয় সিজনই সব মিলিয়ে সেরা। প্রথম সিজনও নিঃসন্দেহে দারুণ, তবে স্বাভাবিকভাবেই কাহিনী বিল্ডআপে কিছুটা সময় নিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, তৃতীয় সিজনকে ডাস্টিনের ভাষায় বলতে হচ্ছে “নট সো টুবুলার”। সেটা অবশ্য এই সিজনের সাফল্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। নেলসন রেটিং অনুযায়ী নেটফ্লিক্সে প্রথম চারদিনে ৪ কোটি মানুষ দেখা শুরু করেছে এই সিরিজ।
ডাফার ভ্রাতৃদ্বয় ইতিমধ্যেই সিজন ৪ এর কাহিনী কোনদিকে এগোবে সে আভাস দিয়েছেন। হকিন্স ছাড়িয়ে অন্য শহরে পোর্টাল, হপার কিংবা ইলেভেনের ভবিষ্যত, কামচাটকার রহস্যময় বাঙ্কার, রাশিয়ানদের ষড়যন্ত্রের মূল কারণ, ইলেভেনের ‘পাপা’ ডক্টর ব্রেনার; ভবিষ্যতের জন্য রসদের অভাব নেই। শুধু আশা থাকবে, আশির দশকের নস্টালজিয়া, হোমেজ আর ভিজুয়াল ইফেক্টের ওপর ভর না করে তারা কাহিনীকে আরেকটু গভীরতা দেবার দিকে নজর দেবেন।